আগের কাহিনি জানতে কৌতুহল
মেয়েটি নিশ্চুপ।
আগ্রহের চেয়ে বেশি অস্বস্তি নিয়ে তার দিকে তাকালাম।
তাকিয়ে আছে সামনে, দেয়ালের দিকে।
দৃষ্টিতে নির্লিপ্ততা। চেহারায় ফুটে উঠেছে অসহায়ত্ব।
দেখে নিজের মধ্যে অপরাধবোধ জেগে উঠেলো।
হঠাৎ করেই নিজেকে বাংলা সিনেমার ভিলেনের ভুমিকায় আবিস্কার করে, নিজের কাছেই লজ্জিতবোধ করছি।
আলাপচারিতায় সঞ্চালকের ভূমিকা লোকটি নিজ উদ্যোগে নিয়ে নিয়েছে।
মেয়েটিকে ইংরেজিতে জানতে চাইল, আমাকে পছন্দ হয়েছে কিনা?
মেয়েটি চকিতে তাকালো, আমার দিকে।
তারপর, মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। মুখে জোর করে আনা স্মিত হাঁসি।
সাফল্যের হাঁসি মুখে এনে, লোকটি এবার আমার কাছে জানতে চাইল, যেহেতু সে আমাকে পছন্দ করেছে, আমি তাকে কোনো ড্রিংক্স অফার করতে চাই কিনা?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও, ওয়েট্রেসকে ইশারা করে মেয়েটিকে আমার মতোই আরেকটা ড্রিংক্স দিতে বললাম।
মনে মনে গালি দিলাম, লোকটাকে। আমার পয়সা খসানোর জন্যে।
অন্যদিকে, মেয়েটিকে ড্রিংস অফার করতে পেরেছি ভেবে একটু স্বস্তিবোধ করলাম। কে জানে সর্বশেষ কখন, কী খেয়েছে?
পরিস্থিতির পরিবর্তনে ততক্ষণে ভয় পেতে শুরু করেছি।
মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
শুধু একটা অপরিচিত লোক এসে টেবিলে বসেছিল।
তখন মনে ভয় ছিল না। ছিল অস্বস্তি আর বিরক্তি।
এখন একই টেবিলে পাশের চেয়ারে এক কিশোরী বসে আছে, আমার সম্মতির অপেক্ষায়।
এদের আসল মতলব সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারনা নেই।
আমাকে কোন বিপদে ফেলবে কে জানে?
এই বিদেশ বিভূঁইয়ে আমার কিছু হলে, কেউ তো জানতেও পারবে না!
বরং সবুজ পাসপোর্ট আর তরুণ বয়স বিবেচনায় ধরেই নিবে, আমি দালালের খপ্পড়ে পড়েছিলাম। পরে বনিবনা না হওয়ায় বেঘোরে প্রাণ দিতে হয়েছে। অন্যদিকে, আমার বাবা-মা আজীবন আমার ফেরার অপেক্ষায় থাকবে। না জেনেই, কী ঘটেছে আমার ভাগ্যে?
ঈশ! কোন দুঃখে যে বলতে গিয়েছিলাম, আমি একা বেড়াতে এসেছি?
বিদেশে একা ট্রাভেল করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছে। এমন অনেক খবর মাঝে মাঝেই পেপারে আসে।
অনেক দেশেই মেয়েদের মাধ্যমে ট্রাপে ফেলে, পরে পুলিশের সহযোগিতায় ট্যুরিস্টদের ফাঁসানোর কাহিনীও হরহামেশা শোনা যায়। এমনকি, ড্রাগ কেইসে ফাঁসানোর উদাহরণও আছে। বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের দেশেই এমন ঘটনা বেশি ঘটে। এই দেশের পুলিশের দুর্নীতির যে কাহিনি শুনেছি, এরা নির্দ্বিধায় আমাকে এক ভাগ্যান্বেষী হতভাগ্য তরুণ হিসেবে ফাঁসিয়ে দিতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা, মুসলিম সমাজে বেড়ে উঠা, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ, বাবা-মায়ের আদর্শ আর ব্যক্তিগত নীতিবোধ মিলিয়ে এ ধরনের কোন কিছুতে জড়াতে ঘোর আপত্তি আছে। এখন যে কোনো উপায়ে এই বিপদ থেকে বাঁচতে হবে।
চিন্তা করেও কূলকিনারা বের করতে পারছি না।
শত চেষ্টার পরেও চোখে মুখ থেকে অস্বস্তি আর ভয়ের ছাপ সরছে না।
বিপদে পড়লে মানুষের বুদ্ধি সুদ্ধি লোপ পায়। আমি বোকার মতো ভয় দেখাই,
-“পুলিশ যদি ঝামেলা করে?”
পাকা খেলোয়াড়ের মতোই লোকটি এমন সহজ শিকার চিনতে ভুল করেনি।
প্রশ্ন শুনে তার ধারনা আরো শক্ত হয়।
এখন সে পুরোপুরি নিশ্চিত। আমি শুধু আনাড়িই নই। বরং চরম বেকুব কিছিমের এক চিড়িয়া।
সে অভয় দেয়,
-“ তুমি পুলিশ নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না। আমার হাতে ছেড়ে দিতে পারো। একটা নোট হাতে দিলেই সে তোমাকে কিছু বলবে না। “
খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টায় শেষ অবলম্বন হিসেবে সতর্ক করি,
-“হোটেলের রিসেপসনিস্ট নিষেধ করেছে। বাইরের কাউকে রুমে নেয়া যাবে না।“
সে নিজেই উপায় বাতলে দিলো,
- “রিসেপসনিস্টের জন্যে কিছু চকোলেট নিয়ে যেয়ো। বাকিটা আমি দেখবো।“
ঠান্ডার মধ্যেও ঘামতে শুরু করেছি।
ধরা যে ইতোমধ্যে খেয়েছি, সেটা বুঝতে পেরেছি।
তবে কিছুটা, না পুরোটা? সেটা এখনো ঠাহর করতে পারছি না।
নিজেকেই ধিক্কার দিচ্ছি, মনে মনে।
হোটেলে বসে একা একা টিভি দেখলেই বরং নিরাপদ ছিল।
মনে মনে মুরুব্বিকেও গালি দিলাম। আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি, সুযোগ থাকলেই কিংবা নির্দোষ মনে হলেও সব কিছু দেখার প্রয়োজন নেই।
চরম অসহায়ত্বের এর চেয়ে ভালো উদাহরণ হতে পারে না।
জেনে-বুঝে ফাঁদে পা দিতে হচ্ছে।
বিপদ চোখের সামনে দেখেও এড়াতে পারছি না। কী করবো এখন?
কি বললে এরা আমাকে ছেড়ে যাবে?
মাথায় কিছুই আসছে না।
আমাকে চুপচাপ দেখে, সে নিজেই আবার বলে উঠলো, তুমি যা যা বলবে, এই মেয়ে সব করতে পারবে।
বলেই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে, জিজ্ঞেস করল।
- “ কি? পারবে না?”
নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে মেয়েটি মাথা ঝাকালো।
সম্মতি নাকি অসম্মতি? খেয়াল করার মতো মানসিকতা অনেক আগেই গায়েব হয়ে গেছে।
মোমের পুতুলের মতো কোমল এক চেহারা দেখে এতো ভয় পাওয়া সম্ভব? এই পরিস্থিতিতে না পরলে জীবনেও বিশ্বাস করতাম না।
দুজনেরই ড্রিংক্স শেষ।
খালি বোতল টেবিলের উপরে।
ওয়েট্রেস এসে জানতে চাইল, আরো কিছু চাই কিনা?
আমি কিছু না বলে, মাথা ঝাকিয়ে নিষেধ করলাম।
শিকার যে জালে আটকে গেছে, লোকটি বুঝে ফেলেছে।
বেহুদা সময় নষ্ট করতে চাইলো না। বললো,
- “ অবশ্যই রাত দশটার মধ্যে ছেড়ে দিও। সে স্টুডেন্ট। দেরী করে বাসায় ফিরলে সমস্যা হবে।“
পাকা শিকারি।
কিছু বলার সুযোগ দিয়ে বোকামি করতে চায় না।
আমার প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় না থেকে, হোটেলে যাওয়ার আগেই ক্যাশ পেমেন্ট করতে বলল।
আশ্বস্ত করে বলল, ডলার দিলেও চলবে।
টাকার কথা শুনেই, বিদ্যুৎ চমকের মতো, মাথায় বুদ্ধিটা এলো।
তাই তো!
টাকা!
টাকাই এখানে সব কিছুর মূল নিয়ামক!
ছবি- গুগল
শেষ পর্ব সব ভালো যার শেষ ভালো
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১০