মানুষ জন্ম গ্রহন করে কোন একটি দিনের সুনির্দিষ্ট সময়ে। সারাবিশ্বের প্রায় সাতশত কোটি মানুষের মধ্যে কারো পক্ষেই একাধিক দিনে জন্মগ্রহন করা সম্ভব নয়। শুধু মানুষ নয়, ঐতিহাসিক যেকোন ঘটনাও কোন নির্দিষ্ট সময়ে ঘটে থাকে। কিন্তু সময়ের হিসাব নিকাশের পার্থক্যের কারণে একই ঘটনাকে একাধিক তারিখে দেখানোর সুযোগ তৈরী হয়।
আজকে যে ইংরেজী ক্যালেন্ডার আমরা ব্যবহার করি তা অনেক পরিবর্তন ও সংস্কারের পর বর্তমান অবস্থায় এসেছে। বর্তমান ক্যালেন্ডারের আগে জুলিয়াস সিজার প্রবর্তিত ক্যালেন্ডার ছিল যা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার হিসাবে পরিচিত। ১৫৮২ সালে বছরের দৈর্ঘ্য পরিবর্তন করে প্রবর্তন করা হয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার যা বর্তমানে ইংরেজী ক্যালেন্ডার হিসাবে পরিচিত। প্রায় দুইশত বছরের মত বিভিন্ন দেশে উভয় ক্যালেন্ডারের তারিখই ব্যবহার করা হত। যদিও উভয় ক্যালেন্ডারে দিনের হিসাবে প্রায় এগারদিনের ব্যবধান। যেমন জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের জন্মদিন হচ্ছে ১১ই ফেব্রুয়ারী, অন্যদিকে বর্তমান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তা ২২শে ফেব্রুয়ারী। মার্কিনিরা অবশ্য এই দুই দিনের কোনটিই তাদের ফেডারেল ছুটি প্রেসিডেন্টস ডে হিসাবে পালন করে না। আগে ২২শে ফেব্রুয়ারীতে জন্মদিনের ছুটি পালন করলেও এখন প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাসের তৃতীয় সোমবারকে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে বর্তমানে বিশ্বে যারা বেঁচে আছেন এবং শুধু ইংরেজী ক্যালেন্ডার ব্যবহার করেন তাদের জন্মদিন একাধিক হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ কয়েকশত বছর থেকে বিশ্বে একটি ইংরেজী ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে।
কিন্তু বাংলাদেশে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয় তিনটি। অফিস-আদালতের জন্য ইংরেজী, কৃষিকাজে বাংলা এবং ধর্মীয় কাজে আরবী ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয়। এজন্য কেউ যদি তার জন্মদিন হিসাবে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন তারিখ ব্যবহার করে তবুও ভুল বলার সুযোগ নেই। আরবী তারিখ প্রতিবছর দশদিন এগিয়ে আসে। তাই প্রতিবছর একই দিনে ঈদ উদযাপন করা হয় না। বাংলা ও ইংরেজী তারিখ পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কর্তৃক বাংলা সাল সংস্কারের ফলে তাও নড়ে চড়ে বসেছে। তাই ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ছিল ৮ই ফাল্গুন, এখন তা হয়েছে ৯ই ফাল্গুন। এজন্য সঙ্গতকারণে বাংলাদেশের মধ্য বয়স্ক যেকোন মানুষ ইংরেজী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী একদিন, বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অন্যদিন এবং আরবী তারিখ অনুযায়ী আরেকদিন- এভাবে বছরের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দিনকে জন্মদিন হিসাবে পালন করতে পারে।
এভাবে তিনটি তারিখে জন্মদিন পালন করলে কারো বলার কিছু ছিল না। এতে অসত্য কিছু নেই। সমস্যা হচ্ছে দেশের সবাই মোটামুটি ইংরেজী ক্যালেন্ডারে অভ্যস্ত। আরবী ক্যালেন্ডার রোজা পালন, ঈদ উদযাপন ও ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ দু’একটি দিন পালনের জন্য ব্যবহার করা হয়। বাংলা ক্যালেন্ডার শুধুমাত্র পহেলা বৈশাখ পালনে গুরুত্ব পায়। এছাড়া পৌষ সংক্রান্তি আর বসন্ত বরণ ব্যতীত বাংলা কোন তারিখ কারো চোখে পড়ে বলে মনে হয় না। বাদ বাকি সব কাজই করা হয় ইংরেজী তারিখ অনুযায়ী। বিশেষ করে জন্মদিন ইংরেজী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পালনে সবাই অভ্যস্থ। তবুও মধ্যবয়স্ক বেশীরভাগ মানুষের একাধিক জন্মদিন রয়েছে। তাও আবার প্রচলিত ইংরেজী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ভিন্ন দুটি ক্যালেন্ডারে নয়।
আপাত অসম্ভব বিষয়টি আমাদের দেশে সম্ভব এবং বেশীরভাগ মানুষেরই দুটো জন্মদিন। একটি মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নেয়ার তারিখ অনুযায়ী আর অন্যটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সময় আরোপিত। আবার কখনও কখনও নতুন আরেকটি জন্মদিনের উদ্ভব হয় বিভিন্ন উন্নত দেশে মাইগ্রেশনের সুবিধার্থে। আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সময় শিক্ষকরা ইচ্ছামত জন্ম তারিখ বসিয়ে দিতেন। অভিভাবককে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধ করতেন না। অভিভাকরাও এত সচেতন ছিলেন না। এক্ষেত্রে শিক্ষকরা তাদের ছাত্রদের জন্য দুটো তারিখকে খুব বেশী পছন্দ করতেন। একটি হচ্ছে পহেলা জানুয়ারী আর আরেকটি একত্রিশে ডিসেম্বর। এতে ক্লাসের ছাত্রদের বয়স সবারই প্রায় সমান থাকত। এ নিয়ে মজার একটি জোকস রয়েছে। একবার বিদেশী দুতাবাসের একজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা তার এক বাংলাদেশী বন্ধুকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন তোমাদের দেশে মেয়েরা কিভাবে কনসিভ করে এবং কিভাবে ডেলিভারির ব্যবস্থা করা হয় তা আমাকে একটু বুঝিয়ে বল। বাংলাদেশী ভদ্রলোক প্রশ্নের মোটিভ না বুঝে উল্টো জানতে চাইলেন এ প্রশ্ন কেন? তোমাদের দেশে যেভাবে জৈবিক এ বিষয়টি হয় একইভাবে আমাদের দেশেও হয়। তখন কর্মকর্তা বললেন না আমাদের দেশে বছরের যেকোন দিন একটি শিশু জন্ম নিতে পারে, কিন্তু তোমাদের দেশে দেখলাম বেশীরভাগ মানুষের জন্মদিন হয় পহেলা জানুয়ারী, না হয় একত্রিশে ডিসেম্বর। তখন বাংলাদেশী বন্ধু হেসে দেশের বেশীরভাগ শিক্ষিত মানুষের আরোপিত জন্মদিনের বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন।
সার্টিফিকেটে উল্লেখিত জন্মদিনটি চাকরি বাকরিসহ ডকুমেন্টারি কাজে ব্যবহৃত হলেও জন্মদিন পালন করা হয় আসল দিনে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিতর্ক রয়েছে। একজন শীর্ষ নেত্রীর জন্মদিন পালন নিয়ে প্রতিপক্ষ অনেকে ব্যঙ্গ করে থাকেন মূলত পালিত জন্মদিন ও সার্টিফিকেটের জন্মদিনের অমিলের বিষয়টি উল্লেখ করে। এভাবে দেশের জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশ সার্টিফিকেটে মিথ্যার সিল নিয়ে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করছে। দেশে যত মিথ্যা, প্রতারণা ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটে তার বেশীরভাগই শিক্ষিত লোকের দ্বারা হয়ে থাকে। এই তথাকথিত দুর্নীতিবাজ শিক্ষিত সমাজের এসএসসির সনদের ভুল জন্ম তারিখটির কোন ভূমিকা রয়েছে কি-না তা কেবল গবেষকরাই বলতে পারবেন। তবে একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই ভুলের বোঝা অনেকেই বহন করছেন। আবার অনেকেই চালাকি করে সার্টিফিকেটে বয়স কমানোর ফলে চাকরির ক্ষেত্রে সুবিধা পাচ্ছেন বলে বেশ গর্ববোধও করেন।
একাধিক জন্মদিনের ক্ষেত্র তৈরী হয়েছিল বাধ্যতামূলক জন্মনিবন্ধন আইনের অনুপস্থিতিতে। ২০০৪ সালে বাংলাদেশে জন্মনিবন্ধন আইন পাস হয়। এ আইন অনুযায়ী শিশু জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন করতে হয়। তবে দুই বছরের মধ্যে নিবন্ধন না করলে জরিমানার বিধান রয়েছে। এখন যেকোন শিশু স্কুলে ভর্তি হতে হলে জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেট লাগে। ফলে একাধিক জন্মদিন উদ্ভবের সুযোগ নেই। জীবনের শুরু থেকেই একটি মিথ্যার হাত থেকে শিশুরা রক্ষা পেয়েছে।
কিন্তু এ মিথ্যা একেবারে দূরীভুত হয়নি। বিষয়টি ধরা পড়ল যখন আমার মেয়েকে স্কুলে ভর্তির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের খোঁজ খবর নিতে শুরু করলাম এবং অনেকের সাথে এ ব্যাপারে কথা হল। প্রথমেই আমি আবিষ্কার করলাম আমার সময়ের ভর্তির সাথে এখনকার ভর্তির বড় একটি তফাৎ হচ্ছে আমরা ভর্তি হয়েছিলাম প্রথম শ্রেণীতে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আর আমার মেয়েকে ভর্তি করতে হবে কিন্ডার গার্টেন স্কুলে প্লে গ্রুপে যেখান থেকে প্রথম শ্রেণীতে উঠতে তিন বছর পাড়ি দিতে হবে। কারণ এখন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার পরিবেশ নেই বলেই ব্যাপকভাবে ধারনা করা হয় এবং অন্যান্য বিভিন্ন মাধ্যমের বেসরকারী (ব্যবসায়িক) বিদ্যালয় গুলোতে সবাই প্লে গ্রুপ থেকেই শুরু করে। হঠাৎ কেউ প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করতে গেলে সমস্যায় পড়বে। তাই আগে যেখানে বয়স ছয় এর কাছাকাছি হলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করা হত, এখন বয়স থ্রি প্লাস হলেই প্লে’তে ভর্তি করতে হয়। অনেক দ্বিধা দ্বন্ধের পর শহরের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে প্লে’তে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিলাম। মেয়ে স্কুলে যেতে চাইবে কি-না এ নিয়ে ভয় ছিল। এছাড়া এত অল্প বয়সে পারিবারিক পরিবেশের বাইরে থাকতে চাইবে কি-না সেও এক ভাবনা। এই ভাবনা দূর করতে পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে আসলেন আমার এক আইনজীবি বন্ধু। তিনি বললেন আরও এক বছর পর স্কুলে ভর্তি করান। আমি যখন বললাম তিন বছর লাগে প্রথম শ্রেণীতে উঠতে তাই দেরী হয়ে যাবে। তখন তিনি বললেন কোন সমস্যা নেই জন্মদিনটা ঠিক রেখে সালটা এক বছর পিছিয়ে নতুন একটি জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট নিয়ে আসেন। এতে আপনার মেয়ের জন্মদিনে কোন হেরফের হবে না, শুধু বয়স এক বছর কমে যাবে। এতে সুবিধা হচ্ছে মেয়েটি তার ক্লাসের অন্যদের তুলনায় অধিক ম্যাচিউরড হবে এবং পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করবে। এসব চিন্তা করে তিনি নিজের ছেলেকে এ পদ্ধতি অবলম্বন করেই ভর্তি করিয়েছেন। মুখে কিছু না বলেই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছি এ পদ্ধতিতে আমার সায় নেই।
সেদিন ভদ্রতাবশত তাকে কোন জবাব দেইনি। তবে বিষয়টি মাথা থেকে বের হতে চাচ্ছে না। জন্ম নিবন্ধন আইন পাশের পর আমাদের সন্তানরা একাধিক জন্মদিনের হাত থেকে মুক্তি পেলেও মিথ্যা বয়সের বোঝা থেকে কি মুক্তি পাবে না? মিথ্যার বৃত্ত থেকে বের হওয়ার কোন চেষ্টাই কী আমরা করব না?