রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ বাংলাদেশের ৪র্থ ক্যাডেট কলেজ।১৭৩৩ সালে বার্লিনে প্রথম ক্যাডেট স্কুল স্থাপন করেন জার্মান সামরিক শাসক দ্বিতীয় ফ্রেড্রিক উইলিয়াম। জার্মান সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবার (জাংকার) এর সন্তানরা যাতে বিদেশী সেনাবাহিনীতে যোগ না দেয় এবং একই সাথে জাংকারদের সমর্থন পাবার জন্য এই ক্যাডেট স্কুলের শুরু।পরবর্তীতে সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ফ্রান্সে এই ব্যবস্থা চালু করেন।কিন্তু ক্যাডেট কলেজ শব্দটি প্রথম আসে জার্মানীর চ্যান্সেলর অটো ফন বিসমার্ক এর সময়ে । ক্যাডেট কলেজে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের (সপ্তম শ্রেণী হতে দ্বাদশ শ্রেণী) জাতীয় পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের পাশাপাশি ক্যাডেটদের শারীরিক, মানসিক,বুদ্ধিবৃত্তিক, চারিত্রিক, সাংস্কৃতিক ও নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষা সম্পূরক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
অবস্থান ও যোগাযোগঃ
রাজশাহী শহর থেকে ৩০ কিমি দূরে চারঘাট উপজেলার সারদায় পদ্মা নদীর তীরে মুক্তারপুর গ্রামে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ অবস্থিত। রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের বানেশ্বর ট্রাফিক মোড় হতে বানেশ্বর-চারঘাট সড়কের সারদা ট্রাফিক মোড় দিয়ে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে যেতে হয়।
টেলিফোনঃ 07223-56088 ফ্যাক্সঃ 07223-56283 ই-মেইলঃ [email protected]
পত্র যোগাযোগঃ অধ্যক্ষ, রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ, সারদা, রাজশাহী।
ইতিহাস
ঔপনিবেশিক পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত ৪র্থ তথা শেষ ক্যাডেট কলেজ ‘রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ’ । পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১৯৬৪ সালের ৬ই নভেম্বর আয়ুব ক্যাডেট কলেজ নামে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান ১৯৬৬ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী আয়ুব ক্যাডেট কলেজের উদ্বোধন করেন। পদ্মা নদীর তীরে মুক্তারপুর গ্রামে ১১০ একর জমির উপর তিনটি হাউস ( হোস্টেল) নিয়ে এ ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন উইং কমান্ডার মোহাম্মদ সাঈদ, পিএএফ। কলেজের প্রথম বাঙ্গালী অধ্যক্ষ এম বকীয়তুল্লাহ ।রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের প্রথম ক্যাডেট আব্দুল হামিদ (১/১)। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আইয়ুব ক্যাডেট কলেজের নাম পরিবর্তন করে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ রাখা হয়। এই ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ক্যাডেটদের সংগঠন Old Rajshahi Cadets Association (ORCA)- অরকা নামে পরিচিত।
অবকাঠামো
বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর ভবন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। বিশাল এই দ্বিতল ভবনে রয়েছে- শ্রেণীকক্ষ সমূহ, কম্পিউটার ল্যাব, পদার্থ বিদ্যা,রসায়ন বিদ্যা ও জীব বিদ্যা ল্যাবরেটরি, মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাব, কেন্দ্রীয় লেকচার হল, অনুষদ সমূহ, উপাধ্যক্ষের অফিস এবং স্টাফ লাউঞ্জ। একাডেমিক ব্লক সংলগ্ন আরেকটি স্থাপনা হল বীর শ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল অডিটোরিয়াম। অডিটোরিয়ামটিতে আধুনিক মঞ্চ, অডিও ভিজুয়াল ইফেক্ট ও আলোক প্রক্ষেপণের সুব্যবস্থা রয়েছে। দ্বিতল এ অডিটোরিয়ামের দর্শক ধারণ ক্ষমতা ৬৫০জন। অডিটোরিয়ামের দক্ষিণ পূর্ব কোনে বীরশ্রেষ্ঠ মোঃ: আব্দুর রউফ পাঠাগার। বিশ্বসাহিত্য, বিশ্বকোষ, মুক্তিযুদ্ধ এবং বিভিন্ন বিষয়ের রেফারেন্স বইয়ে কলেজের এ কেন্দ্রীয় পাঠাগারটি সমৃদ্ধ। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে ক্যাডেটদের আবাসনের জন্য ৩টি হাউস ( হোস্টেল) রয়েছে। প্রখ্যাত মুসলিম বীর খালিদ বিন ওয়ালিদ, মুহাম্মদ বিন কাসিম এবং তারিক বিন যায়েদ এর নামানুসারে হাউস গুলোর নামকরণ করা হয়েছে- খালিদ হাউস, কাসিম হাউস এবং তারিক হাউস। সুসজ্জিত, সুরক্ষিত, একশত শয্যা বিশিষ্ট প্রত্যেকটি হাউসের সামনে রয়েছে সুন্দর বাগান।
প্রশাসন
ক্যাডেট কলেজ সমূহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল শাখা কর্তৃক সরাসরি নিয়ন্ত্রিত। একজন লে: কর্নেল ( কখনও নৌ/বিমান বাহিনীর সমমর্যাদার অফিসার) অথবা সিনিয়র শিক্ষক অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যক্ষ ক্যাডেট কলেজের সার্বিক বিষয়ে প্রধান দায়িত্ব পালন করেন। উপাধ্যক্ষ শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্ব পালন করেন। মেজর পদমর্যাদার একজন অফিসার (অ্যাডজুটেন্ট) প্রশাসনিক বিষয়ে অধ্যক্ষকে সহায়তা করেন। প্রত্যেক হাউসে একজন সিনিয়র শিক্ষক ‘হাউস মাস্টার’-এর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি হাউসের প্রশাসনিক বিষয় দেখা শোনা করেন।
দক্ষ নেতৃত্ব গড়ে তোলা এবং কলেজ প্রশাসন সুষ্ঠ ভাবে পরিচালনার জন্য দ্বাদশ শ্রেণী হতে এক গুচ্ছ প্রিফেক্ট মনোনয়ন দেয়া হয়। ক্যাডেট প্রশাসন কলেজ প্রশাসনাধীন এবং ক্যাডেটদের সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করে। প্রিফেক্ট পদগুলো হচ্ছে-
কলেজ প্রিফেক্ট, হাউস প্রিফেক্ট (প্রত্যেক হাউসে), কলেজ গেমস প্রিফেক্ট, কলেজ কালচারাল প্রিফেক্ট, কলেজ ডাইনিং হল প্রিফেক্ট, অ্যাসিস্ট্যান্ট হাউস প্রিফেক্ট, হাউস গেমস প্রিফেক্ট, হাউস কালচারাল প্রিফেক্ট, জুনিয়র প্রিফেক্ট ( প্রিফেক্টদের সহায়তার জন্য প্রত্যেক হাউসের একাদশ শ্রেণী হতে মনোনীত)।
শিক্ষা ব্যবস্থা
রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে ক্যাডেটদের সপ্তম শ্রেণি হতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হয়। প্রত্যেক ক্লাসে গড়ে ৫০ জন ক্যাডেট ২ শাখায়(ফর্ম) বিভক্ত হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে। প্রত্যেক শাখা তদারক করার জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত শিক্ষক (ফর্ম মাস্টার) রয়েছেন। গ্রীষ্ম কালে সকাল ৮টা থেকে বেলা ১টা ( শনিবার হতে বুধবার) এবং সকাল ৭-৪০ হতে বেলা ১১.২০ টা পর্যন্ত ( বৃহঃবার) এবং শীতকালে সকাল ৮-২০ হতে বেলা ১-৫০ এবং ৮-২০ হতে বেলা ১-৩০ পর্যন্ত ( বৃহঃ বার) ক্লাস নেয়া হয়। ক্লাসের সময় ছাড়া প্রত্যেকদিন নিজ নিজ শ্রেণীকক্ষে লেখাপড়া করতে হয় (প্রিপারেটরি ক্লাস বা প্রেপ ক্লাস)। গ্রীষ্মকালে প্রেপ ক্লাস ৩টি। বিকালে ৩-১৫ হতে ৪-১৫,সন্ধ্যায় ৬-৪৫ হতে ৮-১৫ এবং রাত্রে ৮-৫০ হতে ৯-৫৫ পর্যন্ত । শীতকালের প্রেপ ২টি। সন্ধ্যায় ৬-৩০ হতে ৭-৫৫ এবং রাত্রে ৮-৩০ হতে ৯-৫৫ পর্যন্ত। দুর্বল ছাত্রদের জন্য খেলার সময়ে অতিরিক্ত প্রিপারেটরী ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়। ক্যাডেটদের যোগ্যতা মূল্যায়ন এবং শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষার (জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসি) প্রস্তুতির জন্য স্পটটেস্ট,পাক্ষিক পরীক্ষা, প্রগ্রেস টেস্ট প্রভৃতি পরীক্ষা নেয়া হয়ে থাকে। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে মানবিক বিভাগে ইংরেজী,বাংলা,ইসলামিক স্টাডিজ,পৌরনীতি,অর্থনীতি,ভূগোল এবং চারু ও কারুকলা এবং বিজ্ঞান বিভাগে গণিত,পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন,জীববিদ্যা,পরিসংখ্যান ও কম্পিউটার সাইন্স বিষয়গুলো রয়েছে। সাধারণ শিক্ষার বাইরে ধর্মীয় শিক্ষা, কমিউনেকেটিভ ইংলিশ, সাধারণ জ্ঞান ও চলতি ঘটনার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। ক্যাডেটদের শিক্ষা সংক্রান্ত এবং অন্যান্য বিষয়ের মূল্যায়ন নিয়মিত অভিভাবকদের অবহিত করা হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান
১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষন, শাসন ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে যে আন্দোলন দানা বেধে উঠছিল তা আইয়ুব ক্যাডেট কলেজকেও প্রভাবিত করেছিল। কলেজের অধ্যক্ষ এম বকীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রশীদ, শিক্ষকবৃন্দ,কর্মচারীবৃন্দ এবং সকল ক্যাডেট অহিংস এবং অসহযোগ আন্দোলন সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেন। ২৩ মার্চ আইয়ুব ক্যাডেট কলেজের নাম সর্বসম্মতিক্রমে ‘মুক্তারপুর ক্যাডেট কলেজ’ রাখা হয় এবং পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ঐদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এক বিশাল মিছিল নিয়ে ক্যাডেট কলেজ এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা প্রদক্ষিণ করে। কলেজের অধ্যক্ষ এম বকীয়তুল্লাহ ক্যাডেট কলেজ পরিবারকে সাথে নিয়ে এ মিছিলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। এভাবে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ স্থানীয় জনতার সাথে একাত্ব হয়ে পাকিস্তান বিরোধী একটি আন্দোলন সংগঠিত করে। মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের তিনজন বীরত্বের জন্য খেতাব পান। তাঁরা হলেন- ১] শহীদ আবু বকর সিদ্দিকী, বীর বিক্রম, ২] মেজর এম এ রশীদ বীর প্রতীক এবং ৩] শামসুল আলম বীর প্রতীক।মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের ১৮ জন শহীদ হয়েছেন ।
রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য কেউ আশা করতেই পারেন। তাদের জন্যেই এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।ধন্যবাদ।
[ মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ- এই শিরোনামে পরে একটা ব্লগ প্রকাশ হবে। তথ্য সূত্রঃ রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ কর্তৃপক্ষ, উইকিপিডিয়া, এবং মিশিগানের সুসমিত।]
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৩:১৬