অ্যাডভেঞ্চার “এক্সিম রিটার্ন” (০১)
***
আমি বুঝে নিয়েছিলাম সবুজের স্নিগ্ধতা। অনুভবে মেঘ ছুঁয়েছিলাম অসংখ্যবার। মনটা তাই ছুটছিলো সবুজে পাহারে আকাশে। চারদেয়ালে বন্দি আমার অতিষ্ঠ মন জানলার বাইরে চোখ মেললেই দেখতে পেতো ক্রংক্রিটের জঙ্গল। আকাশের মুক্ত-শুভ্র মেঘ যেন চির অধরা। স্বপ্ন বিহারে মিষ্টি চাঁদটাও দূরে-দূরে থাকতো। নগরজীবনে শহরের মজ্জায়-অস্থিমজ্জায় লাগামহীন যানজটে কেবলই লতা-পাতা গুল্মে জড়িয়ে রাখতে চাইতাম নিজেকে। তাই কখনো মনের অজান্তেই বেড়িয়ে আসতো আকূল আবেদন---কবে যাবো পাহারে, আহারে, আহারে। জঙ্গলবাড়ি। হোসাইন সোহেলের নিবিড় তত্তাবধানে সংগঠিত প্রকৃতি পর্যবেক্ষনের জন্য নিবেদিত একটি প্লাটফর্ম। আয়োজন চূড়ান্ত হলো ৯অক্টোবর রওনা হবো বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। নিমিশেই হাজির হলাম ২৬ জন তরুণ তরতাজা নিবেদিত প্রাণ ক্যাস্পার। আমাদের এবারের ট্যুরের স্লোগান ছিলো “এক্সিম রিটার্ন পার্ট-২” অ্যাডভেঞ্চারে হৃদয়-মন-প্রাণ উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। রোমাঞ্চিত ২৬ জোড়া চোখে শিহরণ জাগানিয়া পলক। আমাদের মোটো ---প্রকৃতির মাঝে থেকে কোনো ক্ষতি না কোরে প্রকৃতি পর্যক্ষেন করো। পরিকল্পনা হলো, আমাদের এবারের গন্তব্য হবে নির্জন পাহারে। লোকালয় থেকে দূরে, জনবসতিহীন অঞ্চল। পাহারে উঠবো তাবুতে থাকবো, জঙ্গল থেকে খাবার সংগ্রহ কোরে খাবো। মন ভরে প্রকৃতি দেখবো, উপভোগ করবো মিশে যাবো। আর হ্যাঁ, নতুন কিছু আবিষ্কার করবো। সেটা হতে পারে একটা প্রজাপতি কিংবা ফুল এমনকি একটা মাকড়শা ও হতে পারে। তুলে নিব ছবি, তা নিয়ে আলোচনা হবে ক্যাম্পারদের সাথে।
অক্টোবরের ৯ তারিখে চেপে বসলাম বাসে। হৈ হুল্লোরে সকালে পৌছে গেলাম বান্দরবানে। নাস্তা সারলাম। আর যে যার মতো সংগ্রহে নিলাম প্রয়োজনীয় টুকিটাকি। বান্দরবান থেকে চান্দের গাড়ীতে করে মহুমূহু গানে পৌছে গেলাম শহরের শেষ জনবসতিপূর্ণ অঞ্চল রোয়াংছড়ি বাজারে। অভিভূত চোখে বিশ্বাস হয়না অপার সৌর্ন্দেয্য পূর্ণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একটি স্থানে অবস্থান আমাদের। স্বপ্নের মতো ছবিগুলো পাশকাটিয়ে যায়। শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে যায়, হ্যাঁ, দীবালোকেই আছি। এটাই আমাদের দেশ, শান্ত-নির্জন-নিবিড় মুগ্ধতায় ছড়িয়ে আছে সুশোভিত মায়া। প্রতিটি গাছে-পাতায়-ছায়ায় জড়িয়ে আছে প্রেম। আছে স্বাপ্নিক ভালোবাসা। নান্দনিক ঐশ্বর্য্যে পাহারে-পাহারে মেঘের মেলা। কী এক নতুন আবেশ ছড়িয়ে আছে চারদিকে। যেন প্রতিটি মুগ্ধতাই এক একটি কবি, পরতে-পরতে মিশে আছে কবিতা। আমাদের চান্দের গাড়ী মেঘময় পাহারের বুক দিয়ে এঁকে বেঁকে চলছে উচু-নিচু একাকার কোরে। চোখ যতদুর যায় শুধু পাহার আর পাহার। পরম মুগ্ধতায় মেঘের চাদরে পাহার পেয়েছে এক নতুন মাত্রা। যেন নতুন উদ্ভাসিত শোভা। আর নিচের দিকে তাকালে মনে হয় নিপুন হাতে কোন শিল্পি রং-তুলি দিয়ে এঁকে রেখেছে তার স্বপ্নের পৃথিবী। ধাপে-ধাপে বর্ণীল আমেজ। একেকটা একক রকম। তৃপ্তিতে চোখ ভরে গেলে ভেসে আসা সুর, পথরোদ্দুর কোরে মাথায় টোপর, পায়ে নুপুর; খোঁপায় গোজা লাল ফুল বিস্ময়ভরা ছোট-ছোট চোখে পিট-পিট কোরে তাকানো পাহারী ললনাদের হেঁটে যাওয়া সাক্ষাত প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, এক অপার্থিব পাওয়া; এ দৃশ্য অমরত্ব।
রোয়াংছড়ি বাজারে পৌঁছালে চান্দের গাড়ী বিদায় দিলাম। এবার সঙ্গী হলেন ধীরেন চাকমা ও বীর বাহাদুর ত্রিপুরা- আমাদের দু’জন গাইড। আর প্রাণীবিদ ড. আনিস স্যার, হোসাইন সোহেল, বারীণ ঘোষ, রুদ্র রোমিও, শেখ রাজীব, অনিক চৌধুরী ও কবি সুমন মজুমদার সহ প্রাণ-প্রাচুর্য্যে ভরপুর ক্যাম্পাররা নেমে পড়লাম। গন্তব্য টোলাছড়ি ঝিড়ি। আমাদের চোখে এখন জলের কোলাহল। আমাদের জানা ছিলো এপথ বিপদসংকুল। আছে যে কোন রকম বিপদ আতংক-শংকা। আঁকা-বাঁকা পথে আছে পথ হারাবার ভয়। জোঁকের ভয় ঝেড়ে ফেলে নেমে পড়লাম প্রথম ঝিড়ি খালটিতে। পথে-পথে আনিস স্যারের নানা প্রজাতির ফুল, পাখি-লতা-পাতার সঙ্গে পরিচিতি ছিল বাড়তি পাওনা। ৭১ টিভির ক্যামেরাপার্সন রিপনের ক্যামেরায় চলছে ভিডিও ধারনের কাজ। বারীণ দা, রোমিও, রাজীব, সকলের ডিএসএলআর কেঁপে-কেঁপে উঠছে ফ্লাসে।
সকালের সোনাছড়ানো আলোয় আমরা নির্জন এক স্বপ্নপাহারে। আমরা হাঁটছি থেমে-থেমে। সামান্য দুরে ফেলে এসেছি সনে বাঁধানো ছোট-ছোট ঘর। পাহারের ধাপে-ধাপে জুম চাষ। উননে কুন্ডলী পাকানো সাদা ধোঁয়া। এখন মুর্হূতেই পাহারের পাথর বেয়ে লাফিয়ে পড়ছে ঝর্ণা। অদ্ভুত সৌর্ন্দেয্যে ঝিড়ি-ঝিড়ি শব্দে নুরি পাথরের সাথে মিশে সুতোর মতোন কোরে বয়ে যাচ্ছে নদীর মত করে। লকলকে কচি লতা-পাতা সবুজাভ হয়ে আছে। গৃহস্থলী নি:শ্বাস ছেড়ে খুঁজে নেই পরিপূর্ণ শান্তি। মোহনীয় উচ্ছাস। ছোটবড় নানারকম পাথুরে ঝিড়ি পথ পেড়িয়ে আমরা টোলাছড়ি খালের ৩ মোহনায় থামলাম। এবার আমাদের মূল ক্যাম্পেইন শুরু হবার পালা। পরিচয় পর্ব শেষে ২টি দলে ভাগ হলাম “নীল ও সবুজ”। প্রত্যেকেই জঙ্গলবাড়ীর নিজস্ব লোগো সমৃদ্ধ টি-শার্ট পরিধান করলাম। যার-যার ব্যাগের সাথে সকলের কাঁধেই উঠলো একটি কোরে টেন্ড। যার নিচে আমরা রাত্রীযাপন করবো। এবার দীর্ঘক্ষন হাঁটলাম। হঠাত ঝুমবৃষ্টি নামলো। দুপাশে সবুজাভ পাহার বেয়ে এলিয়ে পড়া লতা-পাতার মাঝখানে ১০-১৫ ফিটের টোলাছড়ি ঝিড়িতে একটা শীতল বাতাস ছুঁয়ে গেল। মাথাতুলে তাকাতেই মনে হলো পাহারের দু ধার দিয়ে ঝট করে আকাশটা উপড়ে উঠে গেল। আকাশ ও যে এমন কোরে পাহারের চোখ দিয়ে কাঁদতে পারে আগে তা জানা ছিলনা। বৃষ্টির উন্মাদনা থেমে গেলে মনে হলো কিছুক্ষন আগে এখানে ঈশ্বরী এসেছিলো। দীর্ঘ ঝিড়ি পথ যেন শেষ হয়না। ক্লান্ত-পিপাসার্ত আমরা ঝিড়ি পানি পান করলাম। বোতলেও ভরে নিলাম যে যার যার মতো করে। দুপুরে জঙ্গল থেকে জাম্বুরা পেঁপে খেয়ে নিলাম।
বৃষ্টিতে কাঁদামাখা পথ ভীষন পিচ্ছিল। মাঝে ঝাউবন-কাঁশবন পেড়িয়ে টোলাছড়ি পাহারের পাদদেশ থেকে পাহারে উঠলাম। খাঁড়া পাহার। ভয়ঙ্কর বিপদ হলেও হতে পারতো। কেননা, ততক্ষনে রাত্রী ঘনিয়ে আসবার উপক্রম। আর পাহারে সূর্য্যডোবার আগেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ২:৫৭