কবি জীবনানন্দ দাশ। নির্জনতার কবি, রূপসী বাংলার কবি। রোমান্টিক কবি কিংবা আধুনিক কবি আরও কত নামেই ডাকা হয় তারে। তিনি তার কবিতায় গ্রাম বাংলার রূপ রং রস আর উপমায়, অলংকারে যে শব্দ ও বাক্য প্রয়োগ করে অগনিত মানুষের মনে প্রিয় কবি হয়ে আছেন অন্য কোন কবি পক্ষে সে স্থান দখল করা সম্ভব নয়।
জীবননান্দ নামটি উচ্চারিত হলেই চোখের সামনে ভেসে আসে অসংখ্য কবিতা-
সুরঞ্জনা ঐ খানে যেওনাকো তুমি..............।
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাটিতেছি...............।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;..............
প্রেম ধীরে মুছে যায়,
নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?
তোমার মুখের রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না
খুঁজি না।
শরীর রয়েছে, তবু মরে গেছে আমাদের মন!
হেমন্ত আসেনি মাঠে ,- হলুদ পাতায় ভরে হৃদয়ের বন!
চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।
আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;
জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে
কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।
আজকে রাতে তোমায় আমার কাছে পেলে কথা
বলা যেত; চারিদিকে হিজল শিরীষ নক্ষত্র ঘাস হাওয়ার প্রান্তর।
শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে-
বলিলাম- ‘একদিন এমন সময়
আবার আসিয়ো তুমি- আসিবার ইচ্ছা যদি হয়-
পঁচিশ বছর পরে।’
থমথমে রাত,- আমার পাশে বসল অতিথি,-
বললে,- আমি অতীত ক্ষুধা,-তোমার অতীত স্মৃতি!
“কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ,
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।”
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার! কুড়ি বছর পরে”
“আবার আকাশের অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে :
আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার।
যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনদিন দেখিনি,
সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়েছে উঠছে।”
“কাল রাতে – ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ ।”
যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের – মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা”
“শেষবার তার সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে
বলিলাম: ‘একদিন এমন সময়
আবার আসিয়ো তুমি, আসিবার ইচ্ছা যদি হয়!–
পঁচিশ বছর পরে!”
“তবু তোমাকে ভালোবেসে
মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এসে
বুঝেছি অকূলে জেগে রয়
ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি এ হৃদয় ।”
“সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস –
আকাশের ওপারে আকাশ।”
পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনার মনে;
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে।
সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়, আমাদের মুখ সারাটি রাত্রি মাটির বুকের’পর।
এরকম আরও কত শত কবিতা ও কবিতার লাইন যে বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা উচ্চারন করে আবৃত্তি করে তার শেষ নেই। এই স্বপ্ল জীবনে যে সফল কবিতা তিনি দিয়ে গেছেন তার জন্য তিনি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কিন্তু দুঃখ একটাই এই মানুষটি বেঁচে থাকতে তার সফলতা দেখে যেতে পারেননি। মৃত্যুর পরে তিনি যতটা জনপ্রিয় জীবীত থাকতে ঠিক ততটাই অবহেলিত ছিলেন।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০২৩ সকাল ১১:৪৭