দোয়া কখন কবুল হয়
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, "আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে- বস্তুত আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য। যাতে তারা সৎ পথে আসতে পারে।" (সূরা বাকারা : ১৮৬)।
তাফসিরে ইবনে কাসীরে আল্লামা হাফেজ ইবনে কাসীর (রহ.) এ আয়াতের শানে নুজুল প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, কোনো গ্রামের কিছু লোক হজরত রসুলে আরাবি (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেছিল যে, 'যদি আমাদের রব আমাদের কাছেই থেকে থাকেন, তবে আমরা আস্তে আস্তে দোয়া করব। আর যদি দূরে থেকে থাকেন তবে আমরা উচ্চৈঃস্বরে ডাকব।' তখন তাদের সেই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে এ আয়াত নাজিল করা হয়।
জবানের হেফাজত করা উচিত। জবান আল্লাহতায়ালার অনেক বড় নেয়ামত। জবানের দ্বারা মানুষ কোরআন তেলাওয়াত করে, জিকির আজকার করে, আবার এ জবান দ্বারা মানুষ গিবত শেকায়েত করে, গালাগাল করে, অর্থাৎ জবানের দ্বারা যেমন সওয়াব কামানো যায়, তদ্রূপ গোনাহও কামানো যায়। জবান দ্বারা জান্নাত অর্জন করা যায়, জাহান্নামও অর্জন করা যায়। জবান দ্বারা ইমানের কালিমা উচ্চারিত হয়, আবার জবান দ্বারা কুফরির কালিমাও উচ্চারিত হয়। তাই জবান অনেক বড় নেয়ামত। এ নেয়ামতের হেফাজত করা উচিত।
যে জিনিস যত বেশি দামি ওই জিনিস তত বেশি হেফাজত করতে হয়। টাকা-পয়সা মানুষের কাছে অনেক দামি, তাই মানুষ টাকা-পয়সাকে বাইরে রাখে না। বরং ঘরের মধ্যে রাখে। ঘরের আলমারিতে রাখে। আবার আলমারির ছোট্ট বাক্সে রাখে। ওই ছোট্ট বাক্সে তালা দেয়। আলমারিতে তালা দেয়। ঘরের দরজায় তালা দেয়। তাহলে দেখা গেল, মানুষের মূল্যবান সম্পদ টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, তিনটি জিনিসের মধ্যে তিনটি তালা দ্বারা আবদ্ধ করে রাখা হয়। তদ্রূপ জিহ্বাকেও তিনটি জিনিস দ্বারা সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।
#এক. নাক, কান ইত্যাদি অঙ্গের মতো জিহ্বাকে শরীরের বাইরে রাখা হয়নি। বরং শরীরের ভিতরে রাখা হয়েছে, মুখের ভিতরে রাখা হয়েছে।
#দুই. জিহ্বাকে হেফাজত করা হয়েছে বত্রিশটি দাঁত দ্বারা।
#তিন. জিহ্বাকে হেফাজত করা হয়েছে ঠোঁট দ্বারা। আল্লাহতায়ালা জিহ্বাকে তিনটি জিনিস দ্বারা হেফাজত করেছেন।
জিহ্বা দামি হওয়ার কারণেই তাকে এভাবে হেফাজত করা হয়েছে। এ জন্য কথা বলার সময় চিন্তাভাবনা করে কথা বলতে হবে। আর যে ব্যক্তি চিন্তা ফিকির করে কথা না বলে, অধিকাংশ সময় তার কথা ভুল হয়। জবানকে নাড়ানোর আগে চিন্তাভাবনা করে নাড়ানো চাই। আমি ভালো কথা বলছি নাকি খারাপ কথা বলছি। ভালো কথা হলে বলব, খারাপ কথা হলে বলব না। মন্দ কথা আসলে দাঁতের দ্বারা চাপ দিয়ে জিহ্বাকে বন্ধ করে দেব। দাঁত দ্বারা সম্ভব না হলে ঠোঁট দ্বারা বন্ধ করব। ঠোঁটের বাইরে কথা আসতে দেব না। এভাবে যদি আমরা জবানকে হেফাজত করতে পারি তাহলে আমরা সবাই খারাপি থেকে বাঁচতে পারব।
আল্লাহতায়ালা আমাদের জবানকে মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সব নাপাকি থেকে হেফাজত করেছেন। সন্তান যখন মায়ের পেটে আসে, আল্লাহতায়ালা কুদরতিভাবে মায়ের পেটের সঙ্গে সন্তানের নাভির যোগাযোগ স্থাপন করে দেন। ফলে মা যা বক্ষণ করেন তা রক্ত হয়ে নাভি দিয়ে সন্তানের পেটে চলে যায়। ওই রক্তটাই সন্তানের জন্য খাবার হয়ে যায়। এ রক্ত যেহেতু নাপাক, তাই আল্লাহপাক এ নাপাক রক্ত থেকে জবানকে হেফাজত করেছেন। কারণ এ জবান দিয়ে মানুষ আল্লাহর জিকির করবে, কোরআন তেলাওয়াত করবে। এ জবানকে হেফাজত করতে পারলে আমরা জিহ্বাকে ভালো কাজে ব্যবহার করতে পারব।
এ জবান দ্বারা আমরা জিকির করি। কোরআন তিলাওয়াত করি। আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করি। কিন্তু আমাদের দোয়া কবুল হয় না। অথচ সাহাবায়ে কেরামও এ জবান দিয়ে জিকির করতেন। কোরআন তিলাওয়াত করতেন, দোয়া করতেন, তাদের দোয়া কবুল হতো। আমাদের দোয়া কবুল হয় না। কারণ সাহাবায়ে কেরাম জবানের হেফাজত করেছেন। তাদের জবান পাক ছিল। তারা পাক জবান দ্বারা যখন জিকির করেছেন, কোরআন তিলাওয়াত করেছেন, দোয়া করেছেন, তাদের জিকির কবুল হয়েছে। তাদের তিলাওয়াত কবুল হয়েছে। তাদের দোয়া কবুল হয়েছে। আর আমরা আমাদের জবানকে হেফাজত করি না। আমাদের জবান নাপাক। আমরা নাপাক জবান দ্বারা জিকির করি, কবুল হয় না। তিলাওয়াত করি, কবুল হয় না। দোয়া করি, কবুল হয় না।
হজরত হাজি ইমদাদুলাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ) বলতেন, পাত্র থেকে তরকারি উঠানোর জন্য চামচ ব্যবহার করা হয়। চামচ যদি নাপাক থাকে তাহলে ওই চামচকে পাক করে তারপর পাত্রে দিতে হয়। এখন যদি কেউ নাপাক চামচ তরকারির পাত্রে দেয়, তাহলে সম্পূর্ণ তরকারি নাপাক হয়ে যাবে। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হলো আগে চামচ পাক করে নিতে হবে তাহলে ওই পাত্র থেকে পবিত্র দরকারি পবিত্র আকারে বের করা যাবে। অনুরূপ আমাদের দিল হলো একটা পাত্র, আর জবান হলো চামচের মতো। জবান যদি পাক-পবিত্র না হয় তাহলে দিলে পবিত্র জিনিস থাকলেও তার নাপাক জবান দ্বারা বের করতে গেলে নাপাক হয়ে বের হবে। আর যদি জবানকে পাক করে নিতে পারি, তাহলে পবিত্র জিনিস পবিত্র আকারে বের করা যাবে। সুতরাং জবানের হেফাজত করা উচিত। এ জবান দ্বারা অপরিচিত একজন মহিলা হালাল হয়ে যায়। আবার এ জবান দ্বারা নিজের স্ত্রী হারাম হয়ে যায়।
হাদিস শরিফে আসছে, হজরত রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, 'মুখের গোনাহের কারণে অনেক মানুষকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে'। (তিরমিজি, হাদিস নম্বর-২৬১৬)।
তাই সব সময় চুপ থাকা চাই। কথা বললে ভালো কথা বলব অথবা চুপ থাকব। মন্দ কথা বলব না। হাদিস শরিফে আসছে, 'যে চুপ থাকে, সে নাজাত পায়। আল্লাহপাক আমাদের জবানের হেফাজত করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : মুফতি আমজাদ হোসাইন, খতিব, নয়ানগর বায়তুল আমান জামে মসজিদ, বারিধারা, ঢাকা ১২১২।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১০:০৫