নামাজের পাটিতে বসে লিমা আপা অঝোরে কাঁদছে। একটাই মেয়ে দুটো ছেলের পর।; শান্ত, হাস্যজ্জ্বল, ভদ্র অনেক বিন্দু। তবে প্রচুর রাগ-জেদ আছে এবং খারাপ আবদার ও প্রশ্রয় দেয় না একদম ই। সত্যের জন্য অধিকারের জন্য কথা বলে দেখে অনেকের চোখে বেয়াদব, ঠোটকাঁটা। আজ মেয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, ছোট্ট মেয়েটাকে কি না যত্নে লালন করেছে লিমা আপা।। কখন এত বড় হয়ে গেছে মেয়েটা আমরা কেউ বুঝতেও পারিনি।
প্রায় ছয় থেকে সাত বছর আগেকার কথা, ২০১২ তে বিন্দুর বিয়ে হয়। বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে, ছেলে ব্যাংকে চাকরী করে। বিন্দুর বাবার ইচ্ছা ছিলো ব্যাংকার হবে মেয়ের জামাই। বিন্দুদের ব্যাবসা ছিলো খুব বড়, নিজস্ব বাড়িও আছে আর অভাব দেখেনি কখনো, হাত ভরে খরচ করতো সবসময়। ছেলেদের ও নিজস্ব বাড়ি আছে, তিন ভাই ছিলো এখন দুজন কারণ এক ভাই সবকিছু ছেড়ে দেশের বাইরে থাকে। মা-ভাইদের খোঁজ রাখার প্রয়োজন মনে করে না।
বিন্দু ২০০৯ এ ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ই ওকে বিয়ে দিতে তোরজোড় করেন ওর বাবা আমির আলী। মেয়েকে পড়াশুনা না করিয়ে বিয়ে দিয়ে দিতে চিন্তাভাবনা করছিলেন তিনি। অবশেষে বছর তিনেক পরে একজন ব্যাংকার ছেলের খোঁজ পান মেয়ের জন্য । ছেলে দেখতে তেমন কিছুই না পুতুলের মত মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলো ভালোভাবে ছেলের খোঁজ খবর না নিয়ে, পরিবারের হদিস না জেনেই। আমির আলী সৎ বলে দুনিয়ার সবাইকেই সৎ ভাবতেন বিশ্বাস করতেন।
ইমরান ছেলে হিসেবে খুব ভালো, ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছে। ছোট ছেলে হলেও দায়িত্ববোধ অনেক ওর; সংসার, মা,ভাই সবকিছুই ইমরানের অধীনে। বিন্দুকে ও ভালোবাসে খুব, দুজনের ভালোই কাটছিলো সংসার। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে সবাই একসাথে থাকে, বিন্দু চারতলায়, শ্বাশুড়ি দোতলায় বড় বউয়ের সাথে থাকে। বিন্দু তেমন কোন কাজ পারে না এর জন্য কথার বুলিও বেশ হজম করতে হয়। এসবে ওর মাথায় যন্ত্রণা নেই কারণ না পারলে তো হজম করতেই হবে আর এজন্য শিখতেও হবে। বিয়ের দ্বিতীয় মাসেই বিন্দু কনসিভ করে, মেয়ে হয় ফুটফুটে। ইরিনা বাবার নামের সাথে মিল রেখে রাখা নাম, ভালোই যাচ্ছিল সব মিলিয়ে। হঠাৎ একদিন ঘরে বড় বউয়ের চিৎকার চেঁচামেচি; "অনেক সহ্য করেছি আর না, সব দিকে অশান্তি, তুমি আমাকে সুখী করতে পারো না কখনোই, শান্তি ও পাই না তোমার সাথে থেকে। না জেনে বুঝে বিয়ে করেছিলাম চলে যাবো থাকবো না আর।" বিন্দু তখনো কিছু বুঝতে পারে নি, এখনো কিছুই জানে না। হ্যাঁ ঝগড়া লাগা স্বাভাবিক আগেও ঝগড়া হয়েছে তবে এবার সুর ভিন্ন। ইমরান বিন্দুকে বারবার বলছে ঘরে যেতে কিন্ত কেন? বিন্দু আজ সব জানবে, ইমরান ওকে সব বলবে। আর কত ? কি নিয়ে এত ঝগড়া হয় এদের মধ্যে সব তো ঠিকঠাক তবুও কেন, ইমরান থামাতে গেলে ওর সাথেও লেগে যায়, এখানে দোষ কার ? বিন্দুর কাছে ওর ভাসুর অনেক ভালো, খুব শান্ত স্বভাবের লোক, কখনো ওর দিকে তাকিয়েও দেখেনি। তবে কি নিয়ে এই লোকটার সাথে সবাই এমন করে। বিন্দু এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে, বোধের ধারে কাছে ও নেই, অজ্ঞান ও সবকিছু থেকে এখনো।
ইমরান ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে চলে গেলো বিন্দুর কোনরকম কথার উত্তর না দিয়েই। বিন্দুর মাথায় আস্তে আস্তে বেশ কিছু জিনিস ঘুরছে কিন্তু মিলাতে পারছে না। হাতের কাছে চোখের সামনে সবকিছু থাকা সত্ত্বেও ভাবনা চেপে বসেছে মনে জড়োসড়ো হয়ে, কি হচ্ছে এসব কি হতে যাচ্ছে আসলেই।
সকাল হলো, বিন্দু নিচে নামতেই আবার চিৎকার চেঁচামেচি বাড়ির বড় বৌ ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে আর যাওয়ার সময় দিয়ে গেল বিন্দুর সব প্রশ্নের জবাব। যেন বুলেটের মত ছিদ্র করে দিলো বিন্দুর ধ্যান-ধারণাকে, মনে হচ্ছিল এই বুঝি সব শেষ। ভাসুর ঘরে বসা, চোখ দুটো লাল রক্তে টগবগ করছে। বিন্দু ওর ভাসুরের চোখের দিকে কখনোই ভালো করে তাকায়নি এর আগে। ভাসুরের বউ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বুলেট ছুড়ছে "এই যে বিন্দু শোনো আমার সাথে সাথে এরা তোমার জীবন ও নষ্ট করে দিয়ছে। তোমার ভাসুর তোমার কাছে অনেক ভালো তাই তো, না! ভুল ধারণা এটা তোমার। ওর মত নিকৃষ্ট খারাপ আর হতে পারে না কেউ। ও আমাকে সুখ দিতে পারে না, বুঝো? তোমার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করো স্ত্রী সুখ কি?"
বিন্দু তখন লজ্জা পাচ্ছে, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে বলছে প্লিজ ভাবি চুপ করুন, রাগ করবেন না, প্লিজ ঘরে যান। স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া হতেই পারে। কিন্তু কে শুনে কার কথা সে এবার আরো তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখালো। বিন্দু ওকে আমি ডিভোর্স লেটার পাঠাবো, তুমি এ ও জানো না যে সে একটা নেশাখোর। ও ইয়াবা খায়, গাঁজা খায় আর এসবের ধান্দা করে। তুমি বুঝোনা সে কেন এত রাত করে বাড়ি ফিরে। যে দোকান টা ছিল তার তাও নেই। এখন শুধু ইমরানের চাকরীতেই সংসার চলে। বিন্দু তাও বলল, ভাবী মাথা ঠাণ্ডা করেন আর ঘরে চলুন। এসব কিছু না, সবাই একসাথে থাকব। বিন্দু তা আর হয় না, ভালো থেকো, সাবধানে থেকো।
কিছুদিন পর ইমরান অফিস থেকে ফিরেনি এখনো, বিন্দু ইরিনার সাথে খেলা করছে। হঠাৎ ওর দরজায় আওয়াজ হলো। দরজা খুলেই দেখলো আর কেউ না ওর ভাসুর। কেমন যেন অদ্ভূত দেখাচ্ছে তাকে, বিন্দু না বুঝেই বললো ভাইজান আপনি ভিতরে আসুন। ওর ভাসুর বললো, না ভিতরে আসবো না, তোমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা হবে? বিন্দু উত্তর দিল "না ভাইজান।" আবার ওর ভাসুর বললো তাহলে কি পাঁচশ টাকা হবে ? বিন্দু আবার ও না বলায় ওর মুখ চেপে ধরে বলল, " আলমারি খোল,গহনা দে তোর আমাকে, মাথা ঠিক নেই। মা ঘুমায়, তুই টাকা দে, আমার সমস্ত শরীর কাঁপছে, জ্বলছে নেশা করতে হবে, টাকা দে"। বিন্দু হতভম্ব হয়ে গেলো ভয়ে চিৎকার ও দিতে পারছে না। নিচে থেকে ওর শ্বাশুড়ি আওয়াজ পেয়ে ছেলেকে টেনে হিঁচড়ে বুঝিয়ে নিচে নিয়ে গেছেন। বিন্দুর গাল লাল হয়ে গেছে, কিছুক্ষণ পর ইমরান বাড়ি ফিরলে সবকিছু জানতে পারে। বিন্দুকে শান্ত্বনা দেয় কেননা বিন্দু তখন ও ট্রমা থেকে বের হতে পারেনি। কি দেখলো সে! চোখ মেলাতে পারে না, এটা ই কি ওর ভাসুর ? একি অবস্থা এই জন্যেই কি ভাবী চলে গিয়েছেন। ইমরান এবার সবটা খুলে বললো। তাদের বাড়ির লোন ও পরিশোধে টানতে হচ্ছে। বিন্দু ওর শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলে ভাড়া থাকার চিন্তা করলো। ঐ ঘটনার পর থেকে প্রায় রোজকার বিনোদন হত রাতে। ওর ভাসুরের। মারামারি,চিৎকার, চেঁচামেচি এখন হরদমের বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। বিন্দু সন্ধ্যা হলেই আতংকে থাকতো। মেয়েকে নিয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে থাকতো । পরে ভাড়া চলে গেলো ওর মায়ের বাড়ীর আশেপাশে। ততোদিনে বিন্দু আর আগের মতো নেই। দুমড়ে মুচড়ে কেমন যেন হয়ে গেছে। এতটুকু বয়সে মাথার চুল ঝরে গেছে, ভিতরে ভয় ঢুকে গেছে, কেমন যেন অদ্ভূত পরিবর্তন। এখন একা সব সামলায়; সংসার, মেয়ের স্কুল, ইমরানের আবদার। ও হঠাৎ একদিন বুকে ধরে বসে পড়ল, কথা বলতে পারছেনা যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ইমরান দ্রুত হসপিটালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বিন্দুকে চেকআপ করে বললো এই অল্প বয়সে হার্টের সমস্যা হল কি করে। ইমরান তাজ্জব হয়ে গেলো বিন্দু ওর শ্বাশুড়িকে এবার বললো মা আপনাদের বাড়িতে এসে আজ আমার এই দশা, হার্টের ওষুধ নিতে হয় এখনি আমাকে। কেন আমার জীবন টাও নষ্ট করলেন কি দোষ ছিলো আমার, কি অপরাধ ছিলো। আমার মেয়েটাও অনেক কিছু দেখেছে এখানে আসতেও ভয় পায় এখন সে। কি করবো মা ? ওর শ্বাশুড়ি উত্তর দিলো কি আর করবে সব ই তোমার কপাল। এখন ছেলেকে তো ফেলে দিতে পারি না। কেউ না দেখলেও আমাকে দেখতে হবে। লাখ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে ওর পিছনে, রিহ্যাব সেন্টারগুলোতে ভর্তি হয় এবং বের হওয়ার তিন মাস পর থেকে আবার শুরু হয় নেশা।
"নেশা" মাদক আর কি আছে এতে ? সবাই জানে বিষ। মানুষ শেষ হয় সাথে ওর আশেপাশের মানুষকেও নিঃশ্বেষ করে ফেলে। খুব কম মানুষ ই মাদক বা নেশা ছাড়তে পারে, কিন্তু ১০০ ভাগের মধ্যে ৯৫ ভাগ ই নেশা থেকে বের হতে পারে না। বিন্দুর ভাসুর নেশার সাথে জড়িয়েছিলো ব্যাবসার কাজের মাধ্যমে। কাপড়ের ব্যাবসা ছিল ইমন সাহেবের, উন্নতি হচ্ছিলো অনেক। অল্প সময়ে অনেক টাকার মুখ দেখেছে, এত টাকা কি করবে , সেকারণেই হয়তো জ্ঞান হারিয়ে নেশায় মত্ত হয়েছে। হায়রে মানুষ ! কত গরীব আজ খেতে পারে না, দান করে দিলেও আল্লাহ সোয়াবের ভাগীদার করতো তাকে।
লিমা আপা নামাজের পাটি থেকে কিছুতেই উঠছে না কারণ বিন্দু ব্রেইন স্ট্রোক করেছে, নাক-মুখ দিয়ে রক্ত চলে এসেছে। কি হবে কেউ জানে না। আই সি উ তে অবজারভেশনে আছে, ছোট্ট মেয়েটা হারিয়ে গেল, কখন বড় হয়ে গিয়ে এত ঝামেলা সহ্য করলো কেউ জানে না। ইরিনা মাত্র ক্লাস ওয়ানে পড়ে, কি হবে মেয়েটার। কেউ জানে না , এই কষ্ট, চিন্তা ভাবনা, ভয় সব কুঁড়ে কুঁড়ে ভিতরটা শেষ করে দিয়েছে। এখানে দোষ কার ? বিন্দুর ! সে সব মেনে নিয়েছে বলে ? এতটুকু বয়সে কত কি সহ্য করেছে বলে ? নাহ দোষ বিধাতার ওকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছে বলে। এত বড় ভুল হল এই মেয়েটার সাথে যেন জীবনটাই তছনছ হয়ে গেলো। দোষ আসলে কাদের ? ঐ পরিবারের যাদের নেশাগ্রস্ত সদস্য থাকা সত্ত্বেও সব লুকিয়েছে। দোষ সমাজের যারা নিষ্পাপ ফুলের মত বিন্দুর জীবন শেষ করে দিয়েছে। দোষ সবার যারা এখনো ভণ্ডামী করে বেড়ায় এসব নিয়ে। বিন্দুর ভাসুর ওদের বাসা চিনে সেখানে গিয়েও টাকার জন্য ইমরানের সাথে মারপিট করে। বিন্দু থামাতে গেলে হিংস্রভাবে ওকেও অ্যাটাক করে আর সেই ভয়ে বিন্দু স্ট্রোক করে।
দোষ ! হ্যাঁ দোষ শুধু বিন্দুর, ভালো থেকে সব মেনে নিয়েও শ্বাশুড়ির কাছে শুনতে হয়েছে "তোমার কপাল"! দোষ পড়াশুনা না করে বাবার মান রাখার জন্য বিয়েতে রাজি হয়েছে বলে। দোষ ইমরানকে ভালবাসা সত্ত্বেও সময়মতো সঠিক সত্য জানতে পারেনি বলে।
কেন মানুষ সত্য লুকায়, কেন কেউ কারো জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, কেন মেয়ে মানুষদের ই দোষ বেশি ! কেন আমাদের জীবন ই বেশি নষ্ট হয়, কেন ? আমরা মেয়ে বলে এটাই কি আমাদের বড় দোষ ? হ্যাঁ আমরাই সমাজে দোষী, আমরা কিছু না করেও দোষের বোঝা ঘাড়ে বহন করি আর এক সময় মরে যাই কোন দোষ না করেও। কারণ আমাদের জন্মটাই একটা দোষ !
হাফিজা খাতুন নিপা
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ২:১৮