আগের পর্বের লিংক দীর্ঘতম বাস যাত্রা ( ২য় পর্ব)
গ্রীক ইমিগ্রেশন অফিসের টেবিলের উপর আমার ব্যাগের প্রতিটা আইটেম ছড়ানো।
একটা একটা করে আইটেমগুলো খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে , এক তরুণ ইমিগ্রেশন অফিসার।
আইল্যান্ড ট্রিপে স্যুভেনির হিসেবে কিছু ভাস্কর্য কিনেছি। অসাধারণ সুন্দর। বিশেষ করে কিউপিড এবং সাইকি’র ভাস্কর্যের আবেদন উপেক্ষা করার মতো নয়। চোখের সামনে তুলে ধরে, অনেকক্ষণ সময় নিয়ে উল্টে পালটে দেখলেন। কানের কাছে নিয়ে ঝাকিয়ে শব্দ শোনার চেস্টা করছেন এখন। ব্যাপারটা যেন এমন যে, কানের কাছে ঝাঁকি দিলে সাইকি কিংবা কিউপিড নিজেরা কি বলছে, তা শুনতে পারবে! প্রতিটা ঝাঁকির সাথে আমার আত্না কেঁপে কেঁপে উঠছে। যেভাবে ঝাঁকাচ্ছে, কখন যে হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায় !
রাজকুমারী সাইকি’র রূপসৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তাকে মর্ত্যের মানবী নয়, স্বর্গের দেবী মনে করে পুরুষেরা পুজা করতে শুরু করে। ফলে দেবী ভেনাসের মন্দিরে পুজারী কমে যায়। সৌন্দর্যের দেবী ভেনাস এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তার ছেলে প্রেমের দেবতা কিউপিডকে সাইকির ওপর এমন প্রেম তীর নিক্ষেপ করতে বলেন যাতে সাইকি পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত চেহারার অধিকারিনী হয়। আর না হলে, ঘুমন্ত সাইকিকে প্রেমের তীর মেরে তার সামনে একটা শূকরকে রাখতে বলেন। এতে ঘুম থেকে উঠে সাইকি শূকরের প্রেমে পড়ে যাবে। কিন্তু সাইকি’কে দেখে কিউপিড নিজেই তার প্রেমে পড়ে যায়। মা ভেনাস আরো ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে।
এর পরে ঘটনা অনেক দূর গড়ায়। কিউপিডকে পাওয়ার জন্যে ভেনাসের দেয়া তিনটি শর্ত পুরনে সাইকি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, এক পর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়ে। গল্পের শেষ দৃশ্যটি ভাস্কর্যে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যেখানে কিউপিড অচেতন সাইকিকে জাগিয়ে তুলছে। যা ‘সাইকি রিভাইভড বাই কিউপিডস কিস’ নামে সমধিক পরিচিত। মার্বেলে তৈরি অনবদ্য এই ভাস্কর্যটিকে ইতালিয়ান ভাস্কর অ্যান্টোনিও ক্যানোভার শ্রেষ্ঠ কর্মগুলোর একটি বলে বিবেচনা করা হয়।
ভাস্কর্যের সৌন্দর্য কিংবা প্রেমের কাহিনী যে ইমিগ্রেশন অফিসারকে আকৃষ্ট করেনি, বুঝতে পেরেছি অনেক আগেই। তার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু আদতে আমি নিজেই। বাকীদের ইমিগ্রেশন শেষ হয়েছে, কমসে কম আধা ঘন্টা আগে। আমাকে কি মনে করে ছাড়ছে না। অন্যদের ব্যাগ না খুললেও, আমারটা শুধু খুলেই ক্ষান্ত হয়নি। বরং প্রতিটা আইটেম বের করিয়েছে। সন্দেহ করার মতো কিছুই পায়নি। তারপরেও আমাকে দাড় করিয়ে রেখেছে, চেকিং এর নামে। কিছুক্ষণ পর পর একটা আইটেম হাতে নেয়, আর নিজেদের মধ্যে কথা বলে। গ্রীক ভাষার একটা বর্ণ না বুজলেও আমাকে নিয়ে যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে, সেটা উপলব্ধি করতে কষ্ট হচ্ছে না। ক্লান্তি ভুলে গেলেও হতাশা আর ক্ষোভে মনের ভিতরটা জ্বলছে। অসহায়ত্বের চরমে পৌঁছে গেছি, অনেক আগেই।
তুরস্ক-গ্রিস বর্ডারের গ্রীক ইমিগ্রেশন এই রুমের ভিতরে কেমন যেন এক বিতর্কের আবহ বইছে। তাদের নিজেদের মধ্যেকার এই বিতর্কের মূল বিষয়বস্তু সম্ভবত আমি নিজেই। কারণ, কিছুক্ষণ পর পরই হয় তাদের কেউ না কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে। আর না হয়, আঙ্গুল তুলে আমাকে নির্দেশ করছে। এভাবে কারো দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করা যে অভদ্রতা, সেটা মনে হয় এদের জানা নেই ! অন্যদের চোখের দৃষ্টি, মুখভঙ্গি এবং কথা-বার্তার ধরনে মনে হচ্ছে তারা সবাই এক পক্ষে। আর বিপক্ষে, আমার সামনে বসা ইমিগ্রেশন অফিসার। সবাই মিলে আমার সামনের ইমিগ্রেশন অফিসারকে অন্যরা বুঝানোর চেষ্টা করেছে, এটুকু অনুমান করতে কষ্ট হচ্ছে না। আমি অসহায়ের মতো উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় আছি।
অফিসার আবার আমার দিকে ফিরলো।
মুখ গম্ভীর করে, আমার ক্যামেরার ফিল্মগুলো নিয়ে বসলো এবার। ভাগ্যিস, নেগেটিভগুলো এথেন্সে ডেভেলপ করিয়েছিলাম। আসলে প্রিন্ট করতে গিয়ে দাম বেশি দেখে ঠিক করেছি, ইস্তাম্বুলে ফিরে প্রিন্ট করলেই চলবে। নাহলে হয়তো সবগুলোই আজ এর হাতে বরবাদ হয়ে যেত। একটা করে চোখের সামনে ধরে, আর আমাকে প্রশ্ন করে।
কোথায় কোথায় গিয়েছিলাম?
কি কি করেছি?
সাথে কে কে ছিল?
উত্তরের সাথে ছবির অসংগতি বের করার নিস্ফল চেষ্টা শেষে ফিল্মগুলো ফিরিয়ে দিলো। চেহারায় কেমন যেন অসন্তুষ্ট ভাব। আবার শুরু করলো জিজ্ঞেস করা। যে উত্তর ইতোমধ্যে তাকে একাধিকবার দিয়েছি।
আমার উত্তর আগের মতোই রইলো। একটা কথারও কোনো অদলবদল নেই।
তেমন কিছু না পেয়ে হতাশ মনে হচ্ছে তাকে।
উঠে চলে গেল, বন্ধ দরজার ভিতরে।
ফিরলো কিছুক্ষনের মধ্যেই। মুখ এখনো গম্ভীর। চুপ চাপ বসে রইল খানিকক্ষণ।
শেষমেশ আমাকে ছেড়ে দিল।
মাঝারি সাইজের ব্যাগ টানতে টানতে বেরিয়ে এলাম ইমিগ্রেশন অফিস থেকে।
এতক্ষণ হেনস্তার পরে মুক্তি পেয়েছি। অথচ, খুশী লাগছে না। অপমান আর লজ্জার ভারে চাঁপা পড়ে গেছে সব আনন্দ। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, জীবনে আর কোনোদিনও গ্রিসে বেড়াতে আসবো না। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, জীবনে যে দুইটি দেশ সর্বপ্রথম দেখার ইচ্ছে জন্মেছিল, গ্রীস ছিল তার একটি। এই ভ্রমণ শুরুর আগেও আমার আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি।
বাসের দিকে এগুতেই দেখি সব কটি জানালায় একগাদা উৎসুক চোখ। চোখাচোখি হতেই, চোখ নামিয়ে হাটতে লাগলাম। পায়ের নিচের পরিষ্কার পথটুকু আচমকা ঝাপসা লাগছে। বাসে উঠতে গিয়ে বুঝতে পারছি, বিরক্তি আর জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বাস ভর্তি প্যাসেঞ্জার। অন্যরা কত দ্রুত চলে এসেছে। অথচ, শুধু আমার একার জন্যে এতো দেরী! না বুঝার কিছু নেই, সহানুভূতি আশা করা বোকামি।
শুকনো মুখে চোখের পানি আড়াল করে বাসে চেপে বসলাম।
জীবনে এমন অপমানিতবোধ, আগে কখনো করিনি।
নিজেকে খুব ছোট আর অসহায় মনে হচ্ছিল। এই মুহূর্তে যা করলে আমার বুক কিছুটা হালকা হবে, তাও করতে পারছি না। এতো মানুষের সামনে কান্নাকাটি , তাও আবার পুরুষের পক্ষে শোভা পায়?
বাস আবার চলতে করলো ইস্তাম্বুলের উদ্দেশ্যে।
পিছনে পড়ে রইল, ইমিগ্রেশন অফিসটি। কিন্তু চরম দুঃসহ স্মৃতি পিছনে ফেলতে পারলাম না। বুকের ভিতরে ইতোমধ্যেই স্থায়ী আসন গেড়ে ফেলেছে।
ছবিঃ ‘সাইকি রিভাইভড বাই কিউপিডস কিস’, @ গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৯ সকাল ৭:৪৪