জন্মের মিনিট কয়েক পরই পিট পিট করে অনেকক্ষণ আম্মার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তার শ্যামলা গালের মধ্যখানে একটা বিশাল সাইজের শ্যামলা গোল তিল দেখে হেসেছিলাম খানিক খিক খিক করে। আম্মা তা দেখে রাজ্যের খুশি হয়ে আমায় কোলে তুলে নেয়। কি নিরাপদ আমি! কি মিষ্টি গন্ধ তার শরীরে। কিছুটা লেবু পাতার মতো গন্ধ৷
মায়ের কোলে প্রসাব, পায়খানা করতে করতে আর তার হাসিমুখ দেখতে দেখতে কবে যে দাঁড়ি-মোচ ওয়ালা এক পরিপূর্ণ যুবক হয়ে উঠলাম বুঝতেই পারলাম না৷ বুড়ো থনথনে হয়ে গেলেও মায়ের কাছে সন্তান আজীবন শিশু হয়ে থাকে।
পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করলাম নিজের পছন্দের অনামিশাকে৷ বাবা-মা হাসিমুখে তা মেয়ে নেয়। চাকরির জন্য আব্বা-আম্মাকে রেখে পাড়ি জমাই আমি আর অনামিশা টাকাওয়ালা এক দেশে। তার বছর দুয়েক পরই আব্বা মারা যায়। সাধের মানুষটাকে শেষ দেখা দেখতে পারিনা। মা হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ এক মানুষ। সবকিছু থেকেও যাদের নেই তারাই বুঝতে পারে কষ্টের কষ্টখানি কতটা ভয়ংকর আর খারাপ।
অনামীশার আপত্তিতে মাকে রেখে আসি ভালো মানের এক বৃদ্ধাশ্রমে। আম্মা তারপরও সেদিন হাসিমুখে আমায় বিদায় দিয়েছিলো৷ খুব যখন ছোট ছিলাম, তখন মা সদ্য স্নান শেষে বের হবার পরই তার কোলে উঠে প্রসাব,পায়খানা করে দিতাম। আম্মা হাসি মুখে আবার আমার কপালে চুমু দিয়ে গোসল করে আসতো।
সত্যি কথা বলতে অনামীশাকে আমি ভয় পাই। আম্মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যাবার পর আর খবর নেবার কথা বলা হয়নি সাহস করে তাকে। সেও একা একা থাকতে পেরে রাজ্যের খুশি। বুড়ো মানুষটা থাকলে হয়তো তাকে নিয়ম করে ওষুধ খাওয়াতে হতো, গোসল করাতে হতো। এখন এসবের আর ভয় নাই তার। আমাকে আর তার পরিবার নিয়ে সে ভালই আছে।
এক রাতে প্রচন্ড জ্বর আসে আমার। অনামীশা অফিস শেষ করে এসে সে তার মত শুয়ে আছে একপাশে। এই সময়টাতে আম্মাকে খুব মনে পড়ছে। সে থাকলে তার আদরে পুটলিটার জ্বর মাথায় হাত দিয়ে কত রকম গল্প আর দোয়া পড়ে আমাকে ঘুমিয়ে দেবার চেষ্টা করতো। সারারাত পাশে বসে থাকতো জেগে। মাথায় পানি ঢেলে দিতো। আজ একা একা কি করছে সে কে জানে! হয়তো মিছেমিছি বৃদ্ধাশ্রমের পাশে থাকা বড় বুড়ো বড়ই গাছকে ছেলে বানিয়ে কথা বলছে! জিজ্ঞেস করছে হাসিমুখে, কেমন আছিস কাইকর? আর আমি দাদি হবো কবে রে?
পরদিন অফডেতে অনামীশা আর আমি বাহিরে বেড়াতে আসি। লেবু, গোলাপের ফ্লেবারওয়ালা পারফিউম কিনি দুটো। হঠাৎ মুঠোফোনে কল আসে। আমার হাসিমুখের আম্মা বৃদ্ধাশ্রমে সেদিন বেঁচেছিলোনা। সবকিছু ম্যানেজ করে দেশে ফিরে আমার নিথর আম্মাকে আর পাইনা।
রাতে গাজীপুরের এক গোরস্থান থেকে বেরিয়ে এসে একা একা কিছুটা সময় রাস্তায় হাঁটছিলাম। আকাশটা কালো মেঘে ঢাকা৷ আমার দু'চোখের দু' কোণায় দু'ফোটা জল। কষ্টের জল। আমার কষ্টের কষ্টখানি আকাশের মেঘটা বুঝতে পেরে পৃথিবীর বুকে ঝরতে শুরু করে। ঝিরঝির কান্নামাখা মেঘ-বৃষ্টির মাঝে একটা কথা মনে পড়ছিলো খুব। বিদেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের লেবু,গোলাপ ফ্লেভারওয়ালা পারফিউমে আম্মার সেই গায়ের গন্ধটা নাই।
আম্মা,
আমি ভুল বুঝে ফিরে এলাম, আর তুমি ভুল বুঝে চলে গেলে?
~ আব্দুল্লাহ আল মামুন(কাইকর)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৪৫