অমন কথা কইয়েন না মহাজন। আপনার দুইডা পায়ে পরি। আমার পেটে লাথি মাইরেন না। নাজমার মা কইছে, ঢাকা থাইক্যা ফেরত আইসা আপনার হগল পাওনা মিটাইয়া দিবো। মহাজন আমার কান্নাকাটি দেইখ্যা মুখগালি দিয়া কইলো, ফকিরের জাত বেজ্জমা এইবারের মতো মাফ কইরা দিলাম। যা এইহান থাইক্যা।
আমার বউয়ের নাম কুলসুম। গ্রামের মানুষ সুন্দরী কুলসুম কইয়া ডাহে। গ্রামের হগল মাইনষের চোখ ফাকি দিয়া বিয়া করছিলাম কুলসুমরে। আমারে খুউব ভালাবাসে কুলসুম। পুটি মাছ দিয়া তরকারি রান্না কইরা গরম ভাতের লগে মিশাইয়া খাওয়াই দিতো আমারে।
আমার বউ আর আমি মিলামিশা সুন্দর কইরা ঘর-সংসার সাজাইছিলাম। আমি নদীতে নৌকা চালাইয়া মাছ ধইরা নিয়া আইতাম আর কুলসুম তা সুন্দর কইরা মাটির চুলায় আগুন জালাইয়া মাটির পাতিলে ঝোল বেশী দিয়া রান্না কইরা রাইখতো। আমি সারারাইত নদীতে ইট্টু ইট্টু হারিকেনের আগুন জালাইয়া মাছ মারতাম। শেষ রাইতে মাজায় গামছা কইষা বাইন্দা ধান ক্ষেতের আয়েল দিয়া হাইটা হাইটা বাড়ীতে আইতাম। কুলসুম আমার লাইগা কাপড়ের আচল বিছাইয়া বইয়া থাকতো উঠানের মইধ্যে। আমি তারাতাড়ি কইরা তারে গিয়া জড়াই ধরতাম। সে মুখবাকা কইরা কইতো, আমার আর ভালা লাগেনা একা একা সারারাত বইয়া থাকতে। আমি তার রাগকপালে চুমা দিয়া হাইসা কইতাম, তাইলে ঘরের মইধ্যে আরেকটা মানুষ আনুনের ব্যবস্থা করতে হইবো। সে লজ্জা পাইয়া কইতো, নিষ্টুর জানি কোনহানকার। আমাগো মাইয়া হইলে তোমার লাইগা আর বইয়া থাকুম না দেইখো। আমি হাইসা হাইসা কইতাম, আইছ্যা বউ। তারপর দুইজন মিলামিশা মাঠির মইধ্যে বইসা চাকুম চাকুম কইরা সাদা ভাতের লগে বেশী কইরা ঝোল মিশাইয়া খাইতাম।
তারপর একদিন ছোট ঘরের ছোট সংসারে ছোট্ট একটা সাদা ফুটফুটা চাঁদের লাহান মাইয়া আল্লাহ দান করে। কুলসুম খুশি হইয়া মাইয়াডার নাম রাখছিল নাজমা। আমি খুশিমনে কান্না করছিলাম খুব সেদিন।
আমার মাইয়াডা ছোট ঘরের মইধ্যে বড় হইতে শুরু করে। দুই বছরের মাথায় কি জানি নাম কয় শহরের বড় বড় ডাক্তার "ম্যাল্যারিয়া"ওই রোগ মাইয়ার ধরা পরে। একদিন শেষ রাইতে নদী থাইক্যা মাছ মাইরা আনুনের পর দেখি কুলসুম উঠানের মইধ্যে আচল বিছাইয়া বইসা রইছে। তার চোহে ছিল জল। আমি তার চোহের জল মুইছা দিতে গেলেই কুলসুম জড়ায় ধইরা আমারে হাউমাউ কইরা কান্না শুরু কইরা দেয়। আমাগো ছোট ঘরের বড় মাইয়াডা সেদিন বাইচা ছিলোনা।
নদী থাইক্যা মাছ মাইরা যে টাকা কামাইতাম তা দিয়া সাদা মোটা চালের লগে কিছুমিছু তরকারি পাওয়া যাইতো। কিন্তু যন্ত কইরা মাটির ছোট ব্যাংকে আর টাকা রাখুন যাইতো না। গ্রামের জমিদারের কাছ থাইক্যা সামাইন্য কিছু টাকা হাওলাত কইরা মাইয়াডার কবর জিয়ারত করছিলাম। তার তিনমাস পরই আমারে সবুজ ধান ক্ষেতের মধ্যে থাইকা সবুজ একটা সাপ কামুড় দেয়। কবিরাজ- ডাক্তার খুব চেষ্টা চালাইয়া আমারে বাচাইতে পারলেও আমার এক পা আর এক হাত বাচাইতে পারে নাই। এহন আমি অভিশাপের জীবন ঘরে বইসা পার করি। পাশের বাড়ীর এক দিদি আমারে নিজের ভাইয়ের মতোন কইরা এহন পালে।
আমার চিকিৎসাকালে আরো মোটা টাকা জমিদারের কাছ থাইক্যা কুলসুম কান্নাকাটি কইরা ধার নেয়। সেই টাকা এহনো শোধ করবার পারি নাই। জমিদার চাচায় সেই টাকার ভয় দেখাইয়া আমাগো থাকুনের শেষশম্বল বাড়ীটুকুন নিজের নামে লেইখা নিতে চায়।
তারপর কুলসুম গ্রামের এক চাচার হাত ধইরা ঢাকা গিয়া বড়লোক বাড়ীতে কাম নেয়। মাস শেষে সামান্য কিছু টাকা পাঠায়। তা দিয়া কোনরহম টাইনাটুইনা চলি।
সেদিন কুলসুম ছোট ফোনে কল দিয়া বড় কইরা কইলো, ঢাকা থাইক্যা ফেরত আইসা জমিদার চাচার সব টাকা শোধ কইরা দিয়া আমারে ঢাকা নিয়া যাইবো। কুলসুমের আশা দেহানো কথা শুইনা আল্লাহরে মনে মনে বড় কইরা কই, আমারে বড় ঢাকাতে নিয়া যাও আল্লাহ। যেই ঢাকাতে আমার মাইয়া সুখে শান্তিতে ঘুমাইতাছে ওই ঢাকাতে যাইবার চাই। আল্লাহ তুমি আমারে নিয়া যাও।
~ আব্দুল্লাহ আল মামুন(কাইকর)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:২৭