পরীক্ষায় কি আসবে কি আসবে না, প্রশ্ন কঠিন হবে- না পড়াশোনার মধ্যে কমন পড়বে, সময়ের মধ্যে সঠিকভাবে উত্তর লিখে পেপার জমা দেয়া যাবে কি-না এসব চিন্তা একজন পরীক্ষার্থীর মাথায় একসময় থাকত। বিশেষ করে এসএসসি ও এইচএসসির মত পাবলিক পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের সাথে অভিভাবকদেরও সমান টেনশন কাজ করত। পরীক্ষার আগের সারারাত সিলেবাসের পড়াগুলো রিভিশন দেয়ার জন্য চেয়ার টেবিলে বসে সময়ের সাথে রীতিমত ছাত্রদের যুদ্ধ করতে হত। একদিকে পড়া শেষ হচ্ছে না, অন্যদিকে অভিভাবকরা ঘুমের জন্য তাগাদা দিতেন। ঠিকমত ঘুম না হলে পরীক্ষায় ভাল করা যাবে না। এরকম একটি রাত কাটিয়ে পরদিন নির্দিষ্ট সময় যখন পরীক্ষার হলে ছাত্ররা ঢুকত তখনই সংশ্লিষ্টরা ছাত্রদের প্রশ্ন তুলে দিতেন অর্থাৎ প্রশ্ন আউট হত। পাঠকদের বেশীরভাগের ছাত্রজীবনের পরীক্ষার স্মৃতির সাথে উপরের বর্ণনার মিল পাওয়া যাবে।
কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভিন্ন। ছাত্র ও অভিভাবকের ব্যস্ততা ও টেনশন থাকে আগের চেয়েও অনেক বেশী, কিন্তু তা পড়াশোনা নিয়ে নয়। ইন্টারনেটে প্রশ্ন খুঁজতে খুঁজতে সময় পার করেন ছাত্র ও অভিভাবকরা। কেউ কেউ আসল প্রশ্নপত্র পেয়ে যান। আবার কেউ কেউ আংশিক পেয়ে থাকেন। তারপর প্রাপ্ত প্রশ্ন অনুযায়ী শর্টকাট প্রিপারেশন নিয়ে পরদিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া। তখন কারো কপাল খোলে আবার কারো কপাল পুড়ে। এভাবে কোমলমতি ছাত্ররা মারাত্মকভাবে প্রতারিত হয় যা তাদের মেধা বিকাশকে ব্যাহত করার পাশাপাশি মানসিক বিকৃতির কারণও হয়ে থাকে। পরবর্তীতে এরা সুস্থ স্বাভাবিক চিন্তা লালন করে সুনাগরিক হিসাবে বেড়ে উঠবে তা বলা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে জাতির অস্থির ও অনিশ্চিত বর্তমানের সাথে যোগ হয় হতাশা ও অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের হাতছানি। যা কোন সচেতন নাগরিকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
এরকম একটি দুঃসহ পরিস্থিতিতে অনেকেই সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ করেছেন বিভিন্ন মাধ্যমে। এদের অন্যতম একজন হচ্ছেন ডঃ জাফর ইকবাল। বার বার লিখেও অবস্থার পুনরাবৃত্তি রোধ ও সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয়ে তিনি কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করেন। এতে মাননীয় মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তাঁর লেখার জবাব অত্যন্ত ভদ্রোচিতভাবে অন্য একটি লেখার মাধ্যমে দিয়েছেন যা গত ২৫শে মে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি জাফর ইকবালকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, সব লেখাই তিনি গুরুত্ত্ব দিয়ে পড়েছেন এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছেন। একটি কমিটি করে দিয়েছেন যারা অপরাধীদের সনাক্ত করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি রোধে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিবেন।
মজার বিষয় হচ্ছে ঐ দিনই এইচএসসির অংকের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় যা ব্লগার ও অনলাইন একটিভিস্ট আরিফ জেবতিক অনেক তথ্য দিয়ে একটি পত্রিকায় লিখেছেন। ঐ প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবরটি ছিল রীতিমত মন্ত্রীর বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। দেশের বেশীরভাগ মানুষ যেখানে নীতি নৈতিকতার কোন ধার ধারে না, যেকোন ভাবে টাকা উপার্জনই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে, সেদেশের একজন মন্ত্রী যত সৎ কিংবা আন্তরিক হন না কেন তাঁর পক্ষে অপরাধ দমন অনেক কঠিন। কারণ তাঁর সহকর্মীরা যেখানে নানা কিসিমের অপরাধে জড়িত সেখানে একার পক্ষে কি-ই বা করার আছে। কিন্তু দুঃখ লাগে নুরুল ইসলাম নাহিদের মত সৎ ও কর্মঠ একজন মন্ত্রী যখন বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন। দিনের আলোর মত পরিষ্কার বিষয়গুলোকে গুজব, সাজেশন ও উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার মাধ্যমে ভাবমূর্তি নষ্টের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা কোন অবস্থায় ঠিক হয়নি। সমস্যাকে স্বীকার না করলে সমস্যা সমাধানের পথ বেরুবে কিভাবে? প্রশ্নপত্র ফাঁস এই প্রথম হয়নি। আমার মনে আছে ১৯৯১ সালের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা বাতিল করে আবার পরীক্ষা নিয়েছিলেন। পরবর্তীতেও অনেক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এমনকি প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নও অহরহ ফাঁস হচ্ছে। তাই এটা স্বীকার করলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর প্রতিপক্ষ সুযোগ নেবে তা ভাবা ঠিক নয়। কারণ সব সরকারের আমলেই সমস্যাটি ছিল। পার্থক্য শুধু বর্তমানে এর ব্যাপকতা বেড়েছে এবং দিবালোকের মত পরিষ্কার ঘটনাগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে মন্ত্রীর দায়-দায়িত্ব থাকলেও প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সাথে মন্ত্রী সরাসরি জড়িত নন। শিক্ষকরা প্রশ্নপত্র তৈরী করেন, অন্যরা তা মডারেশন করেন। তারপর প্রেসের লোকজন ছাপা করেন। সবশেষে জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্টদের কাস্টডীতে নিরাপত্তা হেফাজতে প্রশ্ন রাখা হয়। এখন এই দীর্ঘ চেইনের যেকোন স্তরে অবৈধ উপার্জনের নেশায় ইচ্ছাকৃতভাবে বা অসতর্কতার কারণেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। বেশীরভাগ মানুষের স্বার্থপরতা, অনৈতিকতা ও চরিত্রহীনতা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা যেকোন বিভাগের কাজে বিঘœ ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের যেকোন অপকর্মের ফলে একসাথে এত বেশী মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না বিধায় তা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় না। অথচ প্রশ্ন ফাঁসের একটি ঘটনায় একসাথে প্রায় এগার লক্ষ এইচএসসি পরীক্ষার্থী তথা এগার লক্ষ পরিবার উৎকন্ঠিত। তাই কোন একক ব্যক্তি বা মন্ত্রণালয়ের সমস্যা এটি নয়। পুরো জাতীয় চরিত্রে ধ¦স নামার কারণে এরকম ঘটনা হরহামেশা হচ্ছে। পদ্মা সেতু বানানোর মত অর্থ বরাদ্দ দিলেই জাতির নৈতিকতার সমস্যা সমাধান হয়না, উন্নত চরিত্র গঠন করা যায় না। চরিত্র গঠন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফল।
প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কি এগুলো অস্বীকার করে চোখ বন্ধ করে থাকব না সমাধানের পথ খুঁজব? আমরা মন্ত্রীর কাছে আশা করি সততার সাথে সব দায় স্বীকার করে সবাইকে নিয়ে সমাধানের পথ খুঁজবেন। দায়সারা কমিটি গঠন করে হাজারো সমস্যার মত প্রশ্নপত্র ফাঁসের দুর্নীতিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া ঠিক নয়।
আমাদের কর্মকর্তা কর্মচারীদের চরিত্র রাতারাতি ঠিক হবে না ধরে সমাধানের পথ বের করতে হবে। পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করেও চেষ্টা করা যায়। এছাড়া প্রশ্নপত্র প্রণয়নের পদ্ধতিতেও গতানুগতিক ধারার পরিবর্তন করে চেষ্টা করা যেতে পারে।
এরকম একটি চেষ্টা এমন হতে পারে- আগে প্রশ্ন তৈরী না করা। পরীক্ষার দিনই প্রশ্ন তৈরী করা হল। এর পুরো মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকলেন মন্ত্রী। সপ্তাহখানেক আগে মন্ত্রী বাছাইকৃত পাঁচজন শিক্ষককে প্রশ্ন তৈরী করার জন্য নির্দেশ দিলেন। পরীক্ষার দিন ভোরে পরীক্ষার কমপক্ষে দুই ঘন্টা আগে শিক্ষকরা যার যার প্রশ্ন নিয়ে আসলেন। মন্ত্রী দুই জন মডারেটর নিয়ে আসলেন। এবং ঐ জায়গায় স্ক্যানার, প্রিন্টার, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সংযোগ থাকল। দুই জন বিশেষজ্ঞ শিক্ষক প্রশ্ন প্রণয়নকারী পাঁচজনের মধ্যে যেকোন একজনের প্রশ্নকে পরীক্ষার জন্য বাছাই করলেন। সাথে সাথে কম্পিউটার অপারেটর তা ইমেইলে প্রত্যেকটি পরীক্ষা সেন্টারে পাঠিয়ে দিলেন। প্রত্যেকটি সেন্টার সাথে সাথে ইমেইলে প্রাপ্ত প্রশ্ন প্রিন্ট ও ফটোকপি করে নিল তাদের ছাত্র সংখ্যা অনুযায়ী। এতে ঘন্টাখানেক সময় লাগতে পারে। তাই প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষার হলে আসতে হবে এক ঘন্টা আগে। অন্যদিকে কোন সাত জন শিক্ষক প্রশ্ন তৈরীর সাথে জড়িত তা মন্ত্রী ছাড়া আর কেউ জানতে পারবে না। এমনকি তারা পরীক্ষার দিনের আগে নিজেরা একে অন্যের সম্পর্কেও জানবে না। এতে প্রশ্ন ফাঁসের সম্ভাবনা একেবারে থাকবে না। তারপরও যদি হয় তাহলে কোন কমিটি করতে হবে না। যিনি প্রশ্ন প্রণয়ন করেছেন তিনিই ফাঁস করেছেন হিসাবে প্রমাণিত হবে। এখনকার মত দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ থাকবে না। এখন প্রেসের কর্মচারী বলে শিক্ষক কিংবা কাস্টডিয়ানরা করেছেন। শিক্ষকরা অন্যদের উপর দোষ দেন। সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে সনাক্ত করা যায় না।
বাড়তি খরচ হিসাবে প্রত্যেক পরীক্ষা কেন্দ্রে কম্পিউটার, প্রিন্টার ও ফটোস্ট্যাট মেশিন দিতে হবে। ইন্টারনেট কানেকশন যেহেতু প্রতিটি থানায় রয়েছে তাই তা অসম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় ভরসা আমাদের শিক্ষামন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে সৎ। তাই তাকে নিয়ে এরকম পরিকল্পনা করা যায়। ভবিষ্যতে তাও যদি জাতি না পায় তখন এই পদ্ধতিতেও কাজ হবে না। সমস্যা স্বীকার করে সমাধানের পথ খুঁজলে হয়ত আরও ভাল সমাধান বেরিয়ে আসতে পারে।
দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে মন্ত্রী মহোদয় সব ক্ষুদ্র স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে তাঁর উপর মানুষের আস্থার প্রতি সুবিচার করতে পারলে কোন একটি পথ বেরিয়ে আসবেই। আসতেই হবে। নতুবা জাতির সব সম্ভাবনা আতুড় ঘরেই মারা যাবে।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট