এক
কোন রকম লুকোছাপা না করেই ত্রিপুরায় বসবাসরত চাকমা সম্প্রদায়ের নেতারা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ’ বলে দাবি করেছেন। বিভিন্ন পত্রিকার এ সংক্রান্ত সচিত্র প্রতিবেদন ইন্টারনেটের বদৌলতে দ্রুতই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে, গত কয়েকদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়াতে বিষয়টি আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এর ১৭ আগস্ট ২০১৯ তারিখের সংবাদে জানা যায়, চাকমা জাতীয় কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া, ত্রিপুরার রাজ্য সহ-সভাপতি অনিরুদ্ধ চাকমা বলেছেন,
“আমরা চাকমা জনগোষ্ঠীর মানুষের বিরুদ্ধে অস্থিতিশীলতা, জাতিগত নির্মূলকরণ এবং অবিচারের কারণে সৃষ্ট অত্যাচার ও বেদনার বিরুদ্ধে বিগত বছরের মতো এই কালো দিবস পালন করছি। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করি এবং এই ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আদালত ইন্টারন্যাশন্যাল কোর্ট অব জাস্টিসের কাছে ন্যায়বিচার এবং সহানুভূতি কামনা করছি।’
উল্লেখ্য যে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে হস্তান্তরের প্রতিবাদে ২০১৬ প্রতিবাদে সাল থেকে ১৭ আগস্ট-এ কালো দিবস উদযাপন করা হয়।
আপাত দৃষ্টিতে বাংলাদেশে বসবাসরত কিছু চাকমা এমন সংবাদে উল্লসিত।
তবে অনেকেই ভ্রূকুঞ্চিত করছেন এই ভেবে যে, দেশ বিভাগের প্রায় ৭০ বছর পরে চাকমাদের এমন দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের প্রতি সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে কি?
এমন দুশ্চিন্তার অবশ্য যথাযথ কারণ রয়েছে। ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ বিশেষত চাকমা নেতৃবৃন্দের কিছু কিছু ভুল পদক্ষেপ এবং অদূরদর্শিতার কারণে অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল। যার পরিণতিতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল পাহাড়ের সাধারণ মানুষের।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় পাহাড়ের নেতৃবৃন্দ সঙ্গত কারণেই পার্বত্য চট্রগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ছিলেন না।
বরং যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন ভারতে অন্তর্ভুক্তির জন্যে। এমনকি পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির ব্রিটিশ সিদ্ধান্তের পরেও, তৎকালীন জনসমিতির সাধারণ সম্পাদক স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের অফিসের সামনে প্রকাশ্যে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে, তিনি “ সমস্ত পাহাড়ী পুলিশগণকেও (সাধারণ কনস্টেবল শ্রেণীর) প্রয়োজন মতে সশস্ত্র –বিদ্রোহ করিতেও প্রস্তুত” করে রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, “গ্রামস্থ বহু পাহাড়ীকেও বন্দুক প্রভৃতি আগ্নেয়াস্ত্র লইয়া উপস্থিত হইতে নির্দেশ প্রদান” করেছিলেন। (দেওয়ান, ২০১৮, পৃ. ২৫৬-২৫৭)।
উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের বিভিন্নমুখী প্রচেষ্টার বিষয়ে জানতে পেরে গভর্নর জেনারেল বলেছিলেন,
“হিন্দুস্তান ভুক্তির চেষ্টা পরিহার করুন, অন্যথা শুধু শক্তির অপব্যয় করা হইবে এমন নহে, ইহাতে তোমরা বিশেষ কষ্টে পতিত হইবে।” (দেওয়ান, ২০১৮, পৃ. ২৬৯)।
পরবর্তীতে, পাহাড়ী নেতৃবৃন্দের সশস্ত্র প্রতিরোধ ব্যর্থ করে পাকিস্তানের বেলুচ রেজিমেন্ট ২১ আগস্ট ভারতের পতাকা নামিয়ে ফেলে। “এরপর পাকিস্তান সরকার ঢালাওভাবে উপজাতীয়দের প্রো-ইন্ডিয়ান বা ভারতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করে। এবং সেই থেকে শুরু হয় তাদের ওপর বিমাতাসুলভ আচরণ প্রদর্শনের পালা।” (খীসা, ১৯৯৬, পৃ.৩৪)। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে এটা স্পষ্ট ছিল যে, “পাকিস্তানের প্রতি তাদের আনুগত্যের বিষয়ে সব সময় সন্দেহ করা হত।” (চাকমা, ১৯৯৩, পৃ. ৭)।
পতাকা নামালেও পাহাড়ি নেতারা দমে যাননি।
অপরপক্ষে ভারতীয় নেতারাও তাদের দেশবিভাগপূর্ব সেন্টিমেন্ট বজায় রাখেন।
যার প্রকাশ ঘটে দেশ বিভাগের প্রায় দুই বছর পরে ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সরদার প্যাটেল পূর্ব পাকিস্তানী সংখ্যালঘূদের খুশী করার জন্যে যখন বলেন যে, “শুধুমাত্র একটা দাগের অন্যপাশে আছে বলেই যারা আমাদের রক্ত এবং মাংস, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের পাশে থেকে লড়াই করেছে, হঠাৎ করে তারা আমাদের কাছে বিদেশী হতে পারে না।” (চৌধুরী, ২০০৬, পৃ. ৪০)।
তাই পাহাড়ি নেতাদের সাথে ভারতীয় নেতাদের যোগাযোগের বিষয়টি বুঝতে পেরে, পাকিস্তান সরকার স্বাভাবিকভাবেই তা বন্ধ করার চেষ্টা করেন।
পাকিস্তান সরকারের প্রচেষ্টার মধ্যে পার্বত্য চট্রগ্রামকে বাঙ্গালীদের প্রবেশের জন্যে খুলে দেয়া অন্যতম। যার ধারাবাহিকতায়, ১৯৬২ সালের সংবিধানে পার্বত্য চট্রগ্রামকে ‘এক্সক্লুডেড এলাকা’ হতে ‘ট্রাইবাল এলাকা’র মর্যাদা দেয়া হয়। এমনকি ১৯৬৪ সালে, ‘ট্রাইবাল এলাকা’র বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে এই অঞ্চলে বাইরের অধিবাসীদের প্রবেশ, বসবাস এবং জমি অধিগ্রহণ এর উপর হতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
অপরপক্ষে, ১৯৬০ হতে ১৯৭০ সালে, এই অঞ্চল হতে বেশীরভাগ পাহাড়ী সরকারী কর্মচারীদের অন্যত্র বদলি করে দিয়ে শুধুমাত্র প্রধানত বাঙ্গালিদেরকেই এখানে সরকারী প্রশাসনের দায়িত্বে রাখা হয়। একই সময়, সোভিয়েত ব্লক ও ভারতের বিপক্ষে আমেরিকাকে সমর্থনের অংশ হিসেবে পাকিস্তান পার্বত্য অঞ্চলে ভারতের নাগা ন্যাশনাল আর্মি এবং মিজো গেরিলাদের সাহায্য করে।
এরই পাশাপাশি, এই এলাকার উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্রগ্রামকে ‘ট্যাক্স ফ্রি জোন’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। একই লক্ষ্যে, ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা ও এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে ১৯৫৭ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
এই সমস্ত কিছু করা হয় প্রধানত পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতে অন্তর্ভুক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে। স্মরণযোগ্য যে, ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পরে জম্মু ও কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ, গোয়া, সিকিম, জুনাগর ইত্যাদির ভাগ্যের দিকে তাকালে পাকিস্তানের এহেন ভারতভীতি থাকা মোটেও অস্বাভাবিক মনে হয় না।
সহজ কথায় বলতে গেলে, পাকিস্তান সরকারের সন্দেহ সৃষ্টি করেছিল স্নেহ কুমার চাকমার মতো কিছু নেতা। যে সন্দেহের আগুনে ঘি ঢেলেছিল ভারতের কিছু কার্যকলাপ, আঞ্চলিক ও বিশ্ব-রাজনীতি। যার ফলাফল হিসেবে পুরো পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরীহ মানুষের লাভের পরিবর্তে ক্ষতিই হয়েছে। নিঃসন্দেহে তৎকালীন পাহাড়ী নেতৃবৃন্দের অদূরদর্শিতা দুর্ভোগ বয়ে এনেছিল নিরীহ জনসাধারণের উপর।
তথ্যসুত্রঃ
১। দেওয়ান, শ্রী কামিনী মোহন (২০১৮, প্রথম প্রকাশ ১৯৭০), পার্বত্য চট্রলের এক দীন সেবকের জীবন কাহিনী (২য় প্রকাশ), রাঙামাটি: রেগা প্রকাশনী।
২। খীসা, প্রদীপ্ত (১৯৯৬), পার্বত্য চট্রগ্রামের সমস্যা, ঢাকা : সাহিত্য প্রকাশ।
৩। চাকমা, জ্ঞানেন্দু বিকাশ (১৯৯৩), ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ, রাঙামাটি: স্থানীয় সরকার পরিষদ, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
৪। চৌধুরী মোঃ নাজমুল হাসান (২০০৬, অক্টোবর - ডিসেম্বর), The Resistance Movement in the Chittagong Hill Tracts: Global and Regional Connections, এশিয়ান এফেয়ারস, ২৮(৪), পৃ. ৩৬-৫১।
পরবর্তী পর্ব অদূরদর্শিতা, অবিশ্বাস এবং দুর্ভাগ্য - ২য় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:১৬