এখন পর্যন্ত দেশে কারো লাশ দাফন করা যাবে না বলে দাবি ওঠেনি। তবে দিন দিন আমরা অসহনশীলতার যে পর্যায়ে যাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে সেই দাবি উঠতেও বেশী দেরী হবে না হয়ত। কোন ধরনের বিচার বিশ্লেষন ছাড়া, সত্য মিথ্যার পরোয়া না করে, যুক্তি ও শালীনতার সব সীমা ছাড়িয়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে যখন কোন সমাজে জ্ঞানী গুনীদের অপমান করা হয় তখন সচেতন যেকোন নাগরিকই শঙ্কিত হন। গনতন্ত্রের প্রতি আজীবন শ্রদ্ধাশীল, প্রতিকূল পরিবেশে ভিন্নমত প্রকাশে দ্বিধাহীন অধ্যাপক পিয়াস করিমের মত দেশপ্রেমিক সাহসী মানুষটির মরদেহের প্রতি যে ঘৃণিত আচরণ করা হল তার নজির বিশ্বের কোন গনতান্ত্রিক সভ্য সমাজে পাওয়া দুষ্কর। কতিপয় তরুণের দাবি ও মিথ্যা অপপ্রচারে তাঁর মরদেহটি শহীদ মিনারে রাখার সুযোগ হয়নি। এতে সর্বস্তরের মানুষ তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ব্যর্থ হয়। তবুও ঐ তরুণদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয়, কারণ দয়াপরবশ হয়ে তারা তাদের ভাষায় জঘন্য রাষ্ট্রদ্রোহী (!) মানুষটিকে এ দেশে দাফন করা যাবে না, এ দাবিটি করেনি। করলে হয়ত দাফনের অনুমতিও মিলত না। তখন হয়ত হাসপাতালের হিমাগার থেকে পিয়াস করিমের মরদেহটি বাক্সবন্দী করে মার্কিন মুল্লুকে ফেরত পাঠাতে হত।
আদর্শিক ভিন্নতা, মতের অমিল, চিন্তায় বৈচিত্র্য যেকোন অগ্রসর জনগোষ্ঠীর মধ্যে থাকা স্বাভাবিক এবং বিশ্বের সব জায়গায় আছেও। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, বিশ্বাস ও রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার ভিন্নতাভেদে সবার জন্য মানবাধিকার যেমন জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত ঠিক তেমনি আমাদের সংবিধানেও স্বীকৃত। যে সমাজে ভিন্নমত ধারনের ক্ষমতা যত বেশী সেই সমাজ বা রাষ্ট্র তত বেশী স্থিতিশীল ও অগ্রসর। উদার গনতান্ত্রিক সমাজে ভিন্নমতকে উৎসাহিত করা হয় সামাজিক বিকাশের জন্য। তবে কোন স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী সমাজে ভিন্নমত সহ্য করা হয় না।
বর্তমান বাস্তবতা সাক্ষ্য না দিলেও ঐতিহ্যগত ভাবে আমরা সহনশীল জাতি। অদূরদর্শী স্বার্থান্বেষী রাজনীতি আমাদের এই ঐতিহ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আমরা যদি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা ভিন্নমতের মানুষের সাথে বঙ্গবন্ধুর আচরণ দেখি তাহলে আজকের অবস্থার সাথে কোনভাবেই মেলাতে পারব না। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জেলে বন্দী ছিলেন সবুর খান, যিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শিবিরের অন্যতম নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে যখন তিনি চিঠি লিখলেন তার অবস্থা বর্ণনা করে তখন বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে তাকে জেল থেকে মুক্ত করে দিলেন। শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ খুব সুন্দর করে টেলিভিশনে এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু আজকের নেতাদের এরকম পারস্পারিক শ্রদ্ধা ও ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতার কোন নজির আমাদের সামনে নেই। উল্টো আমরা দেখতে পেলাম একজন ভিন্নমত পোষণকারীর মরদেহ শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য যাতে রাখা না হয় তার জন্য সব আয়োজন। তাকে স্বাধীনতা বিরোধী, রাষ্ট্রদ্রোহী বলা হল। অথচ আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হকের কাছ থেকে জানলাম, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণার জন্য পাক বাহিনী পিয়াস করিমকে আটক করেছিল। পিয়াস করিমের বোন এ্যাডভোকেট তৌফিকা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা পরিচালনায় বাদী পক্ষের আইনজীবি প্যানেলের সদস্য ছিলেন। মন্ত্রীমহোদয়ের বক্তব্যের পর যেখানে প্রতিবাদকারী তরুণদের লজ্জা পাওয়ার কথা সেখানে কেউ কেউ মন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হকের কুশপুত্তলিকা দাহ করছেন।
তাই স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন জাগে এরা সত্যি সত্যি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে প্রতিবাদ করছে না অন্য কোন মহলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে। সচেতন মহলের সন্দেহ আরও বিস্তৃত হয় যখন সিপি গ্যাং নামক অখ্যাত একটি সংগঠনের ব্যানারে দেশের অধ্যাপক, সাংবাদিক ও আইনজীবিসহ আরও জীবিত নয় জনকে শহীদ মিনারে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে। এই নয় জন একই মতাদর্শের না হলেও সবাই দেশের বর্তমান অবস্থার সমালোচক। এদের সবার চাওয়া একটি দুর্নীতিমুক্ত গনতান্ত্রিক বাংলাদেশ যেখানে ভিন্নমত প্রকাশ ও মুক্তচিন্তার সুযোগ থাকবে। এই চাওয়ার সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোন বিরোধ নেই। তবুও তারা অবাঞ্চিত। আর তখনই তাদের আসল মতলব নিয়ে সন্দেহ হয়। এদের অবস্থা অনেকটা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর “লাল সালু“ উপন্যাসের মজিদ চরিত্রের মত। ভন্ড মজিদ গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা ঠেকানোর জন্য আক্কাসের দাড়ি নেই কেন, এই প্রশ্ন তুলেছিল।
এভাবে জ্ঞানী গুনী ব্যক্তিদের অপবাদ দিয়ে, অপমান করে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন করা যায় না। আলোকিত সমাজ বহুমত ও পথের মানুষের সরব উপস্থিতি ও বিতর্কের মাধ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বাক স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে ও ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে আপাতত কোন সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিল হলেও জাতির অপরিসীম ক্ষতি হয়। কারণ একটি সাহসী জাতিই রক্ষা করতে পারে তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে। সাহস করে উর্দুকে ‘নো‘ ‘নো‘ বলতে পারার কারণে রক্তঝরা পথ পেরিয়ে আমরা পেয়েছি বাংলা ভাষা ও পরবর্তীতে স্বাধীনতা। এদেশকে রক্ষা করে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে হলে দরকার সুশিক্ষিত সাহসী নেতৃত্ব। এই নেতৃত্ব ১৬ কোটি মানুষের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসবে মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তা চর্চার মাধ্যমে। ভীতিকর পরিবেশে এরকম চর্চাও সম্ভব নয়।
পাকিস্তানী শাসকদের হাত থেকে মুক্তির জন্য এদেশের সাধারণ জনতা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল অর্থনৈতিক শোষণ মুক্তি ও গনতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য। পাকিস্তানীরা তাদের অপকর্মকে রক্ষা করত ধর্মকে ব্যবহার করে। তাদের কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে সেটা ইসলামের বিরুদ্ধে যাচ্ছে বলে প্রচার করত। এভাবে সাধারন মানুষের কাছে প্রগতিশীল মুক্তবুদ্ধির মানুষদের ধর্মবিরোধী হিসেবে উপস্থাপন করে সামাজিকভাবে হেয় করত। আর এখন গনতন্ত্রের পক্ষে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারা টক শো‘তে কথা বলেন তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী আখ্যায়িত করে অবাঞ্চিত করা হচ্ছে। তাই পাকিস্তানী শাসক ও আজকের অতি উৎসাহী তরুণদের মধ্যে উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে পার্থক্য খোঁজে পাওয়া কঠিন। ইসলাম এসেছিল পৃথিবীর সকল মানুষের মুক্তির জন্য। আর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বাঙ্গালী তথা বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য দুটি ভিন্ন সময়ে, দুটি ভিন্ন গোষ্ঠী ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অভিন্ন উদ্দেশ্যে মানুষকে শৃংখলিত করার কাজে ব্যবহার করার অপচেষ্ঠা করেছে এবং করছে। কিন্তু এসব অপচেষ্টা অতীতে যেমন সফল হয়নি আজকেও হবে না। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সাহসী বক্তব্যই প্রমান করে দিচ্ছে সত্যকে লুকিয়ে রাখা কঠিন।
রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন মত ও পথের হলেও আইনমন্ত্রীর মত সবাইকে সত্য প্রকাশে এগিয়ে আসতে হবে। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক সবাই সমস্বরে এসব অপচেষ্টার প্রতিবাদ করতে হবে। অন্যের সম্মান রক্ষার উপরই নিজের সম্মান নির্ভর করে। আজকে যাদের সম্মান সুরক্ষিত, ক্ষমতার পালাবদলে অরক্ষিত হতে কতক্ষণ। তারুণ্যের এসব বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় ও মদদ দিলে এক সময় হয়ত কার লাশ দাফন করা যাবে আর কার অনুমতি লাগবে তাও তারা ঘোষণা করবে।
বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ হলেও সার্বিক মুক্তির সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। গনতন্ত্রের মুক্তি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের মধ্যেই সত্যিকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিহিত। নতুবা দেশে আমরা একে অন্যকে অবাঞ্চিত করতে থাকব এবং বিদেশে দক্ষিণ থাইল্যান্ডের মত আমাদের শ্রমিকদের ক্রীতদাসের জীবন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় শিরোনাম হবে। এভাবে ঘরে বাইরে আমরা সবাই মুক্ত মানুষের পরিবর্তে দাসে পরিণত হব। তখন একটি দাস জনগোষ্ঠীর শাসক হিসেবে আমাদের রাজনীতিকদের সম্মান বিদেশে কমবে বৈ বাড়বে না।