বাংলাদেশ আজ এক আতঙ্কের জনপদ। কে, কখন গুম, খুন কিংবা অপহরণের শিকার হবেন তা আন্দাজ করা মুশকিল। সরকার এসব অপরাধ প্রতিরোধে ব্যর্থ না নিজেই জড়িত তা বুঝা কঠিন। তাই মানুষ আজ সরকারের কাছে কোন নাগরিক বা মানবিক অধিকারই চাচ্ছে না, শুধু বেঁচে থাকার অধিকার ছাড়া। নারায়ণগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও লক্ষীপুরের দিকে তাকালে দেখা যায় প্রতিদিন কেউ না কেউ এই বেঁচে থাকার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের মানুষের অবস্থা আজ ঐ ভিক্ষুকের মত যে বড়লোকের বাড়ীতে ভিক্ষা চাইতে গিয়ে কুকুরের আক্রমণে ভিক্ষা দূরে থাক নিজের ভিক্ষার থলিটিও ফেলে ভোঁ দৌড় দিয়েছিল প্রাণ বাঁচাতে, আর বাড়ীর মালিককে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলছিল ভিক্ষার প্রয়োজন নেই শুধু কুকুর সামলান!
নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র লজরুল ইসলামের গুম ও খুনের পর মেয়র আইভি হায়াতের চেহারা টেলিভিশনের পর্দায় যারা দেখেছেন তারা সত্যিকার দেশবাসীর আতঙ্কিত, ভীত-সন্ত্রস্ত চেহারা সম্পর্কে অনুমান করতে পারবেন। ত্বকী হত্যার পর যে মেয়র প্রতিরোধের বজ্র শপথ নিয়ে গর্জে উঠেছিলেন সেই মেয়রের বর্তমান মনোবল হারা কন্ঠ, আতঙ্কিত ও অসহায় চেহারায় ফুটে উঠেছে দেশের ১৬ কোটি মানুষের উদ্বেগ উৎকন্ঠা ও ভীতির ছাপ। মাত্র কয়েকদিন আগে পরিবেশ আইনজীবি সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী এবি সিদ্দিক অপহরণের রহস্য উন্মোচনের আগেই দিনে দুপুরে সাতজন মানুষকে অপহরণ করা হল, কিন্তু প্রশাসন কিছুই জানল না। তাদেরকে জীবিত উদ্ধার করতেও পারল না। চাঞ্চল্যকর এই অপহরণ ও গুমের যাত্রা শুরু হয়েছিল সম্ভবত ইলিয়াস আলীকে ঘুমের মাধ্যমে। হাই প্রোফাইল এসব গুমের পাশাপাশি সারাদেশে সাধারণ মানুষের গুম, অপহরণ এবং কখনও কখনও তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের কাহিনীতে প্রাণ হারাতে হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষসহ ভিন্নমতের রাজনৈতিক কর্মীদের। এসব দেখার কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না।
অপহরণ ও গুম নতুন কিছু নয়। দেশে এর আগেও এগুলো হয়েছে। এখনকার নৈরাজ্যকর অবস্থার আগে স্বাধীনতার পর পরই গুম, অপহরণ ও খুনের মাত্রা ছিল বেশী। তখন সদ্য স্বাধীন দেশে বিভিন্ন ধরনের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন ছিল বলে শোনা যায়। পরবর্তীতে এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল। কিন্তু বর্তমানে গুম, খুন ও অপহরণ এত ব্যাপকভাবে সারাদেশে বিস্তার লাভ করেছে যে, সারাদেশ আতঙ্কের জনপদে রূপান্তরিত হয়েছে। কারো জীবনের নিরাপত্তা আছে বলে মনে হয় না। প্রথমে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা এর শিকার হলেও দিন দিন এর ব্যাপ্তি বেড়েছে। এখন নারায়ণগঞ্জের মত বিভিন্ন জায়গায় সরকার সমর্থকরাও এর শিকার হচ্ছেন। সরকারী শিথিলতায় কিংবা প্রশ্রয়ে অপরাধের বিস্তৃতি ঘটলে তা এক পর্যায়ে অপরাধের ধর্ম অনুযায়ী পক্ষ বিপক্ষ সব সীমা ছাড়িয়ে সর্বগ্রাসী রূপ নেয়। এজন্য অবস্থার অবনতিতে বিচলিত আওয়ামীলীগ নেতা বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, গুম ও অপহরণ সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তিনি এও বলেছেন এখন আর সরকারকে ’দেখি নাই, জানি না, বুঝি না’ বললে হবে না। এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
কিন্তু মানুষের অভিযোগের আঙ্গুল যখন সরকারী সংস্থার দিকে উঠে আসে তখন সরকার কিভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করবে বলা মুশকিল। ডঃ শাহদীন মালিকের মত আইনজ্ঞ যখন বলতে বাধ্য হন- ’আইন-শৃংখলা বাহিনীর খুবই প্রশিক্ষিত অংশ এসব গুম-খুনে জড়িত’, তখন সাধারণ মানুষ হতবাক হয়। তিনি আরও বলেছেন, সরকার নিশ্চিতভাবে এসব গুম-হত্যাকান্ডের কথা জানে, কিন্তু এর ভয়াবহতা সম্পর্কে অনুভব করতে পারছে না। র্যাবের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীকে নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রত্যাহারের মাধ্যমে জনগনের আস্থা ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। অপহরণ ও হত্যাকান্ডের শিকার নজরুলের শ্বশুড় আরও সাংঘাতিক অভিযোগ আনেন র্যাবের বিরুদ্ধে। তার দাবি ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে র্যাব তার জামাতাকে হত্যা করেছে।
এভাবে ভিকটিম ও সুশীল সমাজের সদস্যদের অনেক বক্তব্য উপস্থাপন করা যায় র্যাবের বিরুদ্ধে যা নজরুল হত্যার পর বিভিন্ন গনমাধ্যমে এসেছে। র্যাবের কাছে হয়ত এসব অভিযোগের জবাব রয়েছে। কিন্তু র্যাবের উপর মানুষের অগাধ আস্থায় যে ধস নেমেছে তা ফিরিয়ে আনা অনেক কঠিন হবে। অথচ র্যাব যখন গঠিত হয়েছিল তখন র্যাবের উপর মানুষের আস্থা ছিল অনেক। পুলিশের গড়িমসি দেখলেই মানুষ র্যাবের উপর ভরসা করত। বিশেষ করে জঙ্গী দমনে র্যাব যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল তা অনস্বীকার্য। তাই জনগন মনে করে র্যাবকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে বেআইনী ব্যবহারের ফলে অত্যন্ত প্রশিক্ষিত এই বাহিনীর কোন কোন অংশে বিচ্যুতি ঘটে থাকতে পারে। এর সমাধানও রাজনৈতিক অস্থিরতা দূরীকরণের মাধ্যমে আইন-শৃংখলা বাহিনীকে দলীয়করণের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার মধ্যে নিহিত।
দলীয় ক্যাডার বা আইন-শৃংখলা বাহিনীর সহায়তা নিয়ে যদি সরকারীদল তাদের প্রতিপক্ষকে গুম-অপহরণের মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে থাকে, তাহলে পরবর্তীতে এসব বাহিনী স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে। তখন তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার কোন নৈতিক শক্তি সরকারের থাকে না। তাই হয়ত মৃত্যুর আলামত পেয়ে নজরুল স্বয়ং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সাথে দেখা করে তার জীবনের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করার পরও সরকার তার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে দেয়া শামীম ওসমানের বক্তব্য অনুযায়ী ঘটনার দশ মিনিটের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানানোর পরও তাদেরকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
এসবই নাগরিক হিসাবে আমাদের উদ্বেগের কারণ। বিরোধীদল গুমের কারণে রেড এলার্ট জারি করেছে এবং তাদের দলের পক্ষ থেকে নেতাকর্মীদের একা চলতে নিষেধ করা হয়েছে। এভাবে যাদের দল আছে তারা হয়ত দলবেধে চলাফেরা করবেন, যদিও নারায়ণগঞ্জে একসাথে সাতজনকে অপহরণ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা যাদের কোন দল নেই, আমাদের করণীয় কি? আমাদেরকে সরকার যেমন আশ্বস্থ করতে পারছে না, তেমনি বিরোধীদলও কোন প্রেসক্রিপশন দিতে পারছে না। দলহীন নির্বাক ভীত নাগরিকদের উদ্বেগের বিষয়টি সরকারের নজরে আনার জন্য সুশীল সমাজের একটি অংশ সংসদ ভবনের সামনে মানব বন্ধনের জন্য দাড়িয়েছিলেন, কিন্তু সরকার তাও করতে দেয়নি। পুলিশ ব্যানার ও মাইক কেড়ে নিয়েছে। বিরোধীদলকে নিয়ন্ত্রণ করে সরকার এখন দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের নিরীহ প্রতিবাদের সুযোগও দিচ্ছে না।
৫ জানুয়ারীর ভোটারবিহীন তামাশার নির্বাচনের মাধ্যমে দেশবাসী ভোটের অধিকার হারিয়েছে। মানুষ যখন সরব হওয়ার কথা গনতন্ত্রের জন্য, একটি অংশগ্রহনমূলক প্রকৃত সাধারণ নির্বাচনের জন্য- তখন নাগরিক অধিকার নয় বেঁচে থাকার অধিকারও খর্বিত হচ্ছে। মানব বন্ধনের মত নিরীহ কর্মসূচীর মাধ্যমে জীবনের অধিকার রক্ষার জন্য সরকারকে সচেতন করার জন্য প্রতিবাদ কর্মসূচীও করতে দেয়া হচ্ছে না। আসলে পরিকল্পিতভাবে দেশকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা কি আমাদের বর্তমান ভাগ্যবিধাতারা বুঝতে পারছেন না। নাকি জেনে বুঝেই তারা আগুন নিয়ে খেলছেন?
তারা কী জানেন না- দাবানলের শিকার হয় বনের সব শ্রেণীর বৃক্ষ ও গুল্ম-লতা। পশু পাখিও নীড় হারা হয়। কোন বনে যখন দাবানলের বিস্তৃতি ঘটে তখন বনের ছোট বড় সব প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবন বিপন্ন হয়। কেউ এর হাত থেকে বাঁচতে পারে না। প্রথম ধাক্কায় হয়ত দুর্বলরা বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ধীরে ধীরে এক সময়ের সবলরাও আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচতে পারে না। তাই অনাকাঙ্খিত বৃক্ষ নিধনের জন্য যেমন দাবানলের সৃষ্টি করা উচিত নয়, তেমনি প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার জন্য আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেআইনী ব্যবহারও ঠিক নয়।
তবে শাসকদলের জন্য আপাত স্বস্তির কারণ হচ্ছে মানুষ এখন আর গনতন্ত্র নিয়ে ভাবছে না। রাষ্ট্রের কে কোথায় কিভাবে দুর্নীতি করছে তাও কারো বিবেচ্য বিষয় নয়। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা থাকলেও তা আর প্রকাশের প্রয়োজন মনে করছে না। শুধু একটাই চাওয়া- বেঁচে থাকার অধিকার, জীবনের নিশ্চয়তা। ঐ ভিক্ষুকের মত যেন দেশবাসী বলছে- ভিক্ষার প্রয়োজন নেই, শুধু কুকুর সামলান!
টেলিভিশনে যখন শীতলক্ষ্যা নদী থেকে লাশ উদ্ধারের দৃশ্য দেখানো হচ্ছিল তখন আত্মীয় স্বজনের কান্নাকাটির দৃশ্যও ছিল। আমার ছোট্র শিশু সন্তানটি তার মায়ের কোলে বসে জানতে চাইল ওরা কাঁদছে কেন? তার মায়ের জবাব ওর বাবা নাই। আবার প্রশ্ন নাই কেন? তখন ২২ মাস বয়সী ছেলেকে ঘটনাটি বুঝানোর মত কোন জবাব তার কাছে ছিল না। তিনি জবাবের আশায় আমার চোখের দিকে তাকালেন। আমিও নিরুত্তর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এরকম বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় না, কারণ উনার ছেলে-মেয়ের গুম-অপহরণের নির্মমতা বুঝার বয়স হয়ে গেছে অনেক আগে। তাই দয়া করে আমাদেরকে একটা যুৎসই জবাব শিখিয়ে দিলে খুবই উপকার হয়। নতুবা এমন পদক্ষেপ নিন যাতে আর এরকম দৃশ্য দেখে কাউকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে না হয়।