চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম দফা ভোট গ্রহণ শেষ হল ১৯ শে ফেব্রুয়ারী। ৯৭ টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আইন অনুযায়ী উপজেলা পরিষদ স্থানীয় সরকারের অংশ বিধায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মত দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়ার কথা নয়। অথচ বাস্তবে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হচ্ছে। মিডিয়ায় নির্বাচনের ফলাফলও দলীয় ভিত্তিতে ঘোষণা করা হচ্ছে। নির্বাচনে শুধুমাত্র দলীয় প্রতীক ব্যবহার করা হচ্ছে না। এছাড়া সবকিছুই হচ্ছে দলীয় ভিত্তিতে। মানুষ উৎসবের আমেজে অংশ নিয়েছে এ নির্বাচনে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও অধীর আগ্রহে বসে আছেন নির্বাচনী ফলাফলের জন্য। কারণ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধীদল ও তাদের জোটের অংশগ্রহণ না থাকায় জরিপি জনমত ব্যতীত প্রকৃত জনমত পাওয়া যায়নি। প্রথম দফার নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় বিএনপি-৪৩, আওয়ামীলীগ-৩৪, জামায়াত-১৩ এবং জাতীয় পার্টি-১ টি উপজেলায় নির্বাচিত হয়েছে। বাকী উপজেলাগুলোতে স্বতন্ত্র ও পার্বত্য চট্রগ্রামের আঞ্চলিক দু’একটি দল নির্বাচিত হয়েছে। বিএনপি জনগনের সমর্থনে এগিয়ে আছে, এ বিষয়টি বিগত প্রায় তিন বছর থেকে দেশে ও বিদেশে ব্যাপকভাবে চাউর হয়ে আছে। উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলও তা সমর্থন করে। তবে আওয়ামীলীগ ও জামায়াতের অর্জিত ফলাফল পত্র পত্রিকার মাধ্যমে পাওয়া পাবলিক পারসেপশনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বিগত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সবকটিতে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিল বিএনপি। বিশেষ করে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের পর জনমনে এমন ধারনা জন্মেছিল যে, এদেশে সম্ভবত আওয়ামীলীগের দিন ফুরিয়ে আসছে। বিএনপিও আত্মবিশ্বাসে চাঙ্গা ছিল। এ ধরনের অনুমানের কারণে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান দুটি দলের মধ্যে কোন সমঝোতা হয়নি। সরকারী দল সমঝোতার প্রক্রিয়া এড়িয়ে একদলীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে গেছে। কারণ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় জেনে কেউ গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না। এ পটভূমিকায় অনেকের কাছে মনে হয়েছিল উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামীলীগের অবস্থা শোচনীয় হবে। অথবা আওয়ামীলীগ ক্ষমতার জোরে কারচুপির মাধ্যমে বেশীরভাগ উপজেলায় বিজয় ছিনিয়ে নেবে। কিন্তু বাস্তবে এর কোরটিই হয়নি। কয়েকটি উপজেলায় কেন্দ্র দখলের যে অভিযোগ বিএনপির পক্ষ থেকে করা হয়েছে তা প্রায় সব নির্বাচনেই হয়ে থাকে। প্রথম দফা নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সম্মানজনক সংখ্যক উপজেলায় জয়ী হয়েছে। প্রায় সব উপজেলায় আওয়ামীলীগের সাথে বিএনপি ও জামায়াতের তুমুল প্রতিদ্বন্ধিতা হয়েছে। এ অবস্থা আওয়ামীলীগকে জনগণের উপর হারানো আস্থা ফিরে পেতে সাহায্য করবে। হয়ত একটি অংশগ্রহণমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতার ইতিবাচক ধারায় রাজনীতিকে চালিত করতেও সাহায্য করতে পারে। কারণ প্রধান দুটি দলের কাছে উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল এই বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছে যে, রাজনীতি থেকে কারো পক্ষে অপর পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়।election-by-district
এই নির্বাচনে সবচেয়ে অভাবনীয় বিজয় অর্জন করেছে জামায়াত। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের রাজনীতিতে সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত রাজনৈতিক দল জামায়াত। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময়ের ভূমিকা ও ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতার কারণে যেমন রয়েছে রাজনৈতিক বিতর্ক, তেমনি ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সাথে রয়েছে অনেক ধর্মীয় বিষয়ের ব্যাখ্যা নিয়ে বিতর্ক। বিশেষ করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের বিতর্কিত ভূমিকা জাতীয় রাজনীতিতে অনেক তিক্ততার জন্ম দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী অন্য রাজনৈতিক দলগুলো এখন আর কার্যকরভাবে ক্রিয়াশীল না থাকায় মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত সবার দৃষ্টি জামায়াতের দিকে। জামায়াত আত্মপক্ষ সমর্থন করে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতার কথা স্বীকার করলেও হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মত অপরাধের দায় বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। অনেকের মতে, এসব অপরাধের দায় তদন্ত সাপেক্ষ বিচারিক বিষয় হলেও পরোক্ষ দায় অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ পাক হানাদারদের দ¦ারা বাবা-মা হারানো কোন সন্তানের কাছে খুনী পাক আর্মি হলেও হানাদারদের রাজনৈতিক সহযোগী হিসাবে জামায়াতের অবস্থান। এই পরোক্ষ দায় মুক্তির কোন উদ্যোগ নেয়নি জামায়াত তাদের অনমনীয়তার কারণে। মরহুম মাওলানা আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে দলের নাম পরিবর্তন করে লজ্জা ও বিতর্কের হাত থেকে মুক্তির চেষ্টা করা হয়েছিল। দলের বেশীরভাগের অনঢ় ও অনমনীয়তার জন্য তৎকালীন জামায়াত প্রধান মাওলানা আব্দুর রহিম দল ছেড়ে দেন। জামায়াত তার আগের অবস্থানে অনঢ় থাকে। দেশের সচেতন মানুষের প্রত্যাশা ছিল একাত্তরের রাজনৈতিক ভুলের জন্য জামায়াত জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, কিন্তু তারা তা করেনি। এই সুযোগে জামায়াতের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা সব সময়ই একাত্তরের সকল অপরাধের অভিযোগের আঙ্গুল জামায়াতের দিকে তুলে রেখেছে। জনগনের বিশাল একটি অংশ জামায়াতকে সক্রিয়ভাবে অপছন্দ করে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর জামায়াত ১০ টি আসনে বিজয়ী হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি অংশ নড়েচড়ে বসে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মাধ্যমে জামায়াতের রাজনীতির সক্রিয় বিরোধীতা শুরু হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোট বিজয়ী হওয়ার পর জামায়াতের দুজন নেতাকে মন্ত্রী বানিয়ে গাড়িতে পতাকা তুলে দেয়। এ দৃশ্য অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে ক্ষুব্ধ করে, কারণ পতাকাবাহী গাড়ির মালিক যেখানে এই পতাকা অর্জনের বিরোধীতা করে এখনও রাজনৈতিক ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেননি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামীলীগ জনগনের এই সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করে এবং সারাদেশে জামায়াত শিবিরের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। জামায়াত শিবিরের উপর রাজনৈতিক নিপীড়ন শুরু হয়। মামলা আর পুলিশি নির্যাতনের ভয়ে তারা অনেকটা ব্যাকফুটে চলে যায়। কিন্তু উপজেলা পরিষদের প্রথম পর্বের ফলাফল জামায়াতকে আবার লাইম লাইটে নিয়ে আসে। সবাইকে অবাক করে তারা ৯৭ টির মধ্যে ১৩ টি উপজেলায় চেয়ারম্যান ও ২৩ টি উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। পত্র-পত্রিকার খবর অনুযায়ী যেখানে আওয়ামীলীগ ২৪টি উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। এখন সচেতন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এত মামলা ও নির্যাতনের পরেও জামায়াত কিভাবে এই ফলাফল অর্জন করল? সাংবাদিকরা তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে প্রশ্ন করলে জবাবে তিনি বলেন, আমি জানিনা মানুষ কেন জামায়াতকে ভোট দিল।
অনেকের মতে জামায়াতকে প্রতিহতকরণের সরকারী কৌশল বুমেরাং হয়েছে। ক্যাড়ারভিত্তিক গনবিচ্ছিন্ন দল জামায়াত বর্তমান সরকারের ভুল নীতির কারণে জনগনের সহানুভুতি অর্জন করতে সফল হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের মানুষ সব সময় নির্যাতিত মানুষের পক্ষে নিরব সমর্থন দিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক জনাব নুরুল কবিরের টকশোতে বলা একটি কথা আজ বার বার মনে পড়ছে। বিভিন্ন বাসা বাড়ি থেকে যখন শিবিরের ছেলেদের গ্রেফতার করা হচ্ছে অস্ত্র নয়, সরকারী ভাষ্য অনুযায়ী জেহাদী বইসহ, তখন জনাব নুরুল কবির সরকারকে সতর্ক করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যেসব ছাত্রদের কাছে অস্ত্র নয়- বই থাকে তাদেরকে পুলিশি নির্যাতন ও পেশীশক্তি দিয়ে পরাজিত করা যায় না, রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হয়। আদর্শিকভাবে প্রতিহত করতে হয়। জানিনা নির্বাচনী এই ফলাফলের পর সরকারের নীতিনির্ধারকরা জনাব নুরুল কবিরের সাথে একমত হবেন কি-না।
তবে এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সবাইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে রাজনীতির ময়দান থেকে কাউকে নিশ্চিহ্ন বা নির্মূল করা সম্ভব নয়। বিএনপির প্রত্যাশা অনুযায়ী আওয়ামীলীগ যেমন শোচনীয়ভাবে জনগন দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়নি, তেমনি আওয়ামীলীগের ধারনা অনুযায়ী জামায়াতের রাজনৈতিক প্রভাব নির্মূল হয়নি। বরং উল্টো হয়েছে। আনুমানিক ৪/৫ শতাংশ মানুষের সমর্থনপুষ্ট দলটি প্রথম দফার ফলাফল অনুযায়ী প্রায় ১৪ শতাংশ উপজেলায় নির্বাচিত হয়েছে। তাই সব পক্ষেরই উচিত রাজনৈতিক কৌশল ও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ভুলের সংশোধনের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া যাতে সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা যায়। একগুয়েমী, উগ্রতা, প্রতিহিংসা ও সহিংসতা কোন সমাধান নয়, বরং সবার নমনীয় ও গনতান্ত্রিক পরিবেশে শান্তিপূর্ন সহাবস্থানের নীতিই দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারে। আশা করি বাস্তবতা উপলব্ধি করে দেশের মানুষকে শান্তি ও উন্নয়ন উপহার দিতে রাজনীতিকরা সাধ্যমত চেষ্টা করবেন।