অ্যাডভেঞ্চার “এক্সিম রিটার্ন” (০২)
এবার আমরা শুকনাছড়ি পাহারে উঠলাম। ডিঙ্গি খাড়া একটা পথ বেয়ে। সাপের মতো এঁকেবেঁকে ওঠা পথটার গায়ের উর্বসী গন্ধ এখনো নাকে লেগে আছে। রাত্রী নেমে আসলে আমরা শূকনাছড়িতেই রাত্রীযাপনের সিদ্ধান্ত নিলাম।
রাতে নতুন যুদ্ধ শুরু হবে। তাবু ফেলা হলো। মূর্হুতেই চুলা বানিয়ে নিলাম। বনমোরগ রান্না হবে। পাহারের শুকনো কাঠে দগদগে আগুনের লেলিহান শিখা সত্যিই দেখার মতো! শেখ রাজীবের অসাধারণ দক্ষতায় রাতের বেলা তোলা ছবি গুলো দেখলে বোঝার উপায় নেই এগুলো রাতের; অবিকল স্পষ্ট দিনের আলো। মুগ্ধ উন্মাদনা ছাড়িয়ে আমরা দলবেঁধে ছবি উঠালাম। রান্নার, খাবার, আড্ডার ছবি, আমরা যেন এক একটা ফ্রেম হয়ে যাচ্ছিলাম। এ এক অবিস্নণীয় অভিঙ্গতা।
বলা বাহুল্য, পুরো জঙ্গলবাড়ি জুড়ে রোমিওর আনন্দদান এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো। আড্ডায়-গানে প্রাণপ্রাচুর্য্যে যেন এক অন্যতম মহত্তম কবি প্রতিভায় উদ্ভাসিত। বেশভূষনে ছাড়িয়ে যায় সমকালীন সকল ফ্যাশন-স্ট্যাইল।
সমস্ত দিনের শেষে যখন আকাশের কপোলে গোঁধুলীর রেশ, পাহারের বুকে শুভ্র সাদা মেঘ; আমরা তখন রঙ্গীন তাবু ফেলে বিমুগ্ধ দর্শক। নিরন্তর প্রকৃতির অকৃত্রিম লীলা, আবেগের মাত্রাজ্ঞান ভুলিয়ে দিয়েছিলো সকল বৈষয়িক ব্যবধান। আস্বাদিত প্রকৃতির রুপে আমরা তখন প্রকৃতিরই সন্তান। প্রকৃতির বুকে, প্রকৃতির মাঝে এ এক চিরন্তন সুখানুভূতি। মাঝে-মাঝে দুরের পাহার গুলিকে মনে হতো এই বুঝি আকাশে সীমাবদ্ধতার সীমারেখা টেনে দিল। পরক্ষনেই তুষার ঝড়ের মতো কোমল মেঘরাশি পাহারকে জড়িয়ে রাখতো পরম মমতায়। এই অনুভূতি শুধুই বিমূর্ত নয়, চিরকালীন বিষন্নতা হয়ে ভেঙ্গে দিচ্ছিল সার্বজনীন তাচ্ছিল্য। আমরা ভাসছিলাম পাহারের কোলে, শুভ্র মেঘে-মেঘে। আর দোলনার মতো দুলে-দুলে বাঁশের চোঙ্গে চা পরিবেশন করছিলো আমাদের একমাত্র মেয়ে ক্যাম্পার তাহমিনা। মধ্যরাতের আকাশের সাদাবুক জুড়ে তারাগুলি নিরন্তর আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল, সেইসঙ্গে ঝিড়িখালের রিনিঝিড়ি কলোবরে এক ধ্রপদি পরিবেশ; যে কেউ হারিয়ে যেতে চাইবে নি:সন্দেহে।
পাহারে মজার ব্যাপার হলো সকাল হবার আগেই সূয্যের আলো ফোঁটে। চর্তুদিকে কুয়াশার চাদরের মতো মেঘগুলি দূর থেকে দেখলে মনে হয় সাদা কাঁশফুলের বন্যা।
আমাদের এবারের গন্তব্য রাইচন্দ্রপাড়া ঝর্ণা। তার আগে আমরা পৌঁছাবো শুকনাছড়ি থেকে পশ্চিমে, দেবতার পাহারে। ভয়ংকর সব গিরিপথ পেরুবার জন্য অদম্য মনোবল আমাদের নিত্যসঙ্গী। সারবেধেঁ প্রস্থান করবার সময় বিদায় জানালাম শুকনাছড়ি পাহারের হেডম্যানকে। সামান্য দূরে কৌতুহল ভরা পাহারী বাচ্চাদের উতসুক চোখগুলি জ্বলজ্বল করছে। কেউবা সনে বাঁধা ঘরের ঝাপ খুলে দাঁড়িয়ে আছে। হযতোবা অদূরে-আড়ালে কোন ললনাও সলজ্জভাবে নজর রাখছে আমাদের প্রস্থানে। মায়াভরা এ অপরুপ নৈস্বর্গিক স্থান থেকে হেঁটে চলেছি দেবতার পাহারের দিকে। প্রথমে প্রায় ৫০০ ফিট নিচুতে নামলাম আমরা। আরো একটা ছোট পাহার পাড়ী দিলাম। সরু-চিকন এ পাহারী ঢালুপথটা বৃষ্টিতে স্যাঁতসেথে হয়ে খানিকটা পিচ্ছিল হয়ে আছে যা বিপদের জন্য যথেষ্ট। কেননা কোনভাবে পিছলে পড়লে যদি উঠা সম্ভব হয় তাহলে বুঝতে হবে দ্বীতিয় জীবন পেলাম। সর্ন্তপনে এগুলাম আমরা। সামনে দলপতি হাকদিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে সতর্ক হুশিয়ারি। প্রতিধ্বনি হয়ে বারবার ফিরে আসছে আমাদের কানে।
দেবতার পাহার নিয়ে ছড়িয়ে আছে নানা রকম গল্প-কাহিনী। অন্যান্য পাহারের তুলনায় এ পাহারের বিশেষত: এ অঞ্চলের পাহারীরা অপেক্ষাকৃত দূর্বিসহ জীবন যাপন করতো।
দেবতার পাহারের আকার ব্যাপ্তি বা আকৃতি নানা কারনেই ঐতিহাসিক পটভূমিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। এই পাহারগুলি কত হাজার বছর আগের বা কতটা পুরানো জানা নেই কারোরই। প্রতিটি বিশাল আকৃতির কালশিটে পাহারের গায়ে কয়েক পরতের জমানো শ্যাওলা দেখে গা ছমছম করে উঠে। এইসব পাথর-পাথুরে পাহারের আনাচে কানাচে ছড়িযে ছিটিয়ে আছে নাম না জানা কত সভ্যতার বিস্তৃত বিস্তার, বিণ্যাস, কত প্রথা রীতি-নীতি। হয়তোবা অসংখ্য গোত্রের-জনমানুষের চিরন্তন সাক্ষি, থাকতে পারে কোন রাজা-বাদশাদের রীরতপূ¡র্ণ ইতিহাসের ধূসর চিত্র। মাঝে-মাঝে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখলে বিভিন্ন রেখা অবিকল কোন রাজা-মহারাজাদের প্রতিকৃতি বলে মনে হয়। ছড়ানো ছিটানো বড়-বড় গাছ, কাঠের গুড়ি গুলোতেও তেমনই চিত্র। মাটির নীচে পড়ে থেকে যেন জড়িয়ে আছে পরম মমতায়। বোঝা যায় মাটির নিচে অপরিমাপযোগ্য কয়লার স্তুুপ আছে। আর পাহারের শরীর বেয়ে সৃষ্ট জলরাশির রহস্য প্রকৃতির মমতা-ভালোবাসা, এটা বৈজ্ঞানিক ভাবে সত্য। তৃণ, লতাপাতা গুল্ম এমনকি বড়-বড় বৃক্ষরাজি প্রকারন্তে দাঁড়িয়ে আছে জলের উপরেই, একা; স্বকীয়তায় ভাস্কর হয়ে। না, এদের কোন পরিচর্যা করতে হয়না । আপনা-আপনি তৈরী, সৃষ্টি ও বেড়ে ওঠা। পরিচর্যার নামে যখনই কেউ হাত দিয়েছে; কেবলই উজাড় হয়েছে এ পাহার-প্রকৃতির চিরকালিন সারল্য, রুপ-বিন্যাস এমন কি আকৃতিও।
ভ্রমন: বান্দরবান; যেন দুনিয়ার বাইরে কয়েকটি দিন। (১ম পর্ব পড়তে চাইলে)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৩:০৬