সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে- এ আমার ভবিষ্যৎ বাণী নয়। লাইনটি প্রয়াত সাহিত্যিক হুমায়ূন আজাদের একটি কবিতার শিরোনাম থেকে নেয়া। একজন প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে তাঁর যেমন ভক্ত পাঠক রয়েছেন, তেমনি আছেন অনেক বিরক্ত পাঠক। তবুও আজকের বাস্তবতায় কবিতার মর্মার্থের সাথে উভয় পক্ষ একমত হবেন। তিনি যখন বলেন, ”আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।/নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক/সব সংঘ-পরিষদ,-চলে যাবে অত্যন্ত উল্লাসে/চলে যাবে এই সমাজ সভ্যতা- সমস্ত দলিল-”। লেখকের প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণের সাথে আজকের বাস্তবতার আশ্চর্য মিল থাকায় তাঁর পক্ষ-বিপক্ষ সবাই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় একমত হতে বাধ্য। কখনও কখনও পরস্পর বিরোধী চিন্তা ও পথের মানুষও কোন বিশেষ বাস্তবতায় একই রকম চিন্তা করে থাকেন। আমাদের প্রধান দুই নেত্রীও পরস্পর বিপরীত অবস্থানে থেকেও এবারের ফুটবল বিশ্বকাপে উভয়ের দৃষ্টি স্থির করেছেন ব্রাজিলের সাম্বা নৃত্যে। তাঁরা দুজনই ব্রাজিল ফুটবল টিমের সমর্থক হিসেবে পত্রিকায় খবর এসেছে। যদিও তাঁরা এ জাতির রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি ও ধর্মীয় নীতির বিষয়ে কস্মিনকালেও একমত হতে পারেননি। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির মৌলিক বিষয়গুলোতে একমত হতে না পারার কারণে সমাজে অনৈক্য, অস্থিরতা ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে। উদার চিন্তা চেতনা কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, উগ্রতা দাপটের সাথে বিচরণ করছে সর্বত্র। কেড়ে নিচ্ছে নেতৃত্ব। এভাবেই সমাজ সভ্যতা সবই নষ্টদের অধিকারে যাচ্ছে।
আমাদের নেতা-নেত্রীরা নষ্ট হওয়ায় জনগন নষ্ট হয়েছে না নষ্ট জনগনের কারণে নেতা-নেত্রীরা নষ্ট হয়েছেন তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। অনেকটা ডিম আগে না মুরগি আগে- এই বিতর্কের মত। তবে দেশের আপাদমস্তক অসত্য, অসুন্দর ও অশুভ নোংরা জলে নিমজ্জিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সত্য, সুন্দর ও শুভ্রতা টিকে থাকতে পারছে না অসত্যের জোয়ারে। হুমায়ূন আজাদ যেন দিব্য চোখে আজকের বাংলাদেশ দেখতে পেয়েছিলেন। তাইতো তাঁর কবিতায় শোনা যায়- ”অস্ত্র আর গনতন্ত্র চলে গেছে, জনতাও যাবে;/ চাষার সমস্ত স্বপ্ন আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন/ সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।” সত্যিই রাষ্ট্র, শহর, বন্দর, মসজিদ, মন্দির ও গীর্জা সবই আজ ভুল মানুষের দখলে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন শামীম ওসমানের পাশে থাকার ঘোষণা দেন তখন শান্তিকামী মানুষ শঙ্কিত হয়। সন্ত্রাসীদের গডফাদার হিসাবে মার্কিন দূতাবাস তার ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেও সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তির পাশে থাকার ঘোষণা আইন-শৃংখলা বাহিনীকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিতে নিরুৎসাহিত করবে। এ হল দুষ্টের দমন শিষ্টের লালন প্রশ্নে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের অবস্থান। বিচার বিভাগের অবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ। ন্যায় বিচারের প্রত্যাশায় সাধারন মানুষ যখন আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে হতাশ বদনে ঘরে ফেরে তখন শেষ বিচারের দিনের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। সংসদের অবস্থাও তথৈবচ। বিনা ভোটে বেশীরভাগ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এই যখন রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের অবস্থা তখন আইন-শৃংখলা বাহিনীর একটি অংশ ভাড়াটে খুনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় মজলুম মানুষের আর্তনাদ আল্লাহর আরশকে কাঁপিয়ে তুলছে। এসব দেখে মনে প্রশ্ন জাগে সব কিছু কি ইতোমধ্যে নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে, না এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে।
অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মনের এই প্রশ্নের ইতিবাচক কোন জবাব পাচ্ছি না। সর্বত্র ঘাতকের কালো থাবা। সভ্যতা বিরোধী নষ্ট মানুষের সদম্ভ পদচারণা। এরা সাধারণ মানুষকে সুন্দর সুন্দর বক্তব্য শুনালেও ভেতরে ভেতরে সমাজ, পরিবেশ ও জীবন বিরোধী শক্তির সাথে আঁতাত করে চলে অথবা এদেরকে আশ্রয় দিয়ে থাকে। শিল্প-কারখানায় কালো ধুয়া ও দূষিত রাসায়নিক পদার্থ নির্গমনের মাধ্যমে যারা পরিবেশ আইন অমান্য করে পুরো জনগোষ্ঠীকে তিলে তিলে হত্যা করছে তারা আমাদের অর্থনীতি বাঁচিয়ে রাখার কৃতিত্ত¡ দাবি করেন এবং দাবি অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় মর্যাদাও পেয়ে থাকেন। ব্যবসায়ীরা খাদ্যদ্রব্য ও ফলমুলে ফরমালিন, বিষাক্ত কার্বাইড সহ বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে বিক্রি করছেন দেদারছে। দেখার কেউ নেই। টাকার জন্য যে র্যাব সদস্যরা খুন করল তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। কিন্তু যে ব্যবসায়ীরা পুরো জাতিকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। অথচ একজন খুনী যার বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩০২ ধারায় মামলা হয় তার সাথে বিষাক্ত খাদ্য বিক্রেতার তফাৎ সামান্য। একজনের কাজে সাথে সাথে মানুষের মৃত্যু হয় আর অন্যজনের কাজে ধীরে ধীরে একজন মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
এই মৌসুমে বাজারে প্রচুর পাকা ফল। কিন্তু খাওয়ার মত কোন ফল নেই। সবই ফরমালিন মিশ্রিত। আমে ফরমালিন ও কার্বাইডের খবর সবার জানা থাকলেও নতুন খবর হচ্ছে বাজারের শতভাগ কালো জামে ফরমালিন মিশ্রিত। চারদিকে আম, জাম ও লিচুর সমারোহ অথচ খাওয়ার মত কোন ফল নেই। অবস্থা স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের ঐ বিখ্যাত লাইনের মত, ”ওয়াটার, ওয়াটার, এভরি হোয়ার,/ নর এনি ড্রপ টু ড্রিংক”।
এসবই হচ্ছে যেনতেন ভাবে অর্থ উপার্জনের নেশার কারণে। এ মরণ নেশা পুরো জাতিকে গ্রাস করে নিচ্ছে। যে যেভাবে পারছে অবৈধ টাকা উপার্জনের দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নুতন নুতন পদ্ধতি আবিষ্কার করছে। চুরি, ডাকাতির মত আগের এনালগ পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। ব্যাংক ডাকাতির পরিবর্তে ঋণের নামে ব্যাংক লুট করা হচ্ছে। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রæপ ও সাম্প্রতিক বেসিক ব্যাংকের ঘটনা গুলো তারই প্রমাণ। চুরির পরিবর্তে টেন্ডারের মাধ্যমে সরকারী টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। আর চাকরিজীবিরা এখন ঘুষ নেন না। তারা কমিশন বা স্পিড মানি গ্রহন করে থাকেন। এভাবে টাকা বানিয়ে দেশের আইন আদালত, সংবিধান ও মানুষের মৌলিক অধিকার সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সমাজে তারা মহা দাপটের সাথে বিচরণ করছে। তারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বত্র অদৃশ্যভাবে কলকাটি নাড়ছে।
মেধা নয় টাকাই সর্বত্র রাজত্ব করায় মেধাবীরাও টাকার পেছনে ছুটছে। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয় মেধাবী ছাত্ররা। ডাক্তার হয়ে অর্থ ও সম্মান দুটোই অর্জনের সুযোগ রয়েছে তাদের। কিন্তু তারাও অপেক্ষা করতে রাজি নয়। রাতারাতি টাকা চাই। দীর্ঘদিনের এই চাওয়া ও পাওয়ার নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ার চলমান পথে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের ছাত্র তাওহীদ। দাবীকৃত চাঁদার টাকা না পেয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে একই মেডিকেলের ছাত্ররা তাকে হত্যা করে। জাতীয় পত্রিকায় লিড নিউজের শিরোনাম হয়েছে, ”ছাত্রলীগের ’টর্চার সেল’ আবুসিনা ছাত্রাবাস”। এই শিরোনামের আগেরদিন একই পত্রিকার প্রথম পাতার খবর ছিল, ছাত্রলীগ সভাপতির স্বীকারোক্তি- সিলেটে টাকার জন্য পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাওহীদকে। এছাড়াও জাতীয় ও স্থানীয় সব পত্রিকায় খবরটি গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। পত্রিকার খবর থেকে জানা যায় দীর্ঘদিন থেকে ওসমানী মেডিকেল কলেজে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন অন্যান্য দলের ছাত্রদেরকে চাঁদা দিতে বাধ্য করে। বিশেষ করে সরকার বিরোধী কোন সংগঠনের কেউই চাঁদা না দিয়ে পরীক্ষা দিতে পারেন না। ক্ষমতার পালাবদলে মেডিকেলের স্টিয়ারিং যাদের হাতে থাকে তারাই আবু সিনার টর্চার সেল খ্যাত ১০০৩ নম্বর রুম দখল করে রাখে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে বিপদগামী এই ছাত্রনামধারী মাস্তানদের নির্যাতন যেমন সাধারণ ছাত্ররা নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে তেমনি পুলিশ ও মেডিকেল কর্তৃপক্ষও তা মেনে নিয়েছে।
এসবে বিরুদ্ধে রাস্তায় প্রতিবাদের সুযোগ নেই। টকশো ও পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে জনগন ও কর্তা ব্যক্তিদের সচেতন করার চেষ্টাও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ভাল চোখে দেখা হয় না। এসব নিয়তি হিসেবে মেনে নিলেই খুশী তারা।
অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি হতে কেউ প্রস্তুত নন। যারা অপ্রিয় সত্য বলতে চান তাদের জীবনও ঝুঁকিমুক্ত নয়। এরকম পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার মন্ত্র শুনিয়েছেন আরেক কবি রফিক আজাদ। তাঁর ভাষায়, ”প্রিয় মিথ্যা বলা শিখে নাও, বিক্রি করে দাও তোমার বিবেক-/উচ্চারন কোরো না এমন শব্দ, যা শুনে আহত হবেন তাঁরা-/নত হও, নত হতে শেখ;/তোমার পেছনে রয়েছে যে পবিত্র বর্বর মন ও মস্তিস্ক/তাকে অনুগত দাসে পরিণত হতে বলো,”।
প্রিয় কবি, আমরা তো নত হয়েই অনুগত দাসের মত বেঁচে আছি। শুধু একটি ছোট্র প্রশ্ন- আর কতকাল আমরা দাসত্বের বোঝা বহন করব?