মৃত্যু একটা অমোঘ রীতিনীতি! এই একটা জিনিসই মানুষ তার আয়ত্তে আনতে পারছে না! দৃশ্যপট কেবল কিছু একটা বলে মনকে শান্ত করা! আসলে কি বলব, কি দিয়ে শুরু করবো, কিছুই বুঝতে পারছিনা। যখনি আমাদের দেশ কোন একটা জিনিস মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করে, তখনি সৃষ্টিকর্তা সেই পথ প্রদর্শক কে তুলে নেন।
এদেশে হুমায়ুন আহমেদ- কে চেনেন না, তাঁর একটা বই ও কোনদিন কেও পড়েনি, তাঁর পরিচালিত নাটক, সিনেমা দেখে কেউ অভিভূত হননি, কাঁদেনি, হাঁসেনি—এমন মানুষ বিরল।
সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল তাঁর পদচারণ। তিনি লিখেছেন ছোট গল্প, উপন্যাস, শিশুতোষ, সাইন্স ফিকশন, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক লেখা, সংবাদপত্রে কলাম—কোথায় ছিলেন না তিনি!
হিমু, মিসির আলী- এ যেন বাংলা সাহিত্যের চরিত্র পেরিয়ে, আতিমানবীয় এবং সার্বজনীন চরিত্র হয়ে গিয়েছিল! আমাদের নেই কোন সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, কিংবা স্পাইডার ম্যান, আমাদের আছে হিমু, মিসির আলী, বা শুভ্র!!!
এক সাধারণ ছেলের মহাপুরুষ হবার প্রচেষ্টা! কিংবা মিসির আলী- অলীক বিশবস্তু, কল্পনা, অতিমানবীয়তায় যার বিশ্বাস নেই। যিনি বিশ্বাস করেন বাস্তবতায়, ব্যাখ্যায়, যুক্তিতে!
নারীপুরুষ প্রতিটি সাহিত্যপ্রেমী লালল করেছে একজন মহাপুরুষ হিমু, না হলে বাস্তববাদী মিসির আলী। এক সময় তরুণীরা ভাবতে শুরু করেছে তাদের প্রেমিক হবে হিমুর মতো পাগলাটে, ক্ষ্যাপা! কিংবা শুভ্রর মতো মেধাবী, গবেচেরা! মানুষ ভাবতে শুরু করতে থাকলো হিমুর মতো হলুদ পাঞ্জাবী পরে, খালি পায়ে শহর দেখা, পূর্ণিমা দেখা, বস্তিতে রাত কাটানো, নিকট ভবিষ্যৎ বলে কিংবা মধ্যরাতে কিছু করে কাউকে চমকে দেওয়া! মানুষ ধারণ করতে লাগলো, মহাপুরুষ বুঝি এভাবেই হয়!
তাঁর “অয়োময়,” “এইসব দিন রাত্রি,” “বহুব্রীহি,” “কোথাও কেউ নেই,” “আজ রবিবার,” “নক্ষত্রের রাত”—এই নাটকগুলো আমাদের মিডিয়া ইতিহাসের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় অবস্থান করছে। জানি না আর কারও সাধ্য আছে নাকি সেখানে পৌঁছায়!! বেশ মনে আছে, “কোথাও কেও নেই” নাটকের বাকের ভাইয়ের ফাঁসির প্রতিবাদে এদেশে মিছিল হয়েছিল! ভাবা যায়, শ্রেফ একটা নাটকের কাল্পনিক চরিত্রের জন্য মানুষের এতো আবেগ!! কিভাবে ভুলি “বহুব্রীহি,” “আজ রবিবার,” “নক্ষত্রের রাত” নাটক গুলোর সেইসব হাস্য রসাত্মক চরিত্র, তাদের ডায়ালগ! নাগরিক জীবনের দুর্দশা থেকে এই সব নাটক গুলো যেন দুদণ্ড শান্তি এনে দিত মনে!
কাণ্ডারির মতো পথ দেখিয়েছেন বাংলা সাহিত্য, নাটক এবং চলচ্চিত্র কে। তাঁর লেখা, পরিচালিত “শঙ্খনীল কারাগার,” “আগুনের পরশমণি,” “শ্রাবণ মেঘের দিন,” "শ্যামল ছায়া," চলচ্চিত্রগুলো ছিল মূলত আধুনিক সিনেমার ভিত্তি!!
জন্মগতভাবেই ছিলেন সংগ্রামী! মুক্তিযোদ্ধা পিতা শহীদ হবার পর, তিনি এবং তাঁর পরিবার কেবল তাঁদের মেধা, পরিশ্রম কে সম্বল করেই এই শিখরে পৌঁছেছিলেন। বাবা মায়ের দেওয়া নাম শামসুর রহমান (কাজল) বাদ দিয়ে নিজেই নিজের নাম রাখেন “হুমায়ুন আহমেদ!” ঢাকা ভার্সিটির রসায়ন বিজ্ঞানের প্রচণ্ড মেধাবী এই ছাত্র তাঁর পিএইচডি শেষ করে চাইলে থেকে যেতে পারতেন উন্নত কোন দেশে! কিন্তু তা না করে তিনি শুরু করলেন লেখালেখি। এদেশের হাজারো লেখক তাঁর মতো আজ লিখতে চায়! হতে চায় তাঁর মতো জনপ্রিয়!
একসময় তিনি দেশ ছাড়িয়ে পেরিয়ে গেলেন বিশ্বের অন্যান্য দেশে! নব্বই দশকে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার চাপে পড়ে ভারত সরকার তাঁর বই সেখানে নিষিদ্ধ করে! তাদের কারণ বা অভিযোগ ছিল, পাঠক কেবল হুমায়ুন আহমেদ এর ই বই কেনে। দেশীয় লেখক সব মার খেয়ে যাচ্ছে! তাঁর সমসাময়িক লেখক সুনীল বা সমরেশ নির্দ্বিধায় বলেছেন যে, এত সহজ সরল ভাষায় কিভাবে এত নিগুঢ় অনুভূতি ব্যক্ত করা সম্ভব!!
এই ছিলেন আমাদের হুমায়ুন আহমেদ! এই জায়গায়ই তাঁর অসাধারণত্ব! ব্যক্তিগত ভুল ত্রুটি বাদ দিয়ে যদি ভেবে দেখি, আমাদের সাহিত্যে, মিডিয়ায় তিনি কি অপূর্ব এক জায়গায় আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন!
ব্যক্তি হুমায়ুন আহমেদ কেমন জানি না, শুধু জানি তাঁর একটা বইয়ের জন্য পাঠক অপেক্ষা করে থাকে, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলে তাঁর এক একটি বই, এদেশের অনেকের বালিশের কাছেই থাকে তাঁর বই, তাঁর নাটক দেখার জন্য সব কাজ ফেলে রেখে সবাই এক হয়ে বসে থাকে টিভির সামনে! কিংবা তিনি পেপারে কি ইস্যু নিয়ে লিখছেন তাই নিয়ে থাকে সবার আগ্রহ!
সবচেয়ে বড় কথা হল, তাঁর লেখা পড়তে কোন পাঠকের অভিধান নিয়ে বসতে হয় না। তিনি তৈরি করে দিয়েছিলেন পাঠক সমাজ। এদেশের তরুণ প্রজন্মের পাঠাভ্যাস শুরু হয়েছিল তাঁর ই হাত ধরে। সকল বয়স, মেধার মানুষ খুব সাবলীল ভাবেই তাঁর লেখা পড়ে তা অনুধাবন করতে পারে। নিখাদ এবং পরিপূর্ণ বিনোদন! আমাদের চারপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনা, দুঃখ, কষ্ট, প্রেম, বিরহ, পারিবারিক টানাপোড়ন- পাঠক ভাবতে থাকে এ যেন আমারই কথা!
এই লোকটিই এই তরুণ প্রজন্মে শিখিয়েছি বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ, মনের মানুষকে আষাঢ়ের প্রথম দিনে কদম ফুল দেয়া, পূর্ণিমার অপার সৌন্দর্য, পাখির ভাষা। শিখিয়ে গেছেন রবীন্দ্রকে কি নজরুল, কিংবা আমাদের লোক সঙ্গীতকে কিভাবে লালন করতে হয়। বারে বারে বলে গেছেন প্রকৃতির কাছে যেতে। আমাদের সকল আনন্দ- দুঃখের আধার নাকি উৎস এই প্রকৃতি।
একটা ভয়ানক রোগ তাঁকে কেড়ে নিয়েছেন, এটা বিশ্বাস করি না। ময়ূরাক্ষী নামক একটা নদীতে হিমু, মিসির আলী, শুভ্র, বাকের ভাই সহ তাঁর অগণিত পাঠক, ভক্তকুল সমেত তিনি নিশ্চয় পূর্ণিমা উপভোগ করবেন!
আমি, আমরা ভাগ্যবান যে, আমরা আমাদের দেশের শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পুরুষের কৃতিত্ব দেখে গেছি, জেনেছি। আমরা এই বাদশা নামজাদা-র পাশে ছিলাম, আছি, থাকব।
ভালো থাকুন, প্রিয় হুমায়ুন আহমেদ।
___________________________________________________
সামুর নির্বাচিত কিছু পোস্ট! এ যেন মাতম! (আপডেট হবে)
সেভেরাস স্নেইপঃ "অ্যা ট্রিব্যিউট টু হুমায়ূন আহমেদ" - সকল রচনা সংগ্রহ
জীবনানন্দদাশের ছায়াঃ চাঁদনী পসর রাত কী না জানিনা, তবে চন্দ্রগ্রস্ত এক ভাবুক উন্মাদের মৃত্যুতে শ্রদ্ধান্জলী
বাউন্ডুলে রুবেলঃ একজন হুমায়ুন আহমেদ আর কখনো পাওয়া যাবেনা এই দেশে...
স্বপ্নবিলাসী আমিঃ একজন প্রিয় মানুষ "হুমায়ুন আহমেদ" এবং আমার কৈশোরের ঘোর লাগা কিছু স্মরনীয় মুহূর্ত।
আলিম আল রাজিঃ অন্যভুবনে নিশ্চয়ই গতকাল 'চান্নি পসর রাত' ছিলো। তাই না স্যার?
আশরাফুল ইসলাম দূর্জয়ঃ জ্যোৎস্নায় আমাদের চোখ, প্রিয় হুমায়ুন আহমেদ
নাঈম আহমেদঃ হুমায়ুন স্যার আপনি আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারেন না।
মোঃ আলাউল হক সৌরভঃ হুমায়ূন আহমেদ – একজন বাজারি লেখকের অপূর্ণ রয়ে যাওয়া কিছু আশা , কিছু স্বপ্ন ।
একজন হুমায়ূন আহমেদ , একজন পাঠক , কিছু অব্যক্ত কথা আর কিছু প্রশ্ন
মোটামানুষঃ হুমায়ুন আহমেদ বাঙ্গালী জাতিকে কি দিয়েছেন?
দিপঃ হুমায়ুন আহমেদ সহ ৫ জন মারা গেল বেলভিউতে। আহত হলো, কয়েক লক্ষ হৃদয়
ফ্রাঙ্কেস্টাইনঃ রাজা আসে রাজা যায় ....!!!
প্রজন্ম৮৬ঃ এই মৃত্যু শোকে'র নয়, এই মৃত্যু শান্তি'র!!!
মেংগো পিপোলঃ হিমুর না ফিরে আসা।
সাব্রিনা সিরাজী তিতিরঃ কেউ আমাকে মিসির আলির কাছে নিয়ে যেতে পারো ?
সাকিন উল আলম ইভানঃ "জানালার ওপাশের অন্ধকার থেকে আমার সঙ্গীরা আমায় ডাকে..একদিন যাদের সঙ্গ পেয়ে আজ নিসঙ্গ্তায় ডুবেছি"-(শঙ্খনীল কারাগার)হুমায়ূন আহমেদ((
রেভোল্যুশন ব্ল্যাকঃ আমেরিকান চিকিৎসকদের একটি ভুলে চলে গেলেন বাংলার প্রাণপুরুষ হুমায়ূণ স্যার
মুহসীন৮৬ঃ হুমায়ুন স্মরণে
বর্ণচোরাঃ শ্রাবণের জোছনা- (অমরত্ব লাভ করলেন সময়ের সেরা গল্প-কথক হুমায়ূন...)
বাংলার আগন্তুকঃ আপনি থাকছেন স্যার
সৈয়দ নাসেরঃ দিলু নাসের এর ছড়া >.>>জীবন শিল্পীর মহা প্রয়ানে
সুনীল সমুদ্রঃ একটি মানুষ শুয়ে আছে, নিথর...
মো রেজাউল করিমঃ আপনার জন্য আমাদের ভালবাসা কখনোও শেষ হবে না (হুমায়ূন আহমেদ-ছবি ব্লগ)
আন্ধারঃ না বলা কথা
শফিক আসাদঃ চোখের পাতা ভিজে উঠছে... হাত পা অসাড়। কেউ যদি একটিবার বলতো... খবরটা মিথ্যা। শুধু একবার।
মোঃ আতিকুল হাসানঃ হে জাদুকর, অন্তহীন ভুবনে ঘুমাও তুমি শান্তিতে!!!
যে পাথর পাথর নয় সেও তো পাথরঃ হুমায়ূন আহমেদ : কারণে, অকারণে...
অনিকঃ হুমায়ুন আহমেদ স্মরণে
হা...হা...হা...ঃ মেঘের উপর বাড়ি....
ভাবী জিওলজিস্টঃ হুমায়ূন আহমেদ: কুতুবপুর থেকে নিউইয়র্ক
রিফাত হাসানঃ মরণ সম্ভবত: একটি জোছনা-জাগতিক গল্প
রিজওয়ানুল ইসলাম রুদ্রঃ স্যার, এই হিমুদেরকে ফেলে চলে গেলেন?
মাহদী০০৭ঃ এখন নিউয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ
প্রমিথিউস22ঃ হুমায়ুন আহমেদের জন্য এপিটাফ
অস্পৃশ্য যুবরাজঃ প্রিয় লেখকঃ যে চিঠি আপনি পড়বেন না.....................
অন্ধ দাঁড়কাকঃ ধন্যবাদ হুমায়ুন আহমেদ: আমরা আপনাকে ভুলবোনা
মুহাম্মদ জহিরুল ইসলামঃ হুমায়ূন আহমেদের প্রথম সাক্ষাৎকার