আগের পর্ব দীর্ঘতম বাস যাত্রা
শেষ দিনে রেখেছিলাম প্রমোদতরীতে ভ্রমণ।
হোটেল থেকেই বাসে করে আমাদেরকে এনে জেটিতে নামিয়ে দিলো।
জাহাজের পাশ দিয়ে জেটির উপরে হাটতে হাটতে জাহাজের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। ইউরোপের এমন প্রমোদতরীর ছবি অনেক দেখেছি। এই প্রথম নিজেই একটাতে ভ্রমণ করতে যাচ্ছি! বিস্ময়, আনন্দ, আগ্রহ আর উত্তেজনার এক চমৎকার মিশ্রণ সারা দেহ-মনে।
জাহাজে পা দিতে না দিতেই হাতে টান অনুভব করলাম।
আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই, ঐতিহ্যবাহী গ্রীক পোশাকের এক যুবক আর যুবতী আমার দুই পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেল। প্রত্যেক যাত্রীর সাথে এরা ছবি তুলে। বলা যেতে পারে, প্রমোদতরীর স্বাগতম জানানোর এক তরিকা। ক্যামেরা দিকে তাকানোর ফুরসত কেড়ে নিল, শরীরে কোমল স্পর্শ।
অস্বাভাবিক রকমের এক কোমলতা চেপে বসেছে, গায়ের সাথে। বিস্মিত হয়ে, মুখ তুলে তাকালাম। প্রাচীন গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীর দেবীদের একজন মোহময়ী এক হাঁসি মুখে ঝুলিয়ে, আমাকে এমনভাবে চেপে ধরে দাঁড়িয়েছে যে, তার শরীরের উষ্ণ কোমলতা কাপড়ের উপস্থিতি উপেক্ষা করেই আমাকে শিহরিত করছে। ক্যামেরাম্যানের আহবানে সম্বিৎ ফিরতেই সামনে তাকালাম। ক্লিক, ক্লিক।
আরেকবার ঐ মোহময়ীর চেহারা দেখতে ব্যর্থ হলাম, পরের জনের ছবির প্রস্তুতিতে। বেশি কিছু বুঝার আগেই নিজেকে আবিস্কার করলাম অন্য যাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে। তাদেরকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম জাহাজের ভিতরে। পরে সারাদিনে অনেকবার খুজেছি, ঐ মোহনীয় দেবীর মুখ। পাইনি। বরং পেয়েছি, সেই ফটোগ্রাফারকে। গেটে তোলা ছবি দেখিয়ে প্রিন্ট করে দিতে চাইলো। চাইলে গেঞ্জিতেও প্রিন্ট করে নেয়া যায়। অতি উচ্চ মুল্য চাইলেও, দামটা গায়েই মাখলাম না।
নীল সমুদ্রের মধ্যে আড়াই ঘন্টা কিভাবে কেটে গেছে বুঝতে পারিনি। অবশ্য ট্যুরিস্টদের ব্যস্ত রাখার জন্যে, ঐতিহ্যবাহী পোশাকে গ্রীকদের নাচ-গান ইত্যাদিসহ অনেক কিছুর আয়োজন প্রমোদতরীতে করা হয়েছে। প্রথমেই নেমে পড়লাম হাইড্রা দ্বীপে।
ছবিঃ হাইড্রা দ্বীপ @ গুগল।
হোটেলে যখন আইল্যান্ড ট্রিপের তালিকায় হাইড্রার নাম দেখেছিলাম তখন টিভি সিরিজের হারকিউলিসের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। দেবতা জিউসের ছেলে হারকিউলিস ছিল গ্রীক পুরাণের এক মহাবীর। তার বীরত্ব, সাহস আর শক্তির প্রমাণস্বরূপ অনেক কাহিনী প্রচলতি আছে। যার মধ্যে একটা ছিল ৯ মাথা বিশিষ্ট জলদানবী হাইড্রাকে হাইড্রাকে হত্যা করা।
মানবীর গর্ভে জন্ম নেয়া হারকিউলিসকে দেবরাজ জিউসের স্ত্রী দেবী হেরা কোনোদিন মেনে নিতে পারেনি। তাই, হারকিউলিসকে জব্দ করার উদ্দেশ্যে হাইড্রাকে পেলে পুষে বড় করেছিলেন। হাইড্রা থাকতো লার্না হ্রদে। প্রচলিত আছে , হাইড্রা ছিল হ্রদের মধ্যে অবস্থিত পাতাল জগতে প্রবেশের একমাত্র দরজার পাহারাদার। হারকিউলিস হাইড্রার সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে কোনমতেই তাকে কাবু করতে পারছিল না। কারণ, হাইড্রার একটা মাথা ছিল অমর। আর, অন্য ৮ টার একটা কাটলে সেখান থেকে দুইটি মাথা গজায়। তখন, হারকিউলিস জ্ঞানের দেবী এথেনার বুদ্ধিতে তার সঙ্গী লোলাউসকে দিয়ে কেটে দেয়া মাথায় নতুন মাথা গজানোর আগেই আগুনে পুড়িয়ে দিলো। এভাবে ৮টি মাথা কাঁটার পরে শুধুমাত্র অমর মাথাটি কেটে আলাদা করে ফেলে দেবী এথেনার দেয়া বিশেষ এক তরবারি দিয়ে। যে তরবারি আবার হাইড্রার রক্তে ভিজিয়ে বিষাক্ত করে নিয়েছিল।
ছবিঃ হাইড্রার সাথে লড়াইয়ে ব্যস্ত হারকিউলিস, পিছনে মশাল হাতে লোলাউস। @ গুগল।
কথিত আছে যে, হারকিউলিসের হাতে হাইড্রাকে নাস্তানাবুদ হতে হেরা বিশাল এক কাঁকড়াকে পাঠিয়েছিলেন সাহায্যের জন্যে। অবশ্য সেই কাঁকড়ার ভবলীলা সাঙ্গ করেই হাইড্রাকে হত্যা করে হারকিউলিস। হেরার বদৌলতে কাঁকড়া এবং জলদানবী, দুজনেই অমর হয়ে আছে পৃথিবীর আকাশে। ‘কন্সটেলেশন হাইড্রা’ এবং ‘কনস্টেলেশন ক্যান্সার’নামের দুই নক্ষত্রপুঞ্জের মাঝে।
কোন একসময় ভয়ংকর সব নৌদস্যুদের দখলে থাকা এই দ্বীপ এখন সারা বিশ্বের ট্যুরিস্টদের পদচারনায় মুখরিত। হাইড্রা দ্বীপের চিকণ পাথরের রাস্তায় চলাফেরার জন্যে গাধা পিঠে চড়তে না চাইলে পায়ে হেটেই ঘুরতে হবে। আমি অবশ্য ভিন্ন কারণে গাধা এড়িয়ে হাটতে শুরু করেছি। যারা এখানেই হোটেলে উঠেছে, তাদের অনেকেই সমুদ্রের স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে অনেকেই সাতার কাটছে। প্রচন্ড ইচ্ছে হচ্ছিল তাদের সাথে যোগ দিতে। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক হাটা হাটি করে রাস্তার পাশের দোকান থেকে কিছু স্যুভেনির কিনে নিলাম। একটা ঈগলের মূর্তি চমৎকার লাগলো, না কিনে পারলাম না।
তিন দ্বীপের মধ্যে সবচেয়ে ছোট দ্বীপ পোরোস, আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্যস্থান। দূর থেকেই দ্বীপের ক্লক টাওয়ার আর রঙিন বাড়িঘরের মনোমুগ্ধকর এক দৃশ্যে মন কেড়ে নিলো। নামার আগেই জানিয়ে দিয়েছে, এখানে এক ঘন্টা সময় কাটানো যাবে। নেমে ঘুরাঘুরি করতে ভালো লাগছে না দেখে সাহস করে অক্টোপাস খেতে দাঁড়িয়ে গেলাম, রাস্তার পাশের এক দোকানে। মুখে দিয়ে কিছু না বল্লেও চোখমুখ দেখেই দোকানি ছোকড়া ধরে ফেলেছে যে, আমার পছন্দ হয়নি। নিজে থেকেই একটা মাছ রান্না করে দিতে চাইলো। কে শুনে তার আবদার, দ্রুত কেটে পড়লাম।
ছবিঃ পোরোস দ্বীপ @ গুগল।
জাহাজে ছাড়ার পরেই লাঞ্চ দিয়ে দিল। বুফে টেবিলে হরেক রকম খাবার, বিচিত্র রং এবং অবশ্যই দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। একটু আগেই দ্বীপের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে সরাসরি শুধুমাত্র চেনা খাবারে মনোনিবেশ করলাম। তবে, ফলের বাহার দেখে মুগ্ধ হয়েছি। শুধু সংখ্যা আর বিচিত্রতার কারণেই নয়, স্বাদেও অসাধারণ। অবশ্য আগেই জানা ছিল যে, ভুমধ্য সাগরের তীরবর্তী সবগুলো দেশেই সুস্বাদু ফলের প্রাচুর্য রয়েছে।
আমাদের তৃতীয় এবং শেষ গন্তব্যস্থল এজিনা দ্বীপ, তিন দ্বীপের মধ্যে সবচেয়ে বড়। এখানকার হারবারে বিচিত্র সব নৌকা বাঁধা। তার মধ্যে জেলেদের ছোট ছোট নৌকাও চোখে পড়লো। দ্বীপের চুড়ায় একটা মন্দির আছে, যেটা খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮০ সালে নির্মিত। ঘোড়ার গাড়ীও আছে দেখলাম। আমাদের জাহাজের একদল ঝটপট কয়েকটা ঘোড়ার গাড়ীতে উঠে পড়ল, মন্দির দেখতে যাওয়ার জন্যে। পুরো দ্বীপটাকে এক জায়গা থেকে থেকে দেখার জন্যে ঐটাই সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। আমি অবশ্য রৌদ্রে ঘুরাঘুরি করার পরিবর্তে চোখের সামনে থাকা কফি শপে বসে কফি খাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। আর, গ্রীসের মন্দিরে ধ্বংসাবশেষ ইতোমধ্যেই কিছু দেখেছি। সবই প্রায় এক রকম।
ছবিঃ এজিনা দ্বীপ @ গুগল।
কেন জানি না, দ্বীপের জীবন যাত্রা, ট্যুরিস্ট আকর্ষণের বিভিন্ন ব্যবস্থাদি আমাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তবে তীব্র নীল পানির উপরে ভেসে থাকা দ্বীপগুলোকে দূর থেকে জাহাজের খোলা ডেকে বসে দেখতে অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল। দ্বীপগুলোতে হাটতে হাটতে বুঝলাম, ট্যুরিস্টদের প্রায় সিংহভাগই এখানে কয়েকদিনের জন্যে গায়ের রং বদলাতে এসেছে। আমার মতো কয়েক ঘন্টার অতিথি এরা নয়। ইউরোপিয়ানরা কেন এতো স্বাস্থ্য সচেতন, সেটা উপলব্ধি করতে মোক্ষম জায়গা হলো ভুমধ্য সাগরের এই দ্বীপগুলো।
তৃতীয় এবং শেষ দ্বীপ থেকে আমরা এথেন্সে ফিরছি।
খোলা ডেকে হাটতে হাটতে ছায়ার মধ্যে একটা খালি চেয়ার পেয়ে বসে গেলাম।
গাঢ় নীল পানির উপর দিয়ে ছুটে চুলছে আমাদের জাহাজ।
পাশের চেয়ারে আগে থেকেই বসা ছিল প্রায় পঞ্চাশোর্ধ একজন পুরুষ।
আমকে জিজ্ঞেস করলো, আমি ভারতীয় কিনা?
মাস খানেক আগেও এমন প্রশ্নে অপমানিত বোধ করে বাঁকা উত্তর দিতাম। সময়ের সাথে সাথে ব্যাপারটা এখন সয়ে গেছে। ছোট করে শুধু ‘বাংলাদেশ’ বলেই পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লাম, আমার দেশের নাম কখনো শুনেছে কিনা? এরপর বাড়তে থাকে কথাবার্তা।
কিছুক্ষনের মধ্যেই মনে করার চেষ্টা করলাম, কে এবং কোথায় বলেছিল যে, একজন ব্রিটিশ আর আমেরিকানের মধ্যে পার্থক্য বের করা খুব সোজা। দেখবে, বৃটিশ ট্রেনের ভিতরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেপার পড়বে, তবুও পাশের যাত্রীর সাথে নিজে থেকে কথা বলবে না। অন্যদিকে, আমেরিকান পাশের যাত্রীর সাথে হাস্যরসে মেতে না উঠলেও টুকটাক কথাবার্তা শুরু করতে দেরী করবে না।
জেমস ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকে। প্রতি সামারেই ভুমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোতে ছুটি কাটাতে আসে। একমাত্র ছেলে আছে, ইরাকে। মেয়েটি এক আফ্রিকানকে বিয়ে করেছে, থাকে দক্ষিন আফ্রিকাতে। আগে কয়েকবার গ্রিসে এলেও স্ত্রীকে ছাড়া এই প্রথম। বেচারি এবার আসতে পারেনি। তাই, তাঁর জন্যে অনেক ছবি তুলেছে। আমাকে দেখালো। প্রথমবারের মতো ডিজিটাল ক্যামেরার ছবি দেখছি। ক্যামেরা পিছনে ছোট একটা স্ক্রিনে। ঝকঝকে দিনে খোলা আকাশের নিচে বসে আছি বলে, ছবিগুলো পরিষ্কার দেখার জন্যে হাত দিয়ে কিছুটা ঢেকে দেখতে হচ্ছে। সারাদিনে যে সব জায়গায় ঘুরেছে, সব জায়গার ছবিই সে তুলেছে দেখলাম। দ্বীপের কিছু ট্যুরিস্টের ছবি দেখে এই বয়সে তেমন ছবি তোলার কোন কারণ বুঝতে পারলাম না। যদিও ছবিগুলো আমার বয়সী যে কেউ পছন্দ করবে।
বিকেল নাগাদ হোটেলে ফিরে আবার বেরিয়ে পড়লাম। সাথে যা ছিল, সব হোটেলে রেখে এসেছি। এথেন্সের রাস্তায় হাটতে হাটতে কয়েকটা জায়গায় বাংলাদেশী কয়েকজনের সাথে দেখা হলো। টুকটাক জিনিসপত্র বিক্রি করছে। ট্যুরিস্টরাই তাদের প্রধান ক্রেতা। প্রথমে তারা আমাকেও তাদের মতো একজন ভেবেছিল। পরে যখন জানলো আমি আসলেই শুধুমাত্র বেড়ানোর জন্যে গ্রিসে এসেছি। তাদের অবাক হওয়ার ব্যাপারটি লুকোনোর চেষ্টা করলো না । এদিকে অনেকদিন পরে, বাংলায় কথা বলতে পেরে আমার নিজের খুব ভালো লাগছিল। কুশলাদি বিনিময়ের পরে তারা আমন্ত্রণ জানালো তাদের সাথে গিয়ে রাতের খাবারের। স্রেফ বলার জন্য যে বলছে না, সেটা আমি উপলব্ধি করতে পারছিলাম। দেশ থেকে এতো দূরে শুধু নিজের দেশের একজন বলে এতোটা আপন ভাবতে পারা শুধু বাংলাদেশের মানুষের পক্ষেই হয়ত সম্ভব।
পরেরদিনের ফিরতি যাত্রার কথা ভেবে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
শেষ পর্বের লিংক দীর্ঘতম বাস যাত্রা (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১১:৪৬