ঘরের মধ্যে অন্ধ মানুষের মত লাঠি নিয়ে হাটাহাটির অভ্যাস করছি। আমার এই চোখ থাকিতে অন্ধের মত হাটাহাটি দেখে বাচ্চারা মজা পেলেও বউয়ের মনে সন্দেহ হয়। সে নাছোড় বান্দা আমি কেন এই প্র্যাকটিস করছি তা তাকে বলতে হবে। শখে করছি বলে উত্তর দিলে সে জানতে চাইল আমি কী কোথাও অন্ধের ভূমিকায় অভিনয়ের অফার পেয়েছি। উত্তরে না বললেও সে শান্তি পাচ্ছিল না। এমন সময় মাথায় একটি বুদ্ধি এল।
তাকে বললাম আসলে আমি চাচ্ছি বাইরে যখন বেরুবো তখন সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করে হাটব। এজন্য প্র্যাকটিস করছি। এবার সে জানতে চাইল কিন্তু কেন? ধরা পড়ার ভয়ে কথা ঘুরিয়ে অন্য দিকে নিয়ে গেলাম।
শোন, বাইরে আজকালের ছেলে মেয়েরা যেভাবে চলাফেরা করে তা দেখা ঠিক নয়। তারা লজ্জা শরম না পেলেও আমি পাই। ঐদিন তোমাকে দেখালাম না রিক্সায় কিভাবে ছেলের হাত পাশের মেয়ের শরীরি মানচিত্রে বিচরণ করছে। তুমি বলছিলে তারা হয়ত স্বামী-স্ত্রী। আমার উত্তর ছিল স্বামী স্ত্রী বেশরমের মত রাস্তা ঘাটে এরকম চলাফেরা করে না। যেমন আমরা স্বামী স্ত্রী হওয়া সত্তে¡ও কী তাদের মত কখনও চলাফেরা করেছি। তখন তুমি কোন জবাব দিতে না পেরে আমাকে বলছিলে তুমি ওদিকে তাকাচ্ছ কেন? কিন্তু তখন তো আমার চোখ খোলা ছিল। সামনে যা আসত তাই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দেখতে হত। এছাড়া আমি রাস্তায় বেরুলে মাটির দিকে তাকিয়ে হাটতে পারি না। চতুর্দিকে তাকাই। আসলে এই সুন্দর পৃথিবী ও বিচিত্র মানুষের বৈচিত্রময় চলাফেরা দেখতে খুবই ভাল লাগে। মাঝে মাঝে কিছু অসভ্যপনা চোখে পড়ে যায়। তাই চিন্তা করলাম এখন থেকে বাইরে অন্ধের মত চলাফেরা করব। আমার কথা সে বিশ্বাস করল কি-না বুঝা গেল না। তবুও আমি তার প্রশ্নের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। এই আমার সন্তুষ্টি। পাছে আসল কথা সে উদ্ধার করে ফেললে আমি যে আসলে ভীতুর ডিম তা তার জানা হয়ে যাবে। অবস্থার হয়ত কোন একসময় উন্নতি হবে, কিন্তু সে সব সময় আমাকে টিজ করবে। এই সুযোগ তাকে দিতে চাই না।
এছাড়া রজব আলী নামে আমার কলেজ জীবনে একজন ইয়ার-মেট ছিল দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তার চলাফেরা দেখে মাঝে মাঝে ইচ্ছে হত চেষ্টা করে দেখি আমি পারি কি-না। তখন চেষ্টা করা হয়নি। এখন যেহেতু সময় বাধ্য করছে তাই চেষ্টা করতে দোষ কি। রজব আলীর চোখে কালো গøাস থাকত। ফ্যাশনের জন্য যারা চোখে কালো চশমা পরেন তাদের থেকে ভিন্ন ছিল ঐ অন্ধ রজব আলীর চশমা। তার হাতে লাঠিও থাকত। রজব আলী এখন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে কাজ করে। তার স্ত্রী সন্তানও রয়েছে। দুই বছর আগে সর্বশেষ পশ্চিম জিন্দাবাজারে তার অফিসে দেখা হয়েছিল। রজব আলীর সংস্থার নাম মনে পড়ছে না। তবে খুব ইচ্ছে করছে তাকে গিয়ে বলি, বন্ধু আমিও চোখ থাকতে তোমার মত হয়ে যাচ্ছি।
পরিকল্পনা মত অন্ধের কালো চশমা ও স্প্রিংয়ের লাঠি কিনে আনলাম। লাঠি জোগাড় করতে অনেক কষ্ট হল। কারণ স্বাভাবিক লাঠি কিনলে তা নিয়ে সব সময় বাইরে বেরুনো যাবে না। স্প্রিংয়ের বিশেষ লাঠি যা ছোট বড় করা যায় এরকম হলে সময় মত বড় করে ব্যবহার করা যাবে। আর স্বাভাবিক সময়ে ছোট করে ব্যাগের ভিতরে রাখা যাবে। বাসায় এনে আবার এগুলো নিয়ে প্র্যাক্টিস করলাম যাতে রাস্তায় যখন অন্ধের অভিনয় করতে হবে তখন যেন তা নিখুত হয়। অনেকটা ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ী চালানোর আগে এম.সি কলেজের খেলার মাঠে গাড়ী চালানো শেখার মত।
এখন বাসা থেকে বেরুনোর সময় ব্যাগে অন্ধ চশমা ও স্প্রিংয়ের লাঠি নিতে ভুল করি না। কারণ কখন প্রয়োজন পড়বে বুঝা কঠিন। এখন অফিস থেকে বেরুবো। কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী প্রতিদিনই বাইরে যেতে হয় কারো না কারো সাথে দেখা করার জন্য। এখন বেলা প্রায় বারটা। জিন্দাবাজার যাব একজন কাস্টমারের সাথে দেখা করার জন্য। কাজ শেষ করে আবার তাড়াতাড়ি অফিসে ফিরতে হবে। বেরুনোর সময় কালো চশমা ও স্প্রিংয়ের লাঠি সাথে নিলাম। জিন্দাবাজারের কাছাকাছি আসার পর রিকশা থেকে নামার আগে চোখে কালো চশমা দিয়ে লাঠি বড় করে নিলাম। ভাড়া দেয়ার সময় রিক্সা ড্রাইভার অবাক। ভালো মানুষ রিক্সায় তুলল অথচ নামার সময় দেখে অন্ধ। অবাক হলেও হয়ত ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। ফ্যাকাশে চেহারায় কোনরকম ভাড়া নিয়ে বিদায় নিল। আমিও অন্ধের ভান করে গন্তব্যের দিকে হাটতে শুরু করলাম।
মানুষ যা ভান করে তা অনেক সময় ভান থেকে বাস্তব হয়ে যায়। হাটতে হাটতে এক সময় আমি সত্যি চোখ বন্ধ করে পুরোপুরি অন্ধের মত হাটতে থাকলাম। বিড়ম্বনা ঘটল তখনই। ভারসাম্য হারিয়ে এক সুন্দরী যুবতীর গায়ের উপর ধাক্কা খেলাম। সাথে যে ছেলেটি ছিল তার কাছে সম্ভবত ধাক্কার স্টাইলটি পুরো অন্ধ মানুষের মত মনে হয়নি। সে বিরক্ত হয়ে আমার মাথায় এমনভাবে ধাক্কা দিল যে তার হাতে লেগে আমার চশমা পড়ে গেল। তখন সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল আমি আসলে অন্ধ নই। আমিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আর তখনই সে আমাকে বদমাইশ মেয়েদের গায়ে পড়ার জন্য অন্ধের বেশ ধরে হাটছে বলে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুসি মারতে শুরু করল। তার কথা শুনে আশ পাশে যারা ছিল তারাও আমার কোন কথা না শুনে শুরু করল গনধোলাই। মুখে সবাই বলছে ভন্ড, প্রতারক, বদমাইশ এভাবে যার যা মুখে আসে। আমি চিৎকার করে বলছি প্লিজ আমার কথা শুনুন আমি ভন্ড, প্রতারক বা বদমাইশ না। আমি পরিস্থিতির শিকার। কে কার কথা শুনে? জীবনে আরেকবার এমন পরিস্থিতির শিকার হলেও এবার জীবনের আশা অনেকটা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এমন সময় পুলিশ এসে গনধোলাই থেকে রক্ষা করল। তারা উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করতে পারছিল না। তাই বলল মামলা দিয়ে এখনই আমাকে আদালতে পাঠাবে। পুলিশের কারণে আপাতত জীবন ফিরে পেলেও মান সম্মান নিয়ে মহা চিন্তায় পড়লাম। এভাবে পরিচিত কেউ দেখলে তাকে কি জবাব দেব? অফিসের সহকর্মীরা কি ভাববে? বউ শুনে যদি চিন্তা করে সুন্দরী মেয়েদের গায়ের উপর ধাক্কা দেয়ার জন্য এতদিন অন্ধের প্র্যাকটিস করেছি তাহলে ঘরে বাইরে আর মান সম্মান থাকবে না। গনপিটুনির কষ্টের চেয়ে এসব চিন্তায় বেশী কাহিল করে ফেলল।
এমন সময় দেখি পুলিশের গাড়ী আমাকে নিয়ে আদালতে হাজির। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবি আমার অপকর্মের বর্ণনা দিয়ে দশদিনের রিমান্ড প্রার্থনা করলেন। তাদের দাবি রিমান্ডে নিয়ে আমার কাছ থেকে কথা বের করতে হবে- কেন আমি চোখ থাকিতে অন্ধের ভান করলাম। তাদের অনুমান আমি বড় কোন অপরাধ বা প্রতারক চক্রের সাথে জড়িত। সরকারী উকিলের এসব বক্তব্য শুনে আমার চোখে পানি চলে আসল। চোখের পানি মুছতে গিয়ে দেখলাম আমার হাত ও মুখ স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। শরীরের প্রত্যেকটি অংশেই গনপিটুনির করুণ চিহ্ন রয়েছে। করুণ চোখে তাকিয়ে আছি বিচারকের দিকে। কারণ আমার পক্ষে কোন আইনজীবি নেই। দয়া পরবশ হয়ে মাননীয় আদালত জানতে চাইলেন আমার কোন বক্তব্য আছে কি-না।
আমি বলতে শুরু করলাম, মাননীয় আদালত আমি অন্ধ নই। গত ৩০শে এপ্রিল থেকে বাসায় অন্ধের অভিনয় শুরু করি যাতে রাস্তা ঘাটে প্রয়োজন মনে করলে অন্ধের মত হাটতে পারি। আমার এই অভিনয় কোন অপরাধ বা প্রতারণার জন্য নয়, শুধু জীবন রক্ষার প্রয়োজনে। বেঁচে থাকার জন্য।
মাননীয় আদালত, শীতলক্ষ্যায় যখন নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুলসহ সাত জনের লাশ ভেসে উঠল তখন আমি এই সিদ্ধান্ত নেই। কারণ ইলিয়াস আলীর ড্রাইভার আনছার আলী, নজরুল ইসলামের ড্রাইভার ও সহকর্মীরা এবং আইনজীবি চন্দন সরকারকে জীবন দিতে হয়েছে শুধুমাত্র চোখের জন্য। গুম ও অপহরনের সাথে জড়িতরা তাদেরকে গুম ও খুন করেছে শুধুমাত্র তাদের অপরাধের চাক্ষুস স্বাক্ষী হওয়ার কারণে। সম্প্রতি সিলেটের প্রবাসী মুজিবুর রহমান মুজিবের গাড়ীর ড্রাইভারকেও সম্ভবত গুম করা হয়েছে একই উদ্দেশ্যে। সারাদেশে গুম, অপহরণ ও খুনের ঘটনা যেভাবে বেড়েছে রাস্তাঘাটে বেরুলে চোখে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আমি চোখ বন্ধ করে বাঁচতে গিয়ে আজ এই বিড়ম্বনায় পড়েছি।
বিচারক মাথা নিচের দিকে দিয়ে লিখতে শুরু করলেন। আমি টেনশনে ঘামতে শুরু করলাম কি আদেশ দিচ্ছেন এই ভেবে। এমন সময় ঘুম ভেঙ্গে গেল। কোন এক মসজিদের মিনার থেকে কানে ভেসে আসল ’আস্সালাতু খাইরুম মিনান নাউম’।