পৃথিবীর গতির ব্যাপারে প্রাচীনকালে চিন্তাবিদদের মধ্যকার মূলধারার মতটি ছিল পৃথিবী অনড়, কারণ পৃথিবী যদি আবর্তিত হতো, তার অনেক প্রভাব পরিলক্ষিত হতো। যেমন, উপরের দিকে একটি ঢিল ছুঁড়লে, সেটি আবার নিক্ষেপের স্থানেই পতিত না হয়ে বরং একটু পেছনে পড়ত কারণ ততক্ষণে পৃথিবী এগিয়ে যেত সামনে, সারাবছরই বিরামহীনভাবে বায়ু প্রবাহিত হতো আর তা ধাক্কা দিত মানুষের গায়ে, ইত্যাদি।
পূর্বসূরিদের গবেষণাকর্মে প্রভাবান্বিত হয়ে সপ্তদশ শতকে গ্যালিলিও যুক্তি প্রদর্শন করলেন যে, আমরা অনুভব করতে না পারলেও পৃথিবীর পক্ষে গতিময় হওয়া সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, নিস্তরঙ্গ সাগরে সুষমগতিতে চলমান কোনো জাহাজের কেবিনে একজন মানুষকে যদি আবদ্ধ করে রাখা হয়, তার পক্ষে নিশ্চিত বলা সম্ভব হবে না, জাহাজটি কি চলমান না স্থির দাঁড়িয়ে। কেবিনের ভেতর লোকটির সঙ্গে যদি কিছু পাখি, প্রজাপতি প্রভৃতি থাকে, সেগুলো স্বাভাবিকভাবেই উড়তে থাকবে, কেবিনের দেয়ালে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে না। অর্থাৎ সমগতিতে চলমান কোনো সিস্টেমের ভেতরে যান্ত্রিক কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কখনো নির্ণয় করা যাবে না সিস্টেমটি চলমান নাকি স্থির। সকল গতিই আপেক্ষিক।
এর অনতিকাল পর নিউটন প্রকাশ করলেন তাঁর বিখ্যাত গতিসূত্র । আলোর উপরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করলেন নিউটন। তিনি ভাবলেন, আলো অত্যন্ত ক্ষুদ্র কণিকার (corpuscle) সমন্বয়ে গঠিত পদার্থ এবং এসব কণা তথা আলোর কতিপয় ধর্ম (যেমন, প্রতিফলন) তিনি তাঁর গতিসূত্রের মাধ্যমে সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হলেন; আর আলোর যে ধর্মগুলো তিনি ব্যাখ্যা করতে পারলেন না, সেগুলো নিয়ে অস্বস্তি অনুভব করতে থাকলেন। অন্যদিকে হাইগেনস ভাবলেন, আলো হচ্ছে তরঙ্গ এবং এর উপর ভিত্তি করে তিনিও আলোর কিছু ধর্ম ব্যাখ্যা করলেন। আলোর প্রকৃতির ব্যাপারে বিজ্ঞানসমাজ মোটামুটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল: ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ বনাম মহাদেশীয় ইউরোপ।
ইয়ং তাঁর দ্বি-চির পরীক্ষার (double-slit experiment) মাধ্যমে যখন দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রদর্শন করলেন যে আলো হচ্ছে তরঙ্গ, নিউটনের কণাতত্ত্ব ধীরে ধীরে তার আবেদন হারিয়ে ফেলল। আলো হচ্ছে তরঙ্গ যা ইথার (æther) নামক এক মাধ্যমের ভেতর দিয়ে চলাচল করে, পরবর্তী ১০০ বছর ধরে আলোর ব্যাপারে এই ছিল মূলধারার মতামত।
ইতোমধ্যে কুলম্ব, ওয়েরস্টেড, গাউস, অ্যাম্পিয়ার, বায়ো, সেভার্ট, ফ্যারাডে এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের তড়িৎ ও চুম্বকের উপর সম্পন্নকৃত গবেষণাকর্মের ফলাফলকে বিধিবদ্ধ করলেন ম্যাক্সওয়েল, একগুচ্ছ সমীকরণের মাধ্যমে। সমীকরণগুলো সমাধান করে এবং ওয়েবার ও কোলরাউশের উপাত্তের উপর ভিত্তি করে, ম্যাক্সওয়েল তাত্ত্বিকভাবে তড়িত-চৌম্বকীয় তরঙ্গের (electromagnetic wave) গতিবেগ হিসাব করতে সক্ষম হলেন, এদের অনুমিত মাধ্যম ইথারের সাপেক্ষে। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, তড়িত-চৌম্বকীয় তরঙ্গের তত্ত্বীয় গতিবেগ এবং ফিজো ও ফুকোর পরীক্ষণে প্রাপ্ত আলোর গতিবেগ বিস্ময়কর ভাবে কাছাকাছি মানের। সুতরাং তিনি ভাবলেন আলো (light) একটি তড়িত-চৌম্বকীয় তরঙ্গ।
এ পর্যায়ে বিজ্ঞানের ইতিহাস যেন খানিকটা টানটান হয়ে উঠল। আলোর গতিবেগ, ধরা যাক c, যদি ইথারের সাপেক্ষে নিরূপিত হয়ে থাকে, তাহলে ইথার কোথায়? আলো তো মানুষের চোখেও প্রবেশে করে, তাহলে মানুষের চোখেও কি রয়েছে ইথার? অন্যদিকে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ এবং লরেঞ্জের বলের সূত্র (Lorentz force law) দুয়ে মিলে ইঙ্গিত দিচ্ছে, যান্ত্রিক পরীক্ষণে সম্ভব না হলেও তড়িত-চৌম্বকীয় পরীক্ষণে নির্ণয় করা সম্ভব হবে, কোনো সিস্টেম চলমান না গতিশীল। উদাহরণস্বরূপ, তুমি যদি এক চিলতে আলো নিক্ষেপ করো সামনের দিকে—একবার কোনো রেলস্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে, আরেকবার কোনো রেলগাড়ির ভেতর থেকে— আলোর গতি দুরকম পাওয়ার কথা দুই ক্ষেত্রে, কারণ c হচ্ছে ইথারের সাপেক্ষে আর স্থির প্লাটফর্ম ও গতিশীল রেলগাড়ির আপেক্ষিক গতিবেগ ইথারের সাপেক্ষে অবশ্যই দুরকম হবে।
কিন্তু সমস্যা বাধল আলোর বিশাল গতিবেগ নিয়ে। এত বড় গতিবেগ সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করার যন্ত্রপাতি কীভাবে বিনির্মাণ করা যায়? অনেক প্রচেষ্টার পর মাইকেলসন এবং মর্লি অভিনব একটি পরীক্ষা করলেন: একটি উৎস থেকে নির্গত আলোকে তাঁরা আয়নার মাধ্যমে দুই ভাগ করলেন এবং দুই অংশকে পরস্পর লম্ব কিন্তু দৈর্ঘ্যে সমান এমন দুই পথে প্রেরণ করলেন, তারপর সেগুলোকে আবার প্রতিফলিত করে ফিরিয়ে নিয়ে এসে একটি ডিটেক্টরের একই বিন্দুতে ফেললেন।
এখন পৃথিবী যদি ইথারের ভেতর ভাসতে ভাসতে গতিময় হয়ে থাকে, তাহলে যন্ত্রটির দুই অংশে আলোর গতিবেগ হবে ভিন্ন ভিন্ন—ঠিক যেমন একজন সাঁতারু যখন নদীর তীর বরাবর সাঁতার কাটে, তার লব্ধিবেগ হয় একরকম, আবার যখন নদীর আড়াআড়ি সাঁতার কাটে, তখন লব্ধিবেগ হয় অন্যরকম। কিন্তু মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষায় আলোর দুই অংশের মধ্যে কোনো ব্যতিচারগত পার্থক্য (fringe shift) ধরা পড়লো না, পরীক্ষণের ভুলের সীমারেখায় যতটুকু পার্থক্য থাকতে পারে সেটুকু ছাড়া। এর মানে হচ্ছে দু্ই পথের আলোক তরঙ্গে, চূড়ার সঙ্গে চূড়া, খাদের সঙ্গে খাদ, বা অন্য সমতুল্য অংশ একই সঙ্গে এসে মিলছে ডিটেক্টরের পর্দায়। হয় পৃথিবী স্থির, না হয় তাঁদের পরীক্ষণটি ভুল ও ব্যর্থ।
কিন্তু পৃথিবী তো ঘুরছে! পরীক্ষণ ব্যর্থ নয়, এটি ধরে নিয়ে বেশ কিছু বিজ্ঞানী সম্ভাব্য হাইপোথেসিস', ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রদান করা শুরু করলেন। উদাহরণস্বরূপ, ফিটজেরাল্ড ও লরেঞ্জ বললেন, যন্ত্রের যে অংশটি পৃথিবীর গতিপথ বরাবর ছিল, সেদিকের অংশটুকু অপর অংশের তুলনায় সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল, এমন পরিমাপে যে দুই অংশে আলোর লব্ধি গতিবেগ ভিন্ন হলেও পথের ভিন্নতার কারণে সময় লেগেছে সমান সমান। সমগতীয় একটি সিস্টেম থেকে আরেকটি সমগতীয় সিস্টেমে কীভাবে সময়, দৈর্ঘ্য এসব রাশি রূপান্তর করা যায়, এর উপর লরেঞ্জ ও অন্যরা সমীকরণ প্রণয়ন করলেন।
মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষণের অনুরূপ আরও বহু পরীক্ষা সম্পন্ন হয় পরবর্তিতে, ইথারের ভেতর দিয়ে পৃথিবীর গতিবেগ শনাক্ত করতে। এদের অধিকাংশ ব্যর্থ হয় অভীষ্ট গতি শনাক্ত করতে। এদের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে গ্যালিলিওর নীতিটিকে ১৯০৪ সালে পয়েনকার বর্ধিত করলেন এভাবে: "সমগতিতে চলমান কোনো সিস্টেমের ভেতরে তড়িত-চৌম্বকীয়সহ কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কখনো নির্ণয় করা যাবে না সিস্টেমটি চলমান নাকি স্থির"। রূপান্তরকারী সমীকরণগুলোকে তিনি সংশোধিত ও বিধিবদ্ধ করেন এবং এদেরকে অভিহিত করেন, লরেঞ্জ রূপান্তর (Lorentz transformations) বলে, যা বর্তমানে বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের (Special Theory of Relativity) হৃৎপিণ্ডস্বরূপ।
লরেঞ্জ-পয়েনকারের সমীকরণ এবং মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষণের উপর ভিত্তি করে ১৯০৫ সালে আবার সমীকরণগুলো প্রতিপাদন করেন আইনস্টাইন, আলোর গতি ধ্রুবক ধরে নিয়ে। তাঁর গবেষণাপত্রটিতে বেশ কিছু ধারণাগত ও হিসাবগত ভুল ছিল, ফলে আইনস্টাইন পরবর্তী বছরগুলোতে আরও কয়েকবার বিশেষ আপেক্ষিকতার উপর তাঁর কাজগুলো সম্পাদনা করেন, যদিও তাঁর প্রতিপাদন কখনোই পুরোপুরি সঠিক হয়ে উঠেনি। এভাবে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার উপর বিশেষ আপেক্ষিকতা ধীরে ধীরে পূর্ণতা (?) লাভ করে।
এই হচ্ছে বিশেষ আপেক্ষিকতার সরল ও সংক্ষেপিত ইতিহাস।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০২০ রাত ১০:২৪