দক্ষিণ ইতালি, আইওনীয় সাগরতীরে বৃহত্তর গ্রিসের ক্রতোন নগর। পঞ্চম খ্রিষ্টপূর্বাব্দের শেষ ভাগ।
“আচ্ছা, অনেকে বলে ভ্রাতৃগোষ্ঠীর সদস্যরাই নাকি তাকে মেরে আইওনীয় সাগরে লাশ ফেলে দিয়েছে! গুরুদেব নিজেই নাকি নির্দেশ দিয়েছিলেন এ কাজে?” উদ্বিগ্নতা আর তীব্র কৌতূহলে মেয়েটি জানতে চায় ছেলেটির কাছে।
“হশ্ শ্…,” ঠোঁটে তর্জনী রেখে দ্রুত চারদিকে তাকায় যুবক। অস্তগামী সূর্যের ম্লান আলোয় ভরে গেছে গাঢ় সবুজ জলপাই অরণ্য, খেলা করছে বৃক্ষশাখা আর পত্রপল্লবের ছায়া। মাঝে মাঝে আইওনীয় সাগরের বুক থেকে ভেসে আসছে দমকা হাওয়া, তার তোড়ে জায়গা বদল করে আলো-ছায়া। না, কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
তবু এডোনিয়াকে সাবধান করে পন্টিয়াস, “আস্তে কথা বলো। কে কী শুনে ফেলে, বিপদে পড়ব আমরা!”
গলার স্বর নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলে এডোনিয়া, “কিন্তু এ ঘটনা কি সত্যি?”
“আরে না না, তা হবে কেন?” মেয়েটিকে আশ্বস্ত করার যথেষ্ট চেষ্টা করে পন্টিয়াস। “সাগরে উত্তাল ঝড় উঠেছিল সেদিন, আর সে দাঁড়িয়ে ছিল জাহাজের খোলা জায়গায়। প্রকাণ্ড এক ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাকে।”
“সে একা কেন দাঁড়াতে গেল খোলা জায়গায়?” বলে এডোনিয়া, সন্দেহ দূর হয় না তার। “আর বছরের সেই সময়টাতে ঝড়ের কথা শোনে না তো কখনো কেউ। দক্ষিণায়নের শান্ত, মাছরাঙা দিন চলছিল তখন।”
“এডো, গুরু কেন এরকম নিষ্ঠুর কাজের নির্দেশ দিবেন? সত্য অনুসন্ধানী মানুষ তিনি, কেবল সত্যেরই লেনদেন করেন। একটি সংখ্যার জন্য মানুষ খুন করাবেন তিনি, কেন?” পন্টিয়াসের গলার স্বর দৃঢ় হয়ে উঠে।
“কারণ গুরুর সারা জীবনের দর্শন আর শিক্ষার ভীত দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছিল সংখ্যটি। তিনি কঠোরভাবে চেয়েছিলেন তা গুপ্ত থাকুক, কিন্তু সে প্রকাশ করে দিয়েছে জনসমক্ষে।”
“আমি তা বিশ্বাস করি না, এডো। তুমি জানো তাঁর কাছে বিদ্যাশিক্ষার বিনিময়ে আমাকে প্রতিদিন তিন অবোলি করে দিতেন। এরকম অদ্ভুত শিক্ষক, যিনি পড়ানোর বিনিময়ে ছাত্রকেই পারিশ্রমিক দেন, আর একজন খুঁজে পাবে না তুমি। এ ধরণের মানুষ কখনো কাউকে হত্যা করতে পারেন না। তাঁকে ভালোভাবে জানি বলেই জন্মভূমি সামোস ছেড়ে তাঁর দর্শন শেখার জন্য, তাঁর একটু সাহচর্য লাভের জন্য ক্রতোনে এসেছি আমি,” দ্রুত বলতে থাকে পন্টিয়াস, একটু উষ্ণ তার গলা।
খানিক পর আর্দ্র হয় যুবকের কণ্ঠ,“অবশ্য তা না হলে তোমাকেও পাওয়া হতো না।” এডোনিয়ার কাঁধে হাত রেখে আলতো করে তার কপোল ঘষে দেয় সে। সোনালি অলকগুচ্ছ নড়ে উঠে মেয়েটির, ভূমধ্যসাগরের গাঢ় নীল জলরাশির মতো চোখ মেলে গভীর ভালোবাসা আর মায়ায় গণিতপাগল স্বামীর দিকে চেয়ে থাকে সে।
* * *
এক বছর আগের কথা।
চমৎকার উঁচু করে নির্মিত, মসৃণভাবে লেপে দেয়া সব দিকে, অর্ধবৃত্তাকার মাটির ঢিবি—সেমিসার্কেল। ব্যাস রেখা বরাবর তার ঝুলছে ভারী পর্দা। অর্ধবৃত্তের বক্র অংশের ধার ঘেঁষে ইতোমধ্যেই সমবেত হয়েছে অনেক তরুণ-তরুণী। ভ্রাতৃগোষ্ঠীর সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ শাখা, ম্যাথমেটিকোইর (mathematikoi) অন্তর্ভুক্ত তারা, অর্জন করেছে স্বচক্ষে গুরুকে দেখার ও তাঁর ভাষণ শোনার বিরল কৃতিত্ব। এর আগে তারা ছিল ভ্রাতৃগোষ্ঠীর আরেকটি শাখা, অ্যাকৌজমেটিকোইর (akousmatikoi ) সদস্য, পাঁচটি বছর তীব্র কৌতূহলে শুধু গুরুর ভাষণই শুনে গিয়েছিল, পর্দার আড়ালের মানুষটিকে দেখতে পায়নি কখনো, পারেনি তাঁকে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করতে, কারণ এর জন্য আগে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়।
অবশ্য গুরুর দর্শন লাভ করা, তাঁর নিকট বিদ্যাশিক্ষা করার জন্য পাঁচ বছর খুব অল্প সময়, ভাবে তারা। জীবন্ত কিংবদন্তি গুরু তাদের, সূর্যদেবের অবতার, মর্ত্যধামে ধারণ করে আছেন মানবদেহ। আর এ বিষয়টি সুস্পষ্ট প্রকাশিত হয়ে গেছে যখন অ্যাপোলোর সন্ন্যাসী অ্যাবারিস, যিনি জাতিতে ছিলেন শক (Scythian), যিনি বাস করতেন উত্তুরে হাওয়ার আরও উত্তরে তাঁর জন্মভূমি উদঞ্চ বা উদচদেশে (Hyperborea), যার ফলে তিনি পরিচিত ছিলেন উদীচী অ্যাবারিস নামে, সাক্ষাত করে গিয়েছিলেন গুরুর সঙ্গে। লোমহর্ষক সেই ঘটনাটি ছিল এরূপ—
উদঞ্চদেশে স্থাপিত অ্যাপোলোর মন্দিরের জন্য অর্ঘ্য হিসেবে স্বর্ণখণ্ড সংগ্রহ করতে সেই সময় গ্রিসের নগররাষ্ট্রসমূহ ভ্রমণ করছিলেন অ্যাবারিস। ফেরার পথে ক্রতোনে যাত্রাবিরতি করেন তিনি কারণ গুরুর নানাবিধ অলৌকিক কথাকাহিনি কর্ণগোচর হয়েছিল তাঁর। ক্রতোনে পৌঁছে গুরুর চারপাশে পরমপবিত্রসব সংসর্গ অবলোকন করে এবং পূর্ব থেকে যেসকল বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন সেসবের উপর ভিত্তি করে, বয়স্য অ্যাবারিস হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন নিমেষে, গুরু হচ্ছেন সাক্ষাত অ্যাপোলো, যার সন্ন্যাসী অ্যাবারিস নিজে। অর্ঘ্য হিসেবে অ্যাবারিস তখন গুরুকে নিবেদন করেন তাঁর পবিত্র সেই শর যা তিনি নিয়ে এসেছিলেন উদচদেশ থেকে, সুদীর্ঘ যাত্রাপথে প্রতিরক্ষা হিসেবে, যার উপর ভর দিয়ে অ্যাবারিস পাড়ি দিতেন নদী, হ্রদ, জলাভূমি কিংবা গিরি পর্বতের মতো অগম্য সকল এলাকা, যার দ্বারা সম্পন্ন করতেন তিনি আত্মার শুদ্ধিকরণ, বিতাড়িত করতেন নগর থেকে অশুভ বায়ু, মারী ও মড়ক।
আলোকসামান্য সেই উপহার গুরু গ্রহণ করেন অপরিসীম নির্লিপ্ততায়, শরের অভিনব গুণাবলিতে একবিন্দু বিস্ময় প্রকাশ না করে, উপহার প্রদানের কারণ বিষয়ে ধূলিকণা পরিমাণ কৌতূহল প্রদর্শন না করে, কারণ তিনি তো প্রকৃতই দেবতা। কেবল অ্যাবারিসকে আড়ালে আহ্বান করে নিজের পায়ের কাপড় উত্তোলন করে গুরু প্রদর্শন করেছিলেন তাঁর অলৌকিক ঐন্দ্রজালিক স্বর্ণ উরু, যা নিয়েই তিনি লাভ করেছিলেন মানবজন্ম। অবশ্য অ্যাবারিস ব্যতীত সাধারণ মানুষও পরবর্তীতে গুরুর স্বর্ণ উরু দেখার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেছিল একবার, যখন একদা সবাই ব্যস্ত ছিল অলিম্পিক উদযাপনে আর তখন ভূমি থেকে গাত্রোত্থান করার সময় গুরুর উরু প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল ক্ষণিকের তরে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কিংবা সাধারণ মানুষের পক্ষে শোভন নয় অন্য কাউকে নিজের উরু প্রদর্শন করা, তবে উপরিউক্ত ঘটনা দুটি ছিল অ্যাবারিস ও সাধারণ মানুষের প্রতি নিছক দৈব অনুগ্রহ।
সময় হয়েছে গুরুর আগমন ক্ষণের। গভীর উদ্দীপনায় অপেক্ষা করছে ম্যাথমেটিকোইর সদস্যগণ। এভাবেই অপেক্ষা করে আসছে জ্যেষ্ঠ দলটি দিনের পর দিন, আজ যোগ হয়েছে নতুন অধীয়ান দল। আজকে কী নিয়ে কথা বলবেন গুরু, ভাবতে থাকে তারা, আর পরিকল্পনা করে নতুন উদ্ভাবন বা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে কীভাবে নিজেদের যোগ্যতা মেলে ধরবে।
বাজনা বেজে উঠে অর্ধবৃত্তের অভ্যন্তরে, ভেসে আসে জনপ্রিয় গ্রিসীয় সংগীত, পর্দা সরে যায় দুপাশে। শুভ্র আলখাল্লা পরিহিত, পায়ে সোনালি পাদুকা, মস্তকে উষ্ণীষ, তার উপরে গ্রিসীয় ফুলের মুকুট, জলপাই কিশলয় গোঁজা তাতে, রাজকীয় মহিমায় ধীরে ধীরে প্রবেশ করেন সৌম্য চেহারা মানুষটি —পিথাগোরাস, সেমিসার্কেলের গুরু, ভ্রাতৃগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শনের প্রচারক।
“কেমন আছ তোমরা, হে অভিমন্ত্রিত সত্যব্রতগণ?” দুই হাত প্রসারিত করে হাস্যপ্রোজ্জ্বল মুখে জানতে চান পিথাগোরাস।
“চমৎকার, হে মহান গুরুদেব!” সমস্বরে বলে সবাই।
“তোমরা হচ্ছ নির্বাচিতগণ,” শান্ত কণ্ঠে বলেন পিথাগোরাস। “তোমরা পরিহার করবে সব রকমের উগ্রবাদিতা। সর্বোত প্রচেষ্টায় তোমাদেরকে অপসারণ করতে হবে, ছিন্ন করতে হবে অগ্নি ও তরবারির মাধ্যমে এবং আরও নানাবিধ উপায়ে, দেহ থেকে অসুস্থতা, আত্মা থেকে অজ্ঞানতা, উদর থেকে ভোগবিলাস, নগরী থেকে অরাজকতা, পরিবার থেকে বিভেদ এবং সকল ক্ষেত্রে বাহুল্য।”
“জ্বি, গুরুদেব।” সবার হৃদয়ে গেঁথে থাকে বাণীটি।
“আমার সঙ্গে শপথ গ্রহণ করো তোমরা,” পিথাগোরাস বলেন। “বলো সকলে, আমরা অতিক্রম করব না তুলাদণ্ড, টুকরো করব না মুকুট, ভক্ষণ করব না হৃদয়, তরবারি দিয়ে উসকে দেব না অগ্নি, সীমান্তে পৌঁছে দৃষ্টি নিক্ষেপ করব না পশ্চাতে, আসনে ছিটাব না তৈল, অঙ্গুরিতে পরিধান করব না স্রষ্টার প্রতিরূপ, ভস্মের মধ্যে রেখে দেব না ভাণ্ডের চিহ্ন, মশাল স্থাপন করব না দেয়ালে, শয়ন করব না সমাধিস্থানে, স্বেদকে মুছব না তরবারি দ্বারা, ভক্ষণ করব না শিম, স্পর্শ করব না শুভ্র মোরগ, লালন করব না বক্র নখরের প্রাণী, কর্তন করব না কাষ্ঠ জনসাধারণের পথে, সর্বদা টেবিলে রাখব লবণ, উত্তোলন করব না টেবিল থেকে পতিত দ্রব্য, ভালোবাসব প্রতিধ্বনি যখন বায়ু বয়, …”
দীর্ঘ শপথ পাঠ শেষ হলে পিথাগোরাসের নেতৃত্বে ভ্রাতৃগোষ্ঠীর সদস্যগণ মেতে উঠে জ্ঞানবিজ্ঞানের আলোচনায়, নিয়ন্ত্রিত বিতর্কে, প্রশ্নোত্তরে। কেটে যায় বেশ কয়েক ঘণ্টা, শেষ হয় প্রথম পর্বের আলোচনা।
অপরাহ্নে অদ্রিয়াতিক সাগর থেকে উঠে আসা বর্ষবায়ু যখন বয়ে যাচ্ছিল আইওনিয়ার উপর, দলটি আবার সমবেত হয়। এবার আলোচনার বিষয়বস্তু অতীন্দ্রিয়শাস্ত্র।
“আপনার জীবনের কথা বলে আমাদের সম্মানিত করুন, হে গুরুদেব,” লুকানিয়া থেকে আগত মেয়েটি, ইসারা তার নাম, উঠে দাঁড়িয়ে অনুরোধ করে। তীব্র কৌতূহলে নড়েচড়ে বসে সবাই।
“জ্বি, গুরুদেব, বলুন অনুগ্রহ করে,” বাকিরা সমস্বরে সায় দেয় প্রস্তাবে।
স্মিত হাস্যে আলখেল্লাটি ঠিক করে নেন পিথাগোরাস। মনে তাঁর ভীড় করে কত না দৃশ্য—নদী, দরিয়া আর পথের অন্তহীন বয়ে চলা, নগর ও বন্দরসমূহের শানশওকত, উত্থান পতন, নানা জাতির মানুষ, দেহ ও মনে তাদের হরেক রঙের খেলা। স্মৃতিতে সমাহিত হয়ে যান দার্শনিক কয়েক মুহূর্তের জন্য।
[এক দশক পূর্বে লিখিত একটি ধারাবাহিকের বিশদ বিস্তৃতিকরণ, সম্পাদনা ও পরিমার্জনা]
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০২০ দুপুর ১:৩৮