খলিল মিয়া বাজার থেকে হন্তদন্ত হয়ে চলে এসেছে, বাসায় ঢুকেই মেয়েকে ডাকছে। খলিল মিয়ার স্ত্রী জুলেখা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এলো। 'কি হইছে, মিম গোসলে, এভাবে ডাকতাছেন ক্যান ?' খলিল মিয়া বললো 'আসার সময় দেখলাম রাস্তায় ভিড়, এক বাস একটা মহিলা আর তার বাচ্চাটারে চাপা দিয়া পালাইছে। আহারে মহিলাটা তার স্বামীর লগে রাস্তা পার হইতাছিলো। বড় মায়া লাগছে গো মিমের মা। মাইয়াডারে লইয়া বড় চিন্তা হয়। একলা স্কুলে যায়, ওরে সাবধানে রাস্তা দেইখা চলতে কইও। মানুষ আর মানুষ নাই, মায়া-দয়া ও নাই।'
মিম গোসল সেরে একেবারে স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে বের হলো। বাবার সাথে বসে ভাত খেয়ে স্কুলে গেলো। আজ ওর স্কুল বারো টা থেকে কোচিং আছে কিনা। হেঁটে যায় মিম স্কুলে, বাসা থেকে বেশি একটা দূর না স্কুল তবে রাস্তাটা অনেক বড়,অনেক চওড়া। অনেক বড় বড় গাড়ি চলে, গাড়ি চলে একটার সাথে আরেকটা পাল্লা দিয়ে।
খলিল মিয়ার একটা মুদি দোকান আছে, একটাই মেয়ে। যতটুকু আয় হয় তা দিয়ে বেশ ভালোভাবেই দিন চলে ওদের। খলিল মিয়ার ইচ্ছে মেয়েকে অনেক শিক্ষিত বানাবে, মেয়ের সব আশা পূরণ করবে, মেয়ে অনেক ভালো কলেজেও পড়বে এটাই তার স্বপ্ন। মিম একটা ভালো স্কুলে পড়ে ক্লাস টেনে, ছাত্রীও ভালো। দেখতে বেশ মলিন, মায়াভরা চেহারা, মিষ্টি চাহনি, ভদ্র স্বভাবের, অনেক আস্তে কথা বলে। বাবা-মায়ের কথার অবাধ্য না কখনোই। সে বাবা-মা কে বুঝেও বেশ, এখনকার বাচ্চাদের থেকে অনেক আলাদা। মিমের ইচ্ছা অনেক বড় হবে, ম্যাজিস্ট্রেট হবে, বাবাকে বলেছে এবার অনেক ভালো একটা কলেজ়ে ভর্তি হবে।
খলিল মিয়া তার স্ত্রী জুলেখাকে সেদিন বলছিলো 'মেয়েটারে একটা ছাতা কিনা দিমু, রোইদ দিয়া আহে মাইয়ডা আমার, লাল হইয়া যায়। কিছুদিন পর ওর জন্মদিন। ওরে আমি একটা ছাতা গিফোট দিমু। মাইয়াডা কখনো কিছু চায় না, এইটা ওর দরকার। কি কও তুমি ?
জুলেখা হেসে বললো, আর কিছু নাই নাকি যে হুদা একটা ছাতা দিবেন। খলিল মিয়া ও হেসে দিলো। বললো আরে না আমার একটা মাত্র মাইয়া, ছাতার লগে একটা সুন্দর জামা আর একটা মোবাইল ফোন ও দিমু। মাইয়া দুইদিন পর স্কুল থেইকা কলেজে যাইবো, একটা ফোন তো লাগবোই। তুমি এসব কইয়ো না ওরে কেমন।
মিম বিকেলে বাসায় ফিরলো, হাত-মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে পড়তে বসে মা কে বললো, মা জানো রাবুর মামা একসিডেন্ট করেছে, একটুর জন্য বেঁচে গেছে। বাসের ড্রাইভার গুলো এমন কেন। আহ কত কষ্ট হচ্ছে ওর মামার, পা দুটো একেবারে পিষিয়ে দিয়েছে। ভালো যে আমরা ছাত্র, একটু হলেও দয়া দেখায় তবে সব ড্রাইভার এক না। রস্তায় চলতে ভয় হয় মা। দেশের সরকার-মন্ত্রী-সমাজ এরা কি আর একটু ভালো হতে পারে না। জুলেখা বললো 'মা রে তোর বাপ তোকে নিয়ে অনেক চিন্তা করে, তুই সাবধানে রাস্তা পার হইস, সাবধানে চলিস। আজ সকালেই বাজারের রাস্তায় একটা বাচ্চা ও তার মা রে বাস চাপা দিয়া গেছে।'
কিছুদিন পর ২৯শে জুলাই, মিমের জন্মদিন। ২৮ তারিখ রাতেই খলিল মিয়া মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে তার জন্মদিনে উপহারগুলো দিলো। মিম অনেক খুশী এসব দেখে। তবে ছাতাটা পেয়ে বেশি খুশি। কারণ রোদে ওর অনেক কষ্ট হয়। মাথার চান্দির ভিতরের মগজ টগবগ করে রোদে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো এত কিছু না দিলেও হতো বাবা, ছাতাটাই যথেষ্ট ছিলো। কাল আমি ছাতাটা নিয়া স্কুলে যামু কেমন।
ছাতাটা দেখতে বেগুনির মধ্যে হালকা সবুজ, পুরো ছাতাটায় সাদা রঙের ফুলের ছড়াছড়ি।
পরদিন সকালে মিম স্কুলে গেলো, কিন্তু কে বলতে পারে দু মিনিট বা ঘন্টা খানেক পর কি হবে? স্কুল ছুটি হলো, প্রখর রোদ, মুখে হাসি নিয়ে ছাতাটা খুললো মিম। স্কুল থেকে বের হয়ে বড় রাস্তাটা পার হবে বলে রাস্তার এক কোণে দাঁড়িয়ে। প্রচুর গাড়ি চলে রাস্তাটায়, বড় বড় বাস, বাসগুলো কেমন যেন হিংস্র। কিন্তু কিনারে দাঁড়িয়েও লাভ হলো না। সমুদ্রের পানি যেন পরক্ষনেই রক্তে রঙ্গিন হয়ে ঢেউ খেলতে লাগলো। বাসটা মিমকে নিয়ে থুবড়ে ঢুকে পড়েছিলো দেয়ালের ভিতর। ছাতাটার পাইপগুলো ভেঙ্গে শেষ। এবড়ো থেবড়ো হয়ে গেছে, পিষে গেছে মিম সাথে সব স্বপ্ন ।
লোকজন দৌড়ে এসে বাঁচাতে পারলো না মেয়েটাকে, টেনে হিঁচড়ে বের করলো মেয়েটার শরীরটাকে। বাস চালক ততক্ষণে উধাও। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে হত্যা করা হলো অবুঝ মেয়ে মিম কে। ছাতাটা পড়ে রইলো রক্তাক্ত অবস্থায়। জন্মদিন ছিলো মেয়েটার, কে জানতো আজ ই শেষ দেখা বাবা-মায়ের সাথে। মায়ের কোল আজ রক্তে রেঙ্গে যাবে, বাবার স্বপ্নগুলো ছাতার পাইপের মত ভেঙ্গে যাবে যা আর জোড়া লাগানোর না।
আজ প্রায় সপ্তাহ খানেক মিম আর নেই তবে আজ ও খলিল মিয়া সেই রাস্তার পারে বসে ছাতার কাপড়াটা ধরে চিতকার করে কাঁদে। বুক ফাটা কান্না, এর দায়ভার কার ? কাদের ?
আমরা এমন একটা সমাজে বাস করি এমন একটা দেশকে ভালোবাসি যে দেশ হয়তো স্বাধীন হয়ে ও কখনোই স্বাধীন হয় নি। স্বাধীনতা অর্জন করা হয়তো সহজ কিন্তু এটাকে রক্ষা করা ?
আজ ছোট ছোট ছাত্র-ছাত্রী দের রক্ত দিয়ে রাস্তা অঙ্কিত হচ্ছে, রক্ত শুকিয়ে যাচ্ছে তা আবার বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে, আবার সেই একই রক্তে রক্তাক্ত হচ্ছে। আইন নেই, বিচারক নেই, কেউ নেই !
আছে শুধু লোভ-হিংসা-মারামারি-হানাহানি। রাজত্বের দ্বন্দ। আর কত মা-বাবার বুক খালি হবে ? মিমের রক্তে রাস্তা রক্তাক্ত হবে আর কত। সুন্দর সমাজ, বাঁচার মত সমাজ কি আমরা আর কখনো আমাদের নতুন প্রজন্মকে দিতে পারবো না, ওদের কি কোন ভবিষ্যত নেই ? তাহলে কি সমাজ এখন জন্ম নিয়ন্ত্রণ পন্থায় চলবে ? তা না হলে তো আবার শত মিমের জন্ম হবে আর আবারো স্কুলে যেতে নিয়ে বাসের চাপায় প্রাণ হারাবে কোমলমতি মিমেরা। আবার ও শত বাবারা ছাতা নিয়ে চিতকার করে কাঁদবে। কিন্তু দুদিন পরে আবারো আমরা ভুলে যাবো সব। আবার নতুন নাটকের রচনা হবে, ভুলে যাবো আমরা মিমের কথা, ভুলে যাবো সব ছাত্র-ছাত্রীর আন্দোলনের কথা, নিরাপদ সড়কের কথা। আবার ও রক্তাক্ত বাস দানবগুলো নতুন রঙ লাগিয়ে রাস্তায় বের হবে নতুন পরিচয় নিয়ে নতুন কোন মায়ের বুক খালি করার জন্য এবং পড়ে থাকবে রাস্তার এক কোনে আবারো কোন এবড়ো থেবড়ো স্বপ্নের ছাতা......!!!
হাফিজা খাতুন নিপা
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৮:৪০