আগের কাহিনি জানতে অসহায়ত্ব
আমার টাকার অংক শুনে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছে না।
হতবাক হয়ে গেছে।
অবিশ্বাসের ভঙ্গীতে মাথা ঝাকিয়ে আবার জানতে চাইল।
এই প্রথম তাকে বিস্মিত হতে দেখে আমার আত্নবিশ্বাস ফিরতে শুরু করেছে।
টাকার অংকটা আবার বললাম। আত্নবিশ্বাসের সাথে।
সে যা দাবি করেছিল, তার চেয়ে অস্বাভাবিকরকমের কম।
সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না।
কিছুক্ষণ বুঝানোর চেষ্টা করলো।
পুলিশ, হোটেলের স্টাফ, মেয়েদের মেইন্টেইন করা, বারের খরচা, লোকাল মাফিয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
যার অনেক কিছুই যে সে আমাকে বলার কথা নয়, তাও জানাতে ভুললো না।
ততক্ষণে যা বোঝার, আমি বুঝে গেছি।
বঙ্গবাজারের দামাদামির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে, তাকে বিস্মিত রেখেই উঠে দাড়ালাম।
হাটতে শুরু করেছি দরজার দিকে। পিছন থেকে কি যেন বলছে?
না শোনার ভান করে, একবারের জন্যেও পিছনে তাকালাম না। দ্রুত বেরিয়ে এলাম।
প্রায় দৌড়ে হোটেলে ফিরেছি। রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করা পর্যন্ত ভয় পাচ্ছিলাম। এই বুঝি পিছন থেকে তারা দৌড়ে এসে আমাকে ধরে ফেলে! এমনকি রুমের মধ্যেও কয়েকবার মনে হলো, যদি হোটলেই চলে আসে?
পরের দিন, আড়াই ঘন্টার ট্রেন জার্নি শেষে পৌঁছলাম সিনাইয়া স্টেশনে।
মধ্যযুগীয় বিল্ডিং এর বিশাল হল্রুমের ভিতরটা এক নজর ভালভাবে দেখতে দাড়াতেই হলো। ফিরতি যাত্রার টিকেট নিয়ে বাইরে পা ফেলতেই ঝকঝকে রোদের মিষ্টি উষ্ণতার ছোঁয়া পেলাম। পোস্ট কার্ডের ছবির মতো একটা জায়গা। স্টেশনের পিছনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পর্বতমালা। সাধারণ দৃষ্টি সীমা ঘন বনের সবুজ গাছগাছালিতে আটকে যায়। মুখ তুলে তাকালেই কেবল পর্বতচুড়া দেখা সম্ভব। সবুজ চুড়ার মাঝে অল্প বিস্তর সাদা বরফের উপস্থিতি সৌন্দর্যে আলাদা অলংকার যোগ করেছে। চারদিকে এক নজর তাকিয়েই মনটা ভালো হয়ে গেল।
সিনাইয়ার মূল আকর্ষণ ‘পেলেস ক্যাসল’ (PELEȘ CASTLE)।
প্রথম দেখায় মনে হলো, সিনড্রেলা, রাপুনজেল, বা লিটল ব্রায়ার-রোজদের কেউ এখানে থাকে।
বার বার মনে হচ্ছিল, রুপকথার বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে পুরো একটা ক্যাসলকে তুলে এনে কার্পাথিয়ান পর্বতমালায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকের কাছেই পেলেস ক্যাসল হলো ইউরোপের অন্যতম অত্যাশ্চর্য দুর্গ। নতুন-রেনেসাঁর স্থাপত্যের একটি মাস্টারপিস। ১৮৮৩ সালে চালু হওয়ার পর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এটা রাজ পরিবারের সামার রেসিডেন্স হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
সিনাইয়া থেকেই ব্রাশোভ ঘুরে এলাম।
ব্রাশোভও স্কি রিসোর্টের জন্য বিখ্যাত। ঝকঝকে শহর, রঙ্গিন দালানকোঠা আর খোলা রেস্তোরায় ছাতার নিচে বসে সুস্বাদু লাঞ্চ উপভোগ্য ছিল। এটি বেশ জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা। কিছু প্রাচীন টাওয়ার, চার্চ এবং মূলত গ্রীষ্মের রঙিন পোশাকের ট্যুরিস্ট দেখতে দেখতেই একটা ব্যস্ত দিন কেটে গেল।
কয়েকদিন পরেই ফিরলাম বুখারেস্টে।
স্টেশনের কাছেই বাস স্টপেজ, রাস্তার উল্টোপাশে।
স্টপেজ যাত্রী অল্প।
আমি অপেক্ষায় আছি, আমার সিরিয়ালের বাসের জন্যে।
ষ্টেশন থেকে সরাসরি এয়ারপোর্টে যায়। কিছুক্ষনের আগেই একটা গেছে।
পরেরটার জন্যে অপেক্ষা ছাড়া এখন আর কোন উপায় নেই।
একটা চৌদ্দ-পনের বছর বয়সী ছেলে নজরে পড়ল।
কিছুটা দূরে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত রুমানিয়ার নয়।
গায়ের রং ফর্সা হলেও রুমানিয়ানদের মতো সাদা নয়। বরং কিছুটা ময়লা হয়ে যাওয়া ফর্সা। পোশাক আশাকে দৈন্যতার ছাপ সুস্পষ্ট।
সে অনেকক্ষণ ধরে আমাকে দেখছে।
বুঝতে দিতে না চাইলেও, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না।
বেশ কিছুক্ষণ পরে, আমার কাছে এসে ভাঙ্গা ইংরেজিতে জানতে চাইলো,
- “ তুমি কি মুসলমান?“
- “ হ্যাঁ, কেন?” অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লাম।
- “আমিও মুসলমান। সব মুসলমান ভাই ভাই।“ বলে হাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরে ফেলল। অনেকটা মুসাফাহা করার মতো। ইংরেজি এখনো ভাঙ্গা ভাঙ্গা।
- “তোমার কাছে ডলার আছে?” কিছুটা ইতস্তত করেই জানতে চাইল।
- “আছে।“ এক কথায় উত্তর দেই।
কথা বাড়াতে চাই না।
তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে গেছে আমার কাছে। টাকা চাইবে। এরকম সাহায্য প্রার্থী আগেও দেখেছি।
- “ ব্রাদার, আমার কাছে একটা ডলারের নোট আছে। কিন্তু এটা আসল না নকল বুঝতে পারছি না। তুমি কি একটু দেখবে?”
তাজ্জব ব্যাপার!
এমন অনুরোধ কখনোই পাইনি। বিস্মিত কণ্ঠেই বললাম,
- “আসল না নকল? আমি কিভাবে চিনবো? আমি আসল বলার পরে যদি দেখা যায়, সেটা নকল?”
- “ তোমার মানিব্যাগ বের করে দেখবে? একটা ডলার বের করে একটু মিলিয়ে দেখো না? দুইটা ডলার পাশাপাশি রাখলেই বুঝা যাবে। আমারটা আসল ডলার কিনা?” ইংরেজি ভাঙ্গা ভাঙ্গা হলেও কণ্ঠের কাতরতা বুঝতে বেগ পেতে হয় না।
- “ তুমি মানি চেঞ্জারের কাছে যাও। তারাই তোমাকে বলে দিবে।“
- “তাদের কাছে যাওয়া যাবে না। আমরা রিফিউজি। আমার ডলার নিয়ে নিবে। বলবে, আমি চুরি করেছি।“
তার উত্তর শুনে আরো বিস্মিত হলাম। করুণাও হলো। হয়ত কোন ট্যুরিস্ট তাকে দিয়েছে। নিজের টাকা। অথচ, খরচ করতে গেলে সন্দেহ! বিস্মিত কণ্ঠেই বললাম,
- “তুমি যদি মনে করো, সে তোমার টাকা মেরে দিবে, তাহলে পুলিশের কাছে গিয়ে সাহায্য চাও।“
তারপরে রাস্তার অপর পাশে এক পুলিশ দেখিয়ে, তাকে আরো বললাম,
- “ আমার হাতে সময় আছে। তুমি চাইলে, ঐ পুলিশের কাছে গিয়ে আমি সব বুঝিয়ে বলতে পারি।“
আমার আঙ্গুল অনুসরণ করে পুলিশ দেখামাত্রই, সে আর কিছু বলল না। দ্রুত চলে গেল।
মনটা খারাপ হলো।
হয়ত পুলিশ দেখলে ভাববে, ট্যুরিস্টের কাছে সাহায্য চাইছে। তারপরে ধরে টাকাপয়সা কেড়ে নিবে।
নিশ্চয় পুলিশের সাথে এর আগের অভিজ্ঞতাগুলো সুখকর ছিল না। তাই পুলিশের সামনে পড়তে চাচ্ছে না। মন খারাপ করেই বসে রইলাম।
অনেকক্ষন পরে আমার বাস এলো।
লাইন ধরে একজন একজন করে উঠছি।
হঠাৎ দেখি শখানেক গজ দূরে, মোড়ের আড়ালে কিশোরটি। বাস স্টপেজের দিকে তাকিয়ে আছে।
একবার মনে হলো, হাত নেড়ে কি যেন ইশারা করছে? আমাকে বিদায় জানাচ্ছে ? ছেলেটা এত ভালো? আর আমি কিনা তাকে ভুল বুঝেছিলাম!আমার সন্দেহবাতিকতা কবে দূর হবে?
আর বেশি কিছু দেখার সুযোগ নেই। মনোযোগ এখন বাসের পাদানিতে।
স্যুটকেসটা পাদানিতে রেখে, এক পা দিয়ে উঠে গেলাম।
এক হাতে স্যুটকেস ধরে রেখেছি। আরেক হাত দিয়ে দরজার হ্যান্ডেল ধরে বাসের ভিতরের সিড়ি দিয়ে উঠার জন্য পা তুলেই দেখি এক মোটা মহিলা নামার চেষ্টা করছে।
ইতোমধ্যে আমার পিছনেও একজন পাদানিতে উঠে দাঁড়িয়েছে।
আশ্চর্য, এমন গা ঘেঁষে কেউ উঠে দাড়ায়?
শুধু তাই নয়। বিরক্তিকরভাবে গায়ের সাথে লেপ্টে আমাকে উপরের দিকে ঠেলে রেখেছে।
আমি পিছনে যেতে পারছি না। সামনেও এগোতে পারছি না। পাদানির তলার সিড়িতে এক পা, মধ্যের সিড়িতে আরেক পা। একটা হাতও খালি নেই।
রুমানিয়াতে যাত্রীরা নামে বাসের পিছনের দরজা দিয়ে। সামনের দরজা শুধু উঠার জন্যে ।
কোনমতেই বুঝতে পারছি না, এই মোটা মহিলা সামনের দরজা দিয়ে নামছে কেন?
আর পিছনের লোকটি একটু অপেক্ষা করে উঠলে চলতো না?
বাস তো আর তাকে ফেলে যেতো না?
হতবাক হয়ে দুজনের চাপে পিষ্ট হচ্ছি।
দরজার সাইডে চেপে মহিলাকে নামার জন্যে জায়গা বের করতে গিয়ে দেখি, মহিলা তার শরীরের ভার আমার শরীর থেকে সরাচ্ছে না। তাই, আমি সরতেও পারছি না। এভাবে আরো কয়েক সেকেন্ড চলে গেল। মহিলার পিছনের এক পুরুষকে দেখলাম কেমন যেন একটা ইশারা করলো। পরক্ষনেই সেই পুরুষ এবং মহিলা দুজনেই সামনের দরজা দিয়ে নামার চেষ্টা বাদ দিয়ে, অস্বাভাবিক দ্রুততায় দৌড়ে পিছনের দরজা দিয়ে নেমে গেল। আমি হাপ ছেড়ে বাঁচলাম।
উঠতে উঠতেই খেয়াল করলাম আমার পিছনে যে যাত্রী ছিল সেও নেই!
বাসে উঠেনি? তাহলে ব্যাটার এতো তাড়ার কি ছিল?
হাতের সুটকেস নামিয়ে রাখতে গিয়েই বুকটা ধ্বক করে উঠলো।
পকেটের মানি ব্যাগ গায়েব হয়ে গেছে!
বাসের দরজা বন্ধ, বাস চলতে শুরু করেছে ততোক্ষণে।
চিৎকার করে ড্রাইভারকে বললাম, আমার মানি ব্যাগ চুরি হয়েছে।
ড্রাইভার মাথা ঘুরিয়ে শুধু একবার আমায় দেখলো।
তারপর, নির্বিকার ভঙ্গীতে গাড়ি চালাতে লাগল।
বাসের পিছনের বড় কাঁচের মধ্য দিয়ে দেখি স্টপেজের পাশেই সেই কিশোর, মোটা মহিলা আরো কয়েকজন।
তবে কি তারা সব একই চক্রের সদস্য ছিল?
আমি আবার চিৎকার করলাম।
চেঁচিয়ে বললাম, পকেটমারদের দেখতে পাছি!
কিন্তু আমার চিৎকারে কোনো লাভ হলো না।
সবাই নির্বিকার। যেন কিছুই হয়নি।
বাস নিজ গতিতে এগিয়ে চলছে এয়ারপোর্টের দিকে।
আর আমি, স্টপেজের সেই জটলা থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছি।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ১১:০০