রাত ১২।০০ বাজে। ঢাকার অদূরে উপশহরের নির্জন এক বাগান বাড়ির হলুদ রঙা তিন তলা বিল্ডিং এর ২য় তলায় জঙ্গিদের সভা বসেছে। বিদ্যুৎ থাকলেও সবক’টা বাতি নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে সভাকক্ষ আলোকিত করা হয়েছে। বাহিরে একটা দু’টা জোনাকি জানালার কাচে বাড়ি খেয়ে ফিরে যাচ্ছে আপন মনে অন্ধকার ঝোপে।
সব সদস্য বসে আছে যার যার আসনে। প্রত্যেকের সামনে একটা করে লেপটপ, পানির বতল, দৈনিক পত্রিকা ও জিহাদী বই। সভাপতি কক্ষে প্রবেশ করতে সবলে সালাম দিলেন এবং মুসাফা করলেন। আযহার উদ্দিন ওরফে কফিল ‘ঈমানের কাফেলা’ নামক জঙ্গিগোষ্ঠীর নেতা। সে প্রথমে আসন গ্রহণ করে সকল সদস্যের উপর চোখ বুলিয়ে সুললিত কন্ঠে কোরআনের পাঁচটি আয়াত পাঠ করে সভার কার্যক্রম শুরু করলেন।
গুরু গম্ভীর কন্ঠে তিনি বললেন- আজকের বিষয় হচ্ছে ‘ইয়ুর ব্লগের ধর্ম অবমাননা পোস্ট ও নাস্তিক ব্লগার’। সবাই আপনারা লেপটপে ‘ইয়ুর ব্লগ লিখে সার্চ দিন এবং বামপাশের ১০ নম্বর ‘সাহসী কথন’ নিকে ক্লিক করুণ। এখানে এই ব্লগারের সর্বশেষ পোস্ট-ধর্মের গোপন কথা পড়ে মতামত জানান ধর্ম অবমাননাকারী এই নাস্তিক ব্লগারের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া যায়।
সব সদস্য সেই পোস্ট পড়ার পর তাদের রক্ত গরম হয়ে গেল। সকলেই যার যার মত করে মতামত পেশ করল। সভায় সবার মাতামতের ভিত্তিতে ‘সাহসী কথন’-কে দুনিয়া ছাড়া করার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।
সানী ও ইমনের উপর দায়িত্ব দেওয়া হলো তারা যেন অবিলম্বে ব্লগে দু’টি নিক খুলে ‘সাহসী কথন’ এর সাথে বন্ধত্ব করে ওর ফেসবুক আইডি জেনে তার সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে এবং সাক্ষাৎ করা পর্যন্ত সফলতা আসলে বাকি নির্দেশনা দেওয়া হবে।
মাস খানেক পর সভাপতি আযহার উদ্দিন ওরফে কফিল সানী ও ইমনকে ডেকে রিপোর্ট দিতে বললেন।
সানী ও ইমন জানালো তারা যথাক্রমে ‘সুন্দর মন’ ও ‘প্রিয় তুমি’ দুটি নিক খুলে অনেকটাই পরিচিত হয়ে গেছেন সেই ব্লগে। এবং ‘সাহসী কথন’ এর প্রতিটি পোস্টে লাইক, কমেন্ট করে এবং সে যে মতামত দিচ্ছে তাই সঠিক বলে তোষামোদ করে বন্ধুত্বের ফাঁদে ফেলেছেন একই সাথে ফেসবুক আইডিও বিনিময় হয়েছে। নভেম্বরের ৩০ তারিখ চট্টগ্রামে ‘সাহসী কথন’ এর সাথে দেখা হওয়ার তারিখ চূড়ান্ত হয়েছে।
বাহ! বেশ বলে-আযহার উদ্দিন ওরফে কফিল একটা তৃপ্তির হাসি হাসলেন এবং বললেন- ঢাকা অ্যাটাক মুভির মত তোমাদের দ্বারা ব্লগার অ্যাটাও আলোচিত হওয়া চাই। কি ভাবে সেই নালায়েক নাখাস্তা ব্লগারকে খুন করতে হবে তার প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশণা দিয়ে সভাপতি তাদের বিদায় করলেন।
২৫ নভেম্বর সানী ও ইমন চিটাগাং এসে হোটেলে উঠল। ম্যাসেঞ্জারে ‘সাহসী কথন’ কে বলল কক্সবাজার যাচ্ছি সেখান থেকে এসে তোমার সাথে দেখা করবো। ‘সাহসী কথন’ এর ধর্মের নামে ভন্ডামী নিয়ে লেখা আরেকটা পোস্ট ব্লগে বেশ আলোচিত সমালোচিত হলো। সানী ও ইমন সাহসী কথনকে সমর্থন করে জোড়ালো অবস্থান নেওয়ায় তাদের প্রতি বেশ কৃতজ্ঞা দেখালো সেই ব্লগার।
৩০ নভেম্বর আগ্রাবাদের জাম্বুরী মাঠে যা এখন বিনোদন পার্ক হয়ে গেছে সেখানে তিন ব্লগারের সাক্ষাৎ ও আড্ডা হলো। অনেক কথা হলো। রেস্তোরায় সন্ধ্যায় চা পান পর্ব শেষে বিদায় নিয়ে সাহসী কথন চলে গেলে সেই দুই জঙ্গী ওকে ফলো করে ওর বাসার ঠিকানা পেয়ে গেল।
এর পর শুরু হলো আসল কাজ। গোপনে রেকি করা, কোথায় যায়, কখন যায় সব নজড়দারি করে একটা জিনিস তাদের কাছে খটকা লাগলো। সাহসী কথন নাস্তিক নয়। সে মাঝে মাঝে নামাজ পড়ে। এটা দেখে সানী ও ইমন দুজনই বেশ অবাক হলো। তারা দুজন হত্যার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে নেতাকে ফোনে সব বিস্তারিত জানালো।
সব শুনে নেতা বললেন-যেহেতু নামাজ পড়ে তাই তার হত্যা রহিত করা হলো। কিন্তু সে ধারাবাহিকভাবে ধর্মকে তুচ্ছ তাচ্ছিল করে যাচ্ছে তাই শাস্তি তাকে পেতেই হবে। সাহসী কথন-কে সুযোগ বুঝে আঘাত করে , আহত অবস্থায় রক্তাক্ত দেহে কোন স্থানে ফেলে চলে আসতে হবে। সাবধান এ কাজে কোন ভাবেই ধরা পড়া চলবে না।
সানী ও ইমন সুযোগ খুঁজতে লাগলো। ১০ ডিসেম্বর কাঙ্খিত সে সুযোগ তারা পেয়ে গেলো। সাইকেল নিয়ে সাহসী কথন সেদিন বিকালে বেরুল এবং ডিসি হিলে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। এক ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও কেউ সাহসী কথন সাথে দেখা করতে এলো না। এদিকে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। লোকজন এর আনাগোনা নেই বললেই চলে।
ঘন ঘন মোবাইলে টাইম দেখে খুব বিরক্ত হলো সাহসী কথন । হঠাৎই তার চোখে মুখে হাসি ফুঠে উঠলো তার সামনে দাড়িয়ে আছে এক লাস্যময়ী নেকাবে মুখ ঢাকা নারী। কথপোকথনের এক পর্যায়ে পিছন থেকে কে যেন চেপে ধরল ব্লগার সাহসী কথন-কে। আর সামনে থাক সেই নারী ধারালো অস্ত্রে একে দিল যেন ক্রস চিহ্ন। রক্তে ভিজে গেল তার শার্ট ও প্যান্ট। চিৎকার করার আর সুযোগ পেলনা সাহসী সন্তান কারণ পিছনে থাকা লোকটি ধাতব একটা কিছু দিয়ে বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে ফেলল তাকে। মাত্র কয়েক মিনিটেই ঘটে গেল অঘটন।
সাহসীর বন্ধু রিমন যখন ডিসি হিলে এসে কাউকে দেখতে না পেয়ে সাহসী কথন এর নাম্বারে ফোন দিল তখন পাশের পাহাড়ের ঢালে রিংটোন বেজে উঠল। ক্রমাগত রিং হওয়াতে একটু খোঁজাখুজি করতেই সে আওয়াজের উৎস পেয়ে গেল। কাছে গিয়ে দেখলো তার বন্ধু অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে আর রক্তে ভিজে গেছে তার দেহ।চিৎকার করে লোক জড়ো করে সাহসীকে দ্রুত হাসপালে নিয়ে গেলে প্রাণে বেঁচে যায় সে।
বিজয়ের মাসে এমন ন্যাক্কার জনক ঘটনায় দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মিডিয়ায় ঝড় উঠে। খবরের শিরোনাম হয়- কতিপয় দুর্বত্ত কর্তৃৃক ব্লগার চরমভাবে আহত। কিন্তু কোন জঙ্গিগোষ্ঠী এর দায় স্বীকার কনে না এবং কেউ ধরাও পড়ে না।
বেশ কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে সাহসী কথন তার জীবনের শেষ পোস্ট দেন ব্লগে এবং সবার কাছে ক্ষমা চান এই বলে যে তিনি তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। আসলে আগুন নিয়ে খেলাটাই তার বোকামি হয়েছে।
ছবি- নিজের মোবাইলে তোলা।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:৫১