বাজারে! আচ্ছা যাই। উঠে এলাম যেন কতদিনের আড়মোড়া ভেঙে। আব্বার পিছন পিছন হাঁটছি। এরমধ্যে দেখা হল একরাম চাচার সাথে। তাঁরা দুইজন কত কি নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। চাচা আমাকে দেখে বললেন, 'কি ভাইস্তা আছো কেমন? আসলা কবে? আরো দেখি শুকাই গ্যাছো! খাওয়া-দাওয়া করো না কিসু?' হাসলাম মনে মনে খুব। আসার পর থেকে গত দুইদিনে এত বেশি বার শুনেছি কথাটা!
দূর থেকে বাচ্চাদের কোরাস করে কোরআন পড়ার শব্দ ভেসে আসছে মক্তব থেকে। পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখি হুজুর বসে আছেন গম্ভীর মুখে, পাশে চিকন একটা জালি বেত রাখা। বয়স হয়েছে উনার, বেতটারও...কিন্তু এখনও একইরকম ক্ষমতাবান। বাচ্চাগুলো খুব মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ে যাচ্ছে। চোখে বেশ একটা ধাঁধা লেগে গেল, যেন একটা কোণায় নিজেকেও দেখতে পেলাম। হুজুরের চোখ এড়িয়ে সামনের ছেলেটার পিঠে মোক্ষম একটা খোঁচা মারছি। সে বেচারা ব্যথায় আঁতকে উঠতে গিয়েও হুজুরের ভয়ে সামলে নিল, কেবল চোখ ঘুরিয়ে একটা অগ্নিদৃষ্টি হানা ছাড়া।
কখন যেন পৌঁছে গেলাম বাজারে। বদলে গেছে সব, অনেক বেশি। ছোট ছোট ছাপড়া দোকানগুলোর জায়গায় চকচকে টিনের ঘর, কোথাও কোথাও পাকা দালান, বাহারি সব জিনিসের সাপ্লাই এখন অনেক বেশি। ঘুরছি আর দেখছি, কি নেই! মাঝামাঝি একটা জায়গায় পৌঁছে হঠাৎ হোঁচট খেলাম খুব। কাঁচা তরি-তরকারি, সবজির দোকানগুলোর পাশে একটা ছাপড়ামতন, এক লোক ঝাকায় করে এত্ত পান সাজিয়ে রেখেছে, পাশের ডালায় সুপারি, জর্দা, সাদা পাতা, চুন...
সেই কবেকার কথা! বিশ বছর...না আরো বেশি, হয়তো পঁচিশ। একটা ছেলে... ঢিলে ঢালা হাফ প্যান্ট পরা, পরনে রঙ চটে যাওয়া একটা গেঞ্জি, পায়ে স্পঞ্জ, চোখে উজ্জল রোদের উচ্ছাস... হাফাতে হাফাতে দৌড়ে এল পানের ডালাটার সামনে। পান কিনবে, সাথে সুপারি, চুন। গ্রাম থেকে আজ দাদা-দাদী এসেছেন, তাঁরা পান না খেয়ে থাকতেই পারেন না। আম্মা তাই সবচেয়ে উৎসাহী মানুষটাকেই পাঠিয়েছেন। দাদীর গা ঘেঁষে শুয়ে রাতের বেলায় গল্প শোনা, মাথার চুলে তাঁর কাঁপা হাতের বিলি, আর পান-জর্দার একটা নেশা নেশা গন্ধ! দাদাজানের রাগী, গম্ভীর মুখের আড়ালে অদ্ভূত এক প্রশ্রয়। যে ছেলেটার ঘুড়ি ওড়ানো কড়াভাবে নিষেধ, তার জন্য বরাদ্দ হল বাড়তি দুটো টাকা। পকেটে এক হাত, শক্ত হাতে চেপে ধরা টাকাটা সে হাতে...অস্থির ছেলেটা পানের দোকানের সামনে অধৈর্য দাঁড়িয়ে, ছটফট করছে অবিরত। কখন পানের গাঁট বাঁধা শেষ হবে, আর ছেলেটা দৌঁড়ে যাবে ঘুড়ির দোকানের সামনে। আকাশ তার জানলা খুলে আলো ছড়িয়ে ডাকছে ছেলেটাকে।
আমার চোখের ভেতর থেকে শৈশবের আমিটা বেরিয়ে দৌড়ে গেল ঢিলে ঢালা হাফপ্যান্ট আর রঙচটা গেঞ্জিটা পড়ে। একহাতে পানের গাঁটরি, সুপারি, চুন, জর্দা; আরেক হাতে সাতরঙা এক ঘুড়ি...উড়ছে আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে। তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে...আকাশ ছুঁয়ে...রঙধনুর দেশে...
................................................................................
গল্পটার এত অদ্ভুত সুন্দর একটা নাম দিয়ে দেয়ার জন্য রানা ভাইয়ার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা। এত সুন্দর একটা নামের একটা গল্প লেখার সাহস আমার ছিল না। শুধু মার খাওয়ার ভয়ে লিখতে হল।