এবার পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় চাইনিজ কুড়াল মেরে মেরির মুখমন্ডল বিকৃত করে দিল বখাটের দল। বেনাপোলে প্রতিবাদ সভা করায় ছাত্রী ও শিক্ষকদের বোমা মেরে উড়িয়ে দেবার হুমকি দিল আরেক দল।
ইভ টিজাররা- এখন শুধু টিজিং পর্যায়ে নেই। ইভ-হন্তাতে রূপ নিয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে- সহজ, সরল, বন্ধুবৎসল, পরপকারি বাঙালীর প্রকৃতি তো কখনো এরূপ কুৎসিত ছিলনা! এ কোন হাওয়া লাগলো, কোন ভ্রান্তির তোড়ে আজ ভাষার জন্য অকাতরে প্রাণ দেয়া বাঙালীর সন্তানেরা বাঁকা ও সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের পথ বেছে নিল? সমাজকে সঠিক পথনির্দেশনা দেয়ার দায় থেকে কিন্তু কেউ দায়িত্ব এড়াতে পারবেনা।
দেবাশীষ, রাজন, সুশীল চন্দ্র বর্মন- এই নামগুলো মানুষের হলেও এদের কাম পশুকেও হার মানায়। এগুলো কয়েকটি নমুনা মাত্র। এদের মত পশুর চেয়েও অধমদের কামুক লালসার হাত থেকে বাংলার কন্যা, ভগ্নী, জায়া ও জননীরা যে নিস্তার পাচ্ছেনা তা প্রতিদিনের প্রত্রিকাই সাক্ষ্য বহন করছে। গত বছর এসব মানুষরূপী পশুদের শিকার হয়েছিল ৭৮ জন। এ বছর জানুয়ারী থেকে আগষ্ট পর্যন্ত পরিসংখ্যান অনুসারে তা বেড়ে দাড়িয়েছে ৩৫৩ জন বা তার চেয়ে কিছু বেশী বই কম নয়। বৃদ্ধির হার দেখলেই ভয়াবহতা অনুমান করতে অসুবিধা হবার কথা নয়। শুধু তাই নয়, গত দশ মাসে এদের কুৎসিত লালসার শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে ২৬ জন নিরপরাধ নারীকে। এরা শক্তের ভক্ত, নরমের যম। তাই আর দেরী নয়- এখনই সময় এদের শক্ত হাতে দমন করার। এটি এখন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়- তাই হালকা ভাবে নেয়াটা হবে সবচেয়ে বড় বোকামি। প্রচলিত আইনে যদি এদের শাস্তির সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকে, তাহলে অতি সত্তর আইন প্রনয়ণ ও বিশেষ আদালত গঠন কোরে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে দু'-চারটারকে জনসমক্ষে কঠিন সাজা দিলে অন্যরাও কেঁচ হয়ে যাবে। যদি এদের পক্ষ হয়ে পক্ষপাতিত্ত্ব মূলক আচরন চলতেই থাকে, তাহলে একসময় জনগণই যে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হবে- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং এ ধরনের অরাজক পরিবেশের হাত থেকে গোটা জাতিকে রক্ষার জন্য প্রশাসন ও আইন বিভাগকে সর্বদা সচেতন ও তৎপর হতে হবে।
মেয়েরা যে শুধুমাত্র রাস্তায়, অলিতে-গলিতে, বিভিন্ন বিদ্যাপিঠের আশেপাশেই বখাটেদের দ্বারা উত্যক্ত হচ্ছে তা নয়। কর্মস্থল এমনকি সমাজ তথা পরিবারের অভ্যন্তরেও মেয়েদেরকে উত্যক্ত করার ঘটনা কম নয়। এরূপ অস্বস্থিকর পরিবেশ থেকে মুক্তির জন্য কঠোর আইন ও শাস্তির ব্যবস্থা করা যে খুবই জরুরী তা অস্বীকার করার উপায় নেই, তবে এর পাশাপাশি যুব সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়ার পেছনে যে মূল কারণগুলো কাজ করছে সেগুলোও চিহ্নিত করতে হবে। বিশেষ কোরে সর্বোচ্য বিদ্যাপিঠগুলোতে যখন এ ধরনের ঘটনার নজির দিন দিন বেড়েই চলেছে, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে- গতানুগতিক ধারায় শিক্ষিত হওয়া সত্বেও কেন দিন দিন এ ধরনের অমানবিক ও অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে?
মেয়েদের যারা উত্যক্ত করে তারা এ সমাজেরই বাসিন্দা। দিনের পর দিন একদিকে বখাটেদের উত্যক্ত ও অপমান, অপরদিকে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে এর কোন প্রতিকার না পেয়ে ইতিমধ্যেই কয়েকজন স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী মানসিকভাবে ভেঙে পরায় শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। সুতরাং উত্যক্তকারীরা শিক্ষিত, অশিক্ষিত, যত ভাল ঘরের বা ধনীর দুলাল হোক না কেন তাদের এ আচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ বটে। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন উত্যক্তকারীকে আটক করা হয়েছে এবং অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। এ থেকে বুঝে নেয়া যায় যে, এ ব্যাপারে প্রশাসনও বেশ তৎপর আছে । কিন্তু শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিলেই কি সমস্যাটির সুষ্ঠ সমাধান হবে?
সমস্যাটা যেমন জটিল, সমাধানও তার চেয়ে কম জটিল নয়। তবে এর সুষ্ঠ সমাধানের কাজটা কোথা থেকে ও কিভাবে শুরু করতে হবে সেই দিকনির্দেশনাটা খুবই জরুরী। কেননা তথাকথিত সভ্যদেশ বলতে আমরা যাদেরকে বুঝি সেই পশ্চিমা দেশগুলোও এ সমস্যা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত নয় । যদিও সেখানকার ঘটনার ধরন এবং আমাদের দেশের ঘটনার ধরন ও প্রকৃতি কিছুটা ভিন্ন। তথাপি দুটোর ক্ষেত্রেই মনস্তাত্বিক ভাবাদর্শ ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি। সেইসাথে যৌন আবেদনকে উস্কে দেয়ার মত পর্ণ-পত্রিকা, ব্লুফিল্ম ও ঘরে ঘরে প্রদর্শিত ছায়াছবির খপ্পরে পরে শুধু যুব সমাজই নয়, কচি বয়েসের ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও যে কম বেশী প্রভাবিত হচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
একজন শিক্ষিত ব্যক্তি যখন রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্যক্ত করে তখন বুঝতে হবে যে, শিক্ষার আলো তার হৃদয়কে ছুঁতে পারেনি। ফলে তার ব্যক্তিত্ব ও নৈতিকতা এমন পর্যায়ে উন্নিত হয়নি যা তাকে এরূপ ছ্যাবলামো কাজ করা থেকে বিরত রাখবে। এ ধরনের অর্ধ শিক্ষিত ইভ টিজিং, সাইবার মবিং কারিদের জন্য এমন ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে যা তাদের বিবেককে নাড়া দেবে। অশিক্ষিত হলে প্রথমত কাউন্সিলিং এর কথা ভাবা যেতে পারে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রতিরোধও বেশ বড় ভূমিকা রাখতে পারে। প্রয়োজনে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
অনেক সময় দেখা যায় বখাটেরা শুধু একটি মেয়েকেই নয়, গোটা পরিবাটিকেও জিম্মী করে রাখে। এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য পাড়া বা মহল্লার বিভিন্ন পরিবার থেকে প্রতিনিধি নিয়ে বিশেষ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। কোন পরিবার বখাটেদের দ্বারা আক্রান্ত হলে এই কমিটি তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে এবং সবাই মিলে এর প্রতিবাদ করবে ও প্রতিকারের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পারবে। সমাজে এমন কিছু ব্যক্তি বাস কের যাদেরকে ভাল কথা বলে সচেতন করতে চাইলে উল্টো তেড়ে আসে। এরা শক্তের ভক্ত, নরমের জম। এইসব চৈতন্যহীন ঘাড়ত্যাড়াদের কয়েকজনকে ধরে কঠিন সাজা দিলে বাকীরাও সাইজ হয়ে যাবে।
কাজেই এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল স্তরের জনগণকে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। ইভ-টিজিং যে নৈতিকতা বিবর্জিত ও ব্যক্তিত্বহীন একটি কু-কর্ম, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই ছেলেমেয়েদের মনে সেই বোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। বিশেষ করে মেয়েরা যেন মানসিকভাবে সহজে ভেঙে না পড়ে সেই ধরনের মনস্তাত্বিক সাপোর্ট দিতে হবে। তাদের জীবন যে অনেক মূল্যবান সেই বোধ জাগাতে পারলে তারা নিশ্চয় সামান্য একজন বখাটের কারনে আত্মহত্যার পথ বেছে না নিয়ে বরং তার প্রতিবাদ করতে শিখবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি পারিবারিকভাবেও কু-সংস্কারমুক্ত স্বচ্ছ ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের উপরে যেন বখাটেরা প্রভাব খাটতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে না পারলে সমস্যার সমাধান করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি সরকারকে সময় উপযোগী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
"ইভ-হন্তাদের জন্য অতি সত্তর আইন প্রণয়ন ও বিশেষ আদালত গঠন কোরে দ্রুত বিচার ও শাস্তির প্রক্রিয়া তরান্বিত করার জন্য মাননীয়া প্রধানমন্ত্রির কাছে জোর আবেদন জানাচ্ছি"
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০১২ দুপুর ১২:৩৮