মুজতবা আলীর লেখা পড়েই মিশরীয় সভ্যতার প্রতি আগ্রহ জন্ম নিয়েছিল।
যা ছড়িয়ে যায় গ্রীক সভ্যতার উপরেও। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে - নীল নদে পাল তোলা নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াবো কিংবা এরিস্টটলের মূর্তি ছুয়ে দেখবো। তাই গ্রিসে বেড়ানোর সুযোগ প্রবল আগ্রহ নিয়েই পরিকল্পনা করেছিলাম।
ইস্তাম্বুল থেকে বাসে রওয়ানা দিলাম সকাল বেলা, এথেন্সের উদ্দেশ্যে।
সারা দিন কেটে গেলো উল্লেখ যোগ্য কিছু ছাড়াই। তবে থেসালোনিকি’র কথা আলাদাভাবে না বলে পারছি না।
দুপুর গড়িয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। বাস এগিয়ে চলছে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে। এক পাশে সমুদ্র, গাঢ় নীল পানি। উপরে ঝকঝকে নীল আকাশ। অন্যদিকে সবুজ ঘাসে মোড়ানো মাটি আর পাহাড়। পানি আর আকাশের রঙ এমনভাবে মিশেছে যে, অনেকক্ষণ মনোযোগ দিয়েও দিগন্তে সমুদ্র আর আকাশের মধ্যকার সীমারেখা আলাদা করতে পারলাম না। সমুদ্রের পানি যে এতো গাঢ় নীল হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মুগ্ধতার এখানেই শেষ নয়, দূর থেকে শহরের প্রাচীন কাঠামোর দেখে বার বার মনে পড়ছিল হাজার বছরের পিছনের ইতিহাসের কল্পকাহিনী।
কিছদূর পরেই বাস এসে থামল থেসালোনিকি শহরে।
এজিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত, গ্রীসের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এথেন্স থেকে প্রায় ৫০০ কিমি উত্তরে। প্রাচীন রোমান, বাইজান্টাইন এবং অটোমান সভ্যতার চিহ্ন এখনো দৃশ্যমান। যাত্রা বিরতির জায়গাটাও সুন্দর, চমৎকার একটা রেস্টুরেন্ট আছে। খাবারের অর্ডার দিয়ে ফাঁকা একটা টেবিলে একা বসে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক তরুণী এসে টেবিলের উল্টো পাশের চেয়ারে বসলো। একই বাসে এমন সুন্দরী এক তরুণী থাকলে চোখ এড়ানোর কথা নয়। তাই, আমি তাকে বাসেই দেখেছি। এছাড়া আগের যাত্রা বিরতিতে চোখাচোখি হলেও কথা হয়নি। এখন আমার টেবিলে বসাতে স্বাভাবিকভাবেই আমি বিস্মিত।
ছবিঃ থেসালোনিকি শহর @ গুগল।
সাইপ্রাসের মেয়ে পিনার, থাকে ইস্তাম্বুলে।
এথেন্সে আত্নীয় স্বজনদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। সেও আমার মতো একা ট্রাভেল করছে।
আমার ট্রাভেল প্ল্যান জানতে চাইলে বললাম যে, কিছু কিছু জায়গা দেখার জন্যে প্ল্যান আছে। তবে, কোনদিনে কোথায় যাবো তেমন কিছু এখনো ঠিক করিনি। এমনকি হোটেল আগে থেকে বুক করা হয়নি শুনে সে নিজে থেকেই প্রস্তাব দিলো তার সাথে যাওয়ার। তার পরিচিত হোটেল আছে এবং ট্যুর এজেন্সিও আছে। তারা আমার প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্য করতে পারবে।
আসলে এমন অযাচিত সাহায্যের সাথে পরিচিত নই।
তাছাড়া মনের মধ্যে কিছুটা সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। কে জানে, কত দামি হোটেলে তুলে দেয়? আবার নিজেই যদি টাকা পয়সা চেয়ে বসে? ধন্যবাদ দিয়ে অস্বীকৃতি জানালাম। পরের যাত্রা বিরতিতেও আমরা একই টেবিলে বসেছিলাম। সে আমার কফির বিল দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি দিতে দেইনি। আবার, অভদ্রের মতো তার বিল দেয়ারও প্রস্তাব করিনি। কেন জানি, এক ধরনের সন্দেহ আর ভয় কাজ করছিল মনের ভিতরে।
এথেন্সে যখন পৌঁছলাম, তখন সবে সকাল হয়েছে।
ভোরের আলো-আধারিতে হোটেলে ঢুকে, বিশ্রামের বাহানায় সময় নস্ট করতে মন চাইছিল না।
কারণ, এক্রোপোলিস দেখতে এই সিজনে প্রচুর ভিড় হয়। তার উপরে অ্যারিস্টোটল, আলেকজান্ডার, প্লেটো, সক্রেটিস - এদের কাহিনী এতো শুনেছিলাম যে, মনে হচ্ছিল হোটেলের বাইরে বেরুলেই এদেরকে না দেখলেও প্রাচীন আমলের কিছু না কিছু তো চোখে পড়বেই। ক্লান্তি তাড়ানোর জন্যে তাই গোসল সেরে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম।
ছবিঃ শিল্পীর কল্পনায় প্রাচীন গ্রীসের এক্রোপোলিস, @ গুগল।
টিকেটের লাইনে দাঁড়িয়ে এক্রোপোলিসের উঁচু চুড়ার দিকে তাকিয়ে দেখি এই সকালেও অনেক ট্যুরিস্ট উঠে পড়েছে।
চুড়ায় মন্দিরের ব্যকগ্রাউন্ডে ঝকঝকে নীল আকাশ। হঠাৎ তাকালে, ঝকঝকে আকাশ ভেদ করে দাঁড়িয়ে আছে এক মন্দির - ভেবে ভুল হতে পারে। অন্য সকলকে অনুসরণ করে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে ওপরে উঠতে থাকি। প্রথমেই পেয়ে যাই 'প্রপেলিয়া', যেটা এখানকার প্রবেশদ্বার। যে পাহাড়ে এক্রোপলিস নির্মিত হচ্ছিল, সেখানে উঠার একমাত্র সহজ পথে হওয়ায় এদিকেই এই গেটটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ফলে, এই দিকটাই কালক্রমে অ্যাক্রোপলিসের সামনের দিক হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যায়। ছোট-বড় মিলে ৫টি গেট আছে, ওপরে দেবী এথেনার মন্দিরে যাওয়ার জন্যে। প্রাচীনকালে বিশেষ উৎসবের সময় এথেন্সের নাগরিকেরা এই পথ দিয়েই মিছিল করতে করতে মন্দিরের চত্বরে আগমন করতো।
প্রপেলিয়ার এক পাশে ছোট মন্দিরটি ‘Wingless Victory বা Nike áptera’ দেবীর মন্দির।
ছাদের কারুকাজ গ্রীক এবং পার্সিয়ানদের মধ্যে প্লেটাইয়ার যুদ্ধের দৃশ্য দিয়ে সুসজ্জিত করা। বিজয়ের দেবী ‘নাইকি’র সম্মানে এই মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। স্পারটানদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে চলমান পেলোপোনেশিয়ান যুদ্ধে জয়ের আশায় গ্রীকরা এই দেবীর পুজো করতো। গল্প প্রচলিত আছে যে, দেবী নাইকি’র ডানা ছিল। তবে, অ্যাথেনা নাইকির মূর্তিতে ডানা না থাকায় এথেনিয়ানরা পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে এটিকে ডানাবিহীন নাইকি নামেই অভিহিত করে। গল্পে আরো বলা হয়েছে যে, মূর্তিটিতে ডানা রাখা হয়নি, যাতে এটি কখনই শহর ছাড়তে না পারে।
ধীরে ধীরে উঠে এলাম এক্রোপোলিসের সবচেয়ে উঁচু চূড়া, পার্থেনন চত্বরে।
দেবী এথেনার মন্দির যেখানে রয়েছে , যা 'পার্থেনন' বা ‘কুমারীর ঘর’ নামে পরিচিত। চত্বরের এখানে সেখানে এখনো প্রাচীন কালের কিছু ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এখান থেকে পুরো এথেন্স শহর দেখা যায়। প্রাচীন গ্রিসে এক সময় এক একটা নগরকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এথেন্স ছিল তেমনি এক নগর রাষ্ট্র। এক্রোপোলিসের চুড়াতে এই রাজকীয় দেবমন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল দেবী এথেনার সম্মানে। লোকজনের বিশ্বাস ছিল, রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে দেবী এথেনা এথেন্স রাষ্ট্রের ভালোমন্দ দেখভাল এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করবেন। রাজা পেরিক্লিসের আমলে নয় বছরের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৭ সালে। এথেন্সের গৌরবের যুগে নির্মিত এই মন্দিরের স্থাপত্য, শিল্পকর্ম আর ভাস্কর্যের সবই দেবী এথেনার গৌরব নির্দেশ করে।
পার্থেননের পাশেই ছোট আরেকটা মন্দির আছে, এরিকথিয়ন মন্দির।
ছয়টি মানবীরুপী কলামের কারণে ট্যুরিস্টদের কাছে এর আলাদা আকর্ষণ আছে। মূর্তিগুলির নির্মাণশৈলী এককথায় অসাধারণ।
অন্য অনেকের মতোই আমিও কিছুক্ষণ এই মূর্তি দেখেই মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। তবে এথেন্সের যাদুঘরে গিয়ে মার্বেল পাথরের কিছু মূর্তি দেখে মনে হয়েছিল, যেন জীবন্ত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। যেমন নিখুঁত ছিল সেগুলোর নির্মাণশৈলী, তেমনি তাদের আবেদন ও গঠন কাঠামো ছিল অবিস্বাস্য রকমের আকর্ষণীয়।
ছবিঃ এরিকথিয়ন মন্দির @ গুগল।
এক্রোপোলিস থেকে নামার রাস্তায় পেলাম গ্রিসের সবচেয়ে পুরনো এম্পিথিয়েটার 'থিয়েটার অব ডায়েনিসস'।
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল, ভেবেই আমি বিস্মিত হয়েছি। এখানে নানা ধরনের উৎসব উদযাপিত হতো। তখন প্রায় ১৭ হাজার দর্শক বিভিন্ন সাড়িতে এক সাথে বসার সুযোগ পেতো।
পরের দিন সকাল সকাল হোটেল থেকে বেরিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলাম গ্রীসের নান্দ্যনিক পুরাকীর্তিগুলো।
তবে হতাশ হলাম, এই কারণে যে প্রচুর পুরাকীর্তি হয় নেই, অথবা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ধ্বংসাবশেষ দেখে বুঝাই যাচ্ছিল না, আসলে এটা কি ছিল? বইয়ের ছবিতে দেখা অনেক কিছুই বাস্তবে তেমন আকর্ষণীয় মনে হলো না। ছোটবেলা থেকেই আলাদা একটা মোহ গড়ে উঠেছিল গ্রীক পৌরাণিক কাহিনী ঘিরে। সচক্ষে সেই দেবদেবীর মূর্তি, মন্দির আর অন্যান্য স্থাপত্য দেখতে দেখতে শিহরিত হচ্ছিলাম। প্রতিটা জায়গাতেই বইয়ে পড়া পৌরাণিক কাহিনিগুলো মনে পড়ছিল। এথেন্সে দেখার অনেক কিছুই আছে। আর যারা গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীর প্রতি দুর্বল, তাঁদের জন্যে এমন প্রাচুর্যপূর্ণ স্থান দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি হওয়ার সুযোগ নেই।
পুরো দিন কাটলো ভালো আর খারাপের মিশ্রনে।
শুধুমাত্র যাদুঘরে গিয়ে মন ভালো হয়ে গেল।
বইয়ে বিভিন্ন সময়ে যা যা পড়েছিলাম, তার প্রায় সমস্ত প্রমাণাদি চাক্ষুস দেখার সুযোগ পেয়ে প্রচন্ড ভালো লাগলো।
অন্যদিকে, দেবতা জিউসের মন্দির দেখে আশাহত হয়েছি। ছোট বড় বিভিন্ন সাইজের বেশ কিছু ভাঙ্গাচোরা কারুকার্যময় কলাম ছাড়া কিছুই নেই বললেই চলে। আ্যক্রোপোলিস থেকে বেশি দূরে নয় এই মন্দির চত্বর। ঠিক শহরের মাঝমাঝি। বেশ বড় চত্বরের এই মন্দিরের নামকরণ করা হয়েছে দেব-দেবীদের রাজা জিউসের নামে।
ছবিঃ জিউসের মন্দির @ গুগল।
এর পরে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় পেয়ে গেলাম অলিম্পিক স্টেডিয়াম।
১৮৯৬ সালে যেখানে প্রথম আধুনিক অলিম্পিক গেমস শুরু হয়েছিল। এটা পৃথিবীর একমাত্র স্টেডিয়াম যার পুরোটা মার্বেল পাথরের তৈরি। তবে সত্যি বলতে কি, কেমন যেন সাদামাটা মনে হলো আমার কাছে। আসলে, আমি আরো জাঁকজমকপূর্ণ কিছু আশা করেছিলাম। হয়তবা, এথেন্সে প্রচুর কারুকার্যময় স্থাপত্য দেখে, আমার অবচেতন মন এখানেও তেমন কিছু আশা করেছিল।
এথেন্স শহরের প্রায় সব জায়গা থেকেই এক্রোপলিস দেখা যায়।
যদি প্রাচীন ইতিহাসকে মনের মধ্যে ধারন করে কেউ শহরের অলি-গলিতে হাটতে থাকে, তাহলে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন ভগ্নাবশেষ দেখে ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে হাঁটার মতো এক অনুভূতি সৃষ্টি হতে পরে। তাই, যে ইতিহাস জানে তার জন্য এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা। অনেকটা ইতিহাসের পাতার ভিতরে হাটাহাটি। আর যে ইতিহাস জানে না, তার জন্যে কেমন হতে পারে ব্যাপারটা – একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন।
সন্ধ্যার পরে আমার মন খারাপ হয়ে গেল কিছুটা। কারণ একা বেড়াতে এসেছি। দিনের বেলা না হয়, যাদুঘর আর ঐতিহাসিক এলাকা ও প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সন্ধ্যার পরে কি করবো? হোটেলের কাছাকাছি একটা সিনেমা হল দেখে ভাবলাম সময় কাটানো যেতে পারে। তবে টিকেট কাউন্টার থেকে ফিরে এলাম। যে মুভ্যি চলছে, সেটা দেখার ইচ্ছে হলো না।
উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে বসে পড়লাম রাস্তার পাশের এক খোলা কফি শপে।
দূরে আলো ঝলমলে এক্রোপোলিস দেখা যাচ্ছে। কফিতে চুমুক দিতে দিতে আমি মানুষ দেখতে থাকি।
কিছু ট্যুরিস্ট, এই ভর সন্ধ্যায় পিঠে ব্যাগপ্যাক নিয়ে হাঁটছে। তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই বেশি। অথচ, আমি অপেক্ষায় আছি কোনো গ্রীক সুন্দরীর আশায়। কিশোর বয়সে যে সৌন্দর্যের বর্ণনা গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে পড়ে তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিয়েছিল ট্রয়ের হেলেনের মতো কাউকে কাছে থেকে দেখার। তবে, আশাহত হতে হলো। তেমন কেউই রাস্তার পাথরে শব্দ তুলে পাশ দিয়ে হেটে গেল না। একবার মনে হলো, পিনারের অন্তত ফোন নাম্বার নেয়া উচিৎ ছিল। তাহলে হয়ত, তাকে এখানে কফির দাওয়াত দিতে পারতাম ! কিংবা বেড়ানোর মতো কোন জায়গায় সে নিয়ে যেতে পারতো!
পরের পর্ব দীর্ঘতম বাস যাত্রা ( ২য় পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১:০৯