প্রথম পর্বের লিংক অদূরদর্শিতা , সন্দেহ এবং দুর্ভাগ্য
দুই
পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে উপজাতি সম্প্রদায়কে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো সম্পৃক্ত করেনি বলে অভিযোগের সুর শোনা যায়। এমনকি যে ছয় দফা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে গণজোয়ার সৃস্টি করেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেই আন্দোলন চন্দ্রঘোনার বাঙালি শ্রমিক এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ছয় দফা আন্দোলনে শরিক হতে না পারলেও, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে অনেক উপজাতি ছাত্র স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামিল হয়েছিলেন।
তবে, জাতীয় রাজনীতির সাথে গড়ে উঠা এই সম্পৃক্ততা বছর খানেকের বেশি স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পায়নি। কারণ আর কিছুই নয়, স্থানীয় পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ। সত্তরের জাতীয় নির্বাচনের সময়, তারা উনসত্তরে গড়ে উঠা জাতীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা থেকে পাহাড়িদের দূরে সরিয়ে দেয়। আলোচ্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের দুইটি আসনে হেরেছিল। তাঁর একটা রাঙামাটিতে ত্রিদিব রায়ের কাছে। প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী হেরে যায় রাঙামাটিতে এম এন লারমা এবং বান্দরবানে অং শৈ প্রু চৌধুরীর কাছে।
আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী আঁতাতের কথা উঠে এসেছে, সিদ্ধার্থ চাকমার কণ্ঠে,
“পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তর এলাকায় রাজা ত্রিদিব রায়ের প্রভাব ছিল নিরঙ্কুশ। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা রাজতন্ত্র বিরোধী। তা সত্বেও নির্বাচনী কৌশল হিসেবে রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে সমঝোতা করেন। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে লারমা তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে রাজা ত্রিদিব রায়ের পক্ষে প্রচারে নামেন। বিনিময়ে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে লারমাকে সমর্থন করতে রাজা ত্রিদিব রায় তাঁর লোকজনদের নির্দেশ দেন। এই নির্বাচনী আঁতাতের ফলে রাজা ত্রিদিব রায় এবং মানবেন্দ্র লারমা উভয়েই বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন।“ (চাকমা, ১৩৯২ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৩৭-৩৮)।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বেশীরভাগই কোন পক্ষাবলম্বন করেনি। তবে অনেক পাহাড়ী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং অনেকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। পাশাপাশি, একটা অংশ পাকিস্তানী বাহিনীকে সক্রিয় সহায়তা করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। যাদের বেশীরভাগ ছিল চাকমা। চাকমা রাজার প্রভাবেই এরা রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়েছিল। তার সার্কেলের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীকে সহায়তা করার জন্যে প্রচারনার পাশাপাশি গ্রামের হেডম্যান ও কারবারীদের নির্দেশ প্রদান করেন লোকদেরকে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করানোর জন্যে। অবশ্য বেতন ও অস্ত্রের লোভেও অনেকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়।
পার্বত্য অঞ্চলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের একজনও মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধের সময় এম এন লারমা কোন পক্ষাবলম্বনের পরিবর্তে নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু অং শৈ প্রু চৌধুরী এবং ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে হানাদার বাহিনীকে সক্রিয় সহযোগিতা করেন। অপরদিকে, তৎকালীন তিন সার্কেল চীফ বা প্রথাগত রাজাদের মধ্যে একমাত্র মং সার্কেলের রাজা মংপ্রু সাইন তাঁর সবকিছু বিলিয়ে দিয়েই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অবদান রাখেন। বোমাং রাজা পাকিস্তানের পক্ষে তেমন সক্রিয় ছিলেন না। তবে, চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের সক্রিয়ভাবে পক্ষাবলম্বন করেন।
বাংলাদেশের অনেক মানুষই পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি বলতে শুধু চাকমাই বুঝতো। এছাড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং প্রভাবশালী ছিল চাকমা। তাই, চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় রাজাকার হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করায় মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই চাকমাদের প্রতি বিরুপ মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়েন। ত্রিদিব রায়ের পাকিস্তানে পলায়ন এবং জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতার চেষ্টা করার কারণে এই মনোভাব আরো পাকাপোক্ত হয়।
ত্রিদিব রায় সম্পর্কে গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে প্রিয়জিৎ দেবসরকার মতামত ব্যক্ত করেছেন,
“ ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রত্যাখ্যান করে রাজা ত্রিদিব রায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ...... রাজা ত্রিদিব রায় তার সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে কখনোই আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হননি। ..... তিনি যদি বাস্তববাদী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতেন তবে দেখতে পেতেন বুলেট এবং বর্বরতা দিয়ে জনগণের গণঅভ্যুত্থানকে দমন করা সম্ভব নয়। তিনি ১৯৭১ সালের সংকটকালে একজন কিংবদন্তী রাজা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারতেন এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যদি দেখতে পেতেন তাহলে ইতিহাসে তাঁর এবং তাঁর জনগণের নাম স্বর্ণাক্ষরে খচিত থাকত। কিন্তু তিনি তা করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন।“ (দেবসরকার, ২০১৬, পৃ. ৯৬-৯৭)।
১৯৭২ সালে জাতিসঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করতে পাকিস্তান ত্রিদিব রায়কে পাঠিয়েছিল।
অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলে বঙ্গবন্ধু রাজমাতা বিনিতা রায়কে পাঠিয়েছিলেন।
“রাজমাতা বিনিতা রায় ত্রিদিবকে বাংলাদেশে ফিরে যাবার অনুরোধসহ শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে একটি ব্যক্তিগত বার্তা বয়ে নিয়ে যান। তাকে বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা প্রদান এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়। রাজা ত্রিদিব রায় অবশ্য তার মা এবং জন্মভুমিকে খোলাখুলি প্রত্যাখ্যান করেন।“ (দেবসরকার, ২০১৬, পৃ. ১০৪)। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে গড়ে উঠা অবিশ্বাস দূর করার সমস্ত পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে নিস্ক্রিয় থাকলেও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে জাতীয় রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পাহাড়ের নেতৃবৃন্দ সন্দেহের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে নেতৃত্বের অদূরদর্শিতায় মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সক্রিয় হওয়ায় অবিশ্বাস আরো জোরালো হয়। এই পরিস্থিতির আলোকেই জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা মন্তব্য করেছেন,
“ভুল নেতৃত্বের মাশুল শেষ পর্যন্ত সাধারণ উপজাতীয় জনগণকেই দিতে হয়েছে। পাকিস্তান আমলে যেমন পাকিস্তান বিরোধী (ভারত পন্থী), তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও উপজাতীয়দের গায়ে বাংলাদেশ বিরোধী লেবেল এঁটে দেওয়া হয়।“(চাকমা, ১৯৯৩, পৃ. ৪৭)।
স্বাধীনতার জন্মলগ্নেই উপজাতি, বিশেষত চাকমাদের প্রতি অবিশ্বাস আর সন্দেহের সৃস্টি হয়েছিল। যে সন্দেহ দূর করার উপায় ছিল, দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে তাকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ করেছিল, তার উল্টো কাজ। যুদ্ধ বিধ্বস্থ নব্য স্বাধীন বাংলাদেশে হাজারো সমস্যা নিয়ে সরকার যখন পেরেশানিতে। তখনই কিছু নেতা দাবী করে বসেন আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন। এমনকি, উপজাতিদের স্বার্থ, ঐতিহ্য, ভুমি, কৃষ্টি, ইত্যাদি রক্ষার অনেক আশ্বাস বঙ্গবন্ধুর দিয়েছিলেন। তাঁদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে অনেক পদক্ষেপও গ্রহন করেছিলেন। তাঁর পরেও তারা বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশাতেই (১৯৭৩-৭৫) সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল।
ছবি গুগল থেকে নেয়া।
তথ্যসুত্রঃ
১। চাকমা, সিদ্ধার্থ (১৩৯২ বঙ্গাব্দ), প্রসঙ্গঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম, কলকাতা, নাথ ব্রাদার্স।
২। চাকমা, জ্ঞানেন্দু বিকাশ (১৯৯৩), ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ, রাঙামাটি: স্থানীয় সরকার পরিষদ, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
৩। দেবসরকার, প্রিয়জিৎ (২০১৬) পশ্চিম পাকিস্তানের শেষ রাজা, অনুবাদ, বাতিঘর, চট্টগ্রাম।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৪৭