আজ মহান মে দিবস। পহেলা মে সকল শ্রমিকের আন্তর্জাতিক সংহতি ও সংগ্রামের এক প্রতীকী দিন। এদিনটি বিশ্বের খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের সংহতির দিন। আজ থেকে ১২৯ বছর আগে ১৮৮৬ সালের এদিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোসহ বড় বড় শহরে শ্রমিকরা দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ ও শ্রমের ন্যায্য মজুরির জন্য সর্বাত্মক ধর্মঘটের আয়োজন করে। বিুব্ধ শ্রমিকরা তাদের মালিকের নির্দেশ উপো করে মিছিল-মিটিং এবং সমাবেশ করেন। এর আগে শুধু শ্রমিকদের ক্রীতদাশের মত সারাদিন কাজ করতে হতো। দৈনিক ১৪-১৮ ঘণ্টা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শ্রম দেওয়ার পরও শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য মজুরি তথা পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হতো। অথচ শ্রমিকদের শ্রমের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছিল সভ্যতা ও অর্থনৈতিক অবস্থা। শুধু তাই নয়, শ্রমিকদের আরাম-আয়েশ বা বিনোদনের জন্য ছিল না কোন ছুটির ব্যবস্থা। শোষণ-বঞ্চনার প্রতিবাদের শ্রমিকরা একত্রিত হয়ে ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে যে আন্দোলনের সূচনা করে তা তা ৩ ও ৪ মে চুড়ান্ত রূপ ধারণ করে। শিকাগো শহরের ওই শ্রমিক আন্দোলনে পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে কমপে ১০ জন শ্রমিক নিহত এবং বহু শ্রমিক গুরুতর আহত হন। অনেক শ্রমিক নেতাকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করে দিনের পর দিন আটকে রাখা হয়। এমনকি গ্রেফতারকৃত শ্রমিকদের মধ্যে ৭ জনকে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদ-ে দ-িত করা হয়। এভাবে জীবনের বিনিময়ে শ্রমিক শ্রেণি আদায় করে দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের অধিকার। শ্রমিক আন্দোলনের এই ঘটনাকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য শুরু করা হয় ’আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’। ফলে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে '১ মে' আন্তর্জাতিক শ্রমিক ঐক্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। (সূত্র:উইকিপিডিয়া)
একটা নির্দিষ্ট শ্রমের সাথে বেতন বৈষম্য, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, চাকুরির নিশ্চয়তাসহ বিভিন্ন বিষয়ও আজ শ্রমিকদের জোরালো দাবিতে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী শ্রমিক ইউনিয়নগুলোও শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের ল্েয কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বের উন্নত দেশ সমূহের মত বাংলাদেশের শ্রমিকরাও অতীতের লোমহর্ষক স্মৃতি ধারণ করে, আর বর্তমানের বঞ্চনা থেকে মুক্তির আশা নিয়ে দিনটি পালন করে থাকে। কিন্তু খুব দুঃখের বিষয় যে, ১২৯ বছর আগে শিকাগোর শ্রমিকরা যে দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছিলেন, তা আজো এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশের দারিদ্র্য পীড়িত শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির দাবি আদায়ে এখনো রাজপথে নামতে হয়, এখনো তারা মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। আমাদের দেশের গার্মেন্টস শ্রমিকের অবস্থা করুণ বলা যেতে পারে। প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিক গার্মেন্টস সেক্টবের কাজ করে থাকে। যাদের অধিকাংশ নারী শ্রমিক। তৈরি পোশাক শিল্প থেকে দেশের রপ্তানির প্রায় ৮১ ভাগ অর্জিত হয়। ২০১৩ সালে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৩ হাজার টাকা থেকে ৭৭ ভাগ বাড়িয়ে ৫ হাজার ৩শ টাকা নির্ধারণ করা হয় (সূত্র: জাতীয় সংসদ অধিবেশন ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪)। ন্যূনতম মজুরি অধিকাংশ গার্মেন্টস মালিক মানেন না। কাজ করতে গিয়ে অনেক শ্রমিক মৃত্যু বরণ করলেও তার ক্ষতিপূরণ পায় না। এছাড়াও সাভারের রানা প্লাজার কথা আমরা সবাই জানি। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১শ ৩৪ জন মারা যায়। এর মধ্যে ৮২২টি লাশ আত্মীয়-স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকি ৩২২ টি লাশের নমুনা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক বিভাগের ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে (এনএফডিপিএল) পাঠানো হয়। এছাড়াও অনেক শ্রমিক পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। অনেকে ধুকে ধুকে মরছে। এসব শ্রমিকদের খবর কেউ রাখে নি।
প্রবাসী শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হচ্ছে রেমিটেন্স যা বাংলাদেশে আর্থসামাজিক উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে প্রায় ১০০টি দেশে বাংলাদেশী প্রায় ৮৫ লাখ শ্রমিক কাজ করছে।যার মধ্যে ৫৩ লাখ এসএসসি পাশের নিচে শ্রমিক রয়েছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে বেশি শ্রমিক কাজ করে। ১৯৭৬ সাল থেকে তপুরুষ শ্রমিক রপ্তানি শুরু হলেও নারী শ্রমিক পাঠানো হয় ২০০৩ সালে। ফলে নারী ও পুরুষ উভয় শ্রমিক অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে জুন মাস পর্যন্ত ১হাজার ৪২২ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে। অথচ বিদেশী শ্রমিকদের অধিকার বিভিন্নভাবে খর্ব হয়ে থাকে। অনেক শ্রমিক মৃত্যু বরণ করলেও তার ক্ষতিপূরণ পান না।
চা-শ্রমিকদের অবস্থা ভাল নয় । চা বিদেশে রপ্তানি করার ক্ষেত্রে সিংহভাগই অবদান চা-শ্রমিকদের । অখচ তাদের শ্রমের মজুরি অতি নগণ্য। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা করাতে পারেন না অর্থাভাবে। এছাড়াও জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে কাজ করে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক । কাজটি খুব ঝুকিপূর্ণ কিন্তু শ্রম সস্তা। এ শিল্পের শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ২শ টাকার মধ্যে। এসব শ্রমিকদের ২০ শতাংশ শ্রমিক হচ্ছে শিশু শ্রমিক যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে। সরকার অনেক টাকা রাজস্ব পেয়ে থাকে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প থেকে। কারণ, গড়ে প্রতি বছর দেড় থেকে ২শ নষ্ট জাহাজ চট্টগ্রামে পড়ে থাকে। জাহাজ সমূহকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে শ্রমিকরা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকরা দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ হারালেও তেমন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না।
অথচ উন্নত দেশ গুলোতে এখন শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি কাজের পরিবেশও উন্নত হয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। কিন্তু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে শ্রমজীবীদের দুর্ভোগ কাটেনি। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর থেকেই জেনেভা কনভেনশনে স্বার করে শ্রমজীবী মানুষের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হলেও শ্রমিক শ্রেণির মানুষ তাদের ন্যায্য মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। অনেক বেসরকারি শিল্প-কারখানায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা নির্ধারিত শ্রমের সময় মানা হয় না । অনেক বেসরকারি কল-কারখানাতে বাধ্য করা হয় ওভার টাইম কাজ করার জন্য। শ্রমিক নির্যাতন করা হয় বিভিন্ন কায়দাতে। বেতন বাড়ার কথা বললেই মালিক পক্ষ চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিয়ে থাকে। বিভিন্ন অজুহাতে কারখানা বন্ধ রেখে শ্রমিকদের টেনশনে রাখার চেষ্টা করে।
এছাড়াও বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষকে কাজ দেওয়ার নাম করে ঠকানো হয়। বিশ্বায়নের উন্নতির ফলে আমাদের দেশেও অর্থনৈতিক গতিশীলতা বাড়লেও শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি সেভাবে ঘটেনি। আমাদের দেশের সম্ভাবনাময় খাত তৈরি পোশাকশিল্প ও ইমারত নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য উপযুক্ত কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা ও মৌলিক চাহিদা পূরণ করে ভালভাবে বাঁচার অধিকার প্রয়োজন। কৃষকশ্রমিক, গৃহশ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ট্রাকচালকসহ বিভিন্ন খাতের অসংখ্য শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষের শ্রমের স্বীকৃতি মেলেনি বললে ভুল হবে না। নারী ও শিশুশ্রমিকের অবস্থা আরো নাজুক। দেশের অধিকাংশ শিল্প খাতে ন্যূনতম মজুরির ব্যবস্থা নেই। যেসব শিল্পের শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত মজুরিকাঠামো ঘোষণা করা হয়নি, সেগুলোতে মজুরিকাঠামো ঘোষণা করা এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি। বিষয়টির প্রতি বর্তমান সরকার সুদৃষ্টি রাখবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক-
আজমাল হোসেন মামুন
সহকারী শিক্ষক, হরিমোহন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
ইমেইল নং- ধুসধষ২২@মসধরষ.পড়স
মোবাইল:০১৭০৪২৪৪০৮৯ ।