উপরের ছবির স্থানটি কোনো বিনোদন পার্ক, নার্সারি বা পিকনিক স্পট নয়। এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্ত-অঞ্চল কসবা উপজেলার কোল্লাপাথর গ্রামের একটি টিলার ওপর সাজানো-গোছানো একটি সমাধিস্থল। এখানে ঘুমিয়ে আছেন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া ৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যারা যুদ্ধ করে নিজেদের জীবনের বিনিময়ে আমাদেরকে একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। সারিবদ্ধভাবে সাজানো মুক্তিযোদ্ধাদের ওই সমাধি দেখতে সারা বছরই পর্যটকদের ভিড় থাকে। সমাধিস্থলের চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকার উঁচু-নিচু টিলা, নানা প্রজাতির বৃক্ষ, সামাজিক বনায়ন আর সবুজের সমারোহ পর্যটকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে মুক্তিযোদ্ধদের গণকবর কোল্লাপাথর শহীদ সমাধি এখন বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে! সাপ্তাহিক ও ঈদের ছুটিতে অনেকেই সেখানে গিয়ে শহীদদের গণকবরের ওপরে বসছেন, ছবি তুলছেন। এদের কাছে এটি এখন আড্ডা, বিনোদন ও পিকনিক স্পট। এদের বেহায়াপনায় কবরস্থানের পবিত্রতা নষ্ট হচ্ছে, বীর শহীদদের অসম্মান করা হচ্ছে। হিজাব-নিকাব পরা কিছু মেয়েও কবরের উপর বসে আড্ডা মারছে, ছবি তুলছে। মুসলমান হিসাবে কবরস্থানের পবিত্রতা সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম জ্ঞানটুকু নেই তারা আবার বোরকা, হিজাব, নিকাব পরে পর্দাশীল ঈমানদার মুসলমান সেজেছে!
কোল্লাপাথর শহীদ স্মৃতিসৌধ
কোল্লাপাথর শহীদ স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সমাধিস্থল। একটি ছোট টিলার উপরে এই সমাধিস্থল অবস্থিত। কসবা বাংলাদেশের একটি সীমান্তবর্তী উপজেলা যা মুক্তিযুদ্ধের সময় ২ নম্বর সেক্টরের আওতায় ছিল এবং এর পাশে ভারতের আগরতলা, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থাকার কারণে এ অঞ্চলটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম লক্ষে পরিণত হয়েছিল। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারাও জীবনবাজি রেখে এ এলাকাকে হানাদারমুক্ত রাখার চেষ্টা করেছিল। ফলে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এ এলাকায় বেশি যুদ্ধ সংগঠিত হয় এবং বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন। এখানে দুজন বীরবিক্রম, একজন বীরউত্তম, দুজন বীরপ্রতীক সহ মোট ৪৮ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি রয়েছে। এখানকার প্রতিটি কবরের উপরেই লেখা রয়েছে মুক্তিযোদ্ধার নাম এবং ঠিকানা। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম এবং তার আত্নীয়রা মিলে তার পৈতৃক ভিটায় মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ সংগ্রহ করে দাফন করেন। ১৯৭২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা প্রশাসক ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতায় এ স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়াও রেস্ট হাউস, তোড়ণ এবং পুকুরের পাঁকা ঘাট নির্মাণ করা হয়।
এখানে যাঁরা ঘুমিয়ে আছেন, সেই ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা হলেন: সিপাহী দশন আলী, জাকির হোসেন, আবদুল জব্বার, হাবিলদার তৈয়ব আলী, নায়েক আবদুস সাত্তার, সিপাহী আব্বাস আলী, ফারুক আহম্মদ, ফখরুল আলম, মোজাহীদ নূরু মিয়া, নায়েক মোজাম্মেল হক, নায়েক সুবেদার আবদুস ছালাম, নোয়াব আলী, সিপাহী মোসলেম মৃধা, প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম, আবদুল অদুদ, সিপাহী আজিম উদ্দিন, মতিউর রহমান, মোশারফ হোসেন, নায়েক সুবেদার মইনুল ইসলাম, সিপাহী নূরুল হক, আবদুল কাইয়ুম, সিপাহী হুমায়ুন কবির, ল্যান্স নায়েক আবদুল খালেক, ল্যান্স নায়েক আজিজুর রহমান, তারু মিয়া, নায়েক সুবেদার বেলায়েত হোসেন, রফিকুল ইসলাম, মোর্শেদ মিয়া, আশুতোষ রঞ্জন দে, তাজুল ইসলাম, শওকত, আবদুস ছালাম, জাহাঙ্গীর, আমির হোসেন, পরেশচন্দ্র মল্লিক, জামাল উদ্দিন, আবদুল আওয়াল, আবেদ আহাম্মদ, সিরাজুল ইসলাম, ফরিদ মিয়া, মতিউর রহমান, শাকিল মিয়া, আবদুর রশিদ, আনসার এলাহী বক্স, সিপাহী শহীদুল হক, সিপাহী আনোয়ার হোসেন, আবদুল বারী এবং অজ্ঞাত তিনজন। ওই সমাধিস্থলে রয়েছে নায়েক সুবেদার মইনুল ইসলামের কবর। তাঁর নামেই ঢাকা সেনানিবাস এলাকার অতি পরিচিত মইনুল সড়ক নামকরণ করা হয়েছে। এ সমাধিতে ৫০ জনের নাম রয়েছে। এর মধ্যে ৪৭ জনের পরিচয় মিলেছে। অন্য তিনজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য প্রয়াত ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর আসনের সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফুল হাই সাচ্চুর নেতৃত্বে তৎকালীন জেলা প্রশাসন কোল্লাপাথর শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত কবর চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেয়। জিয়া-এরশাদ-খালেদা - এই তিন আমলে সরকারি ভাবে কোল্লাপাথর শহীদদের স্মৃতির তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। এই সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদের উদ্যোগে সেখানে স্মৃতিসৌধ, মসজিদ, রেস্টহাউস, সীমানাপ্রাচীর ও পুকুরঘাট বানানো হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি এম তাজুল ইসলামের উদ্যোগে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় এই শহীদস্মৃতিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা হয়। কোল্লাপাথর থেকে খুব কাছেই ভারতীয় সীমান্ত। দুই দেশের ভ্রাতৃত্ববোধ ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে মনে করিয়ে দেয় এই সমাধিস্থল ও পর্যটন কেন্দ্র।
তরুণ প্রজন্ম ও মুক্তিযুদ্ধ
এটি দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের তরুণ প্রজন্মের বিরাট একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে না বা জানার আগ্রহ নেই। যারা জানে তাও খুব অল্প অথবা যা জানে তার মধ্যে বেশিভাগই বিকৃত ইতিহাস। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এগুলো এদের কাছে আনন্দ-বিনোদনের জন্য শুধুমাত্র ছুটির দিন ছাড়া আর কিছু নয়। এমতাবস্থায় নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান সম্পর্কে এদেরকে অবহিত করতে অভিভাবক, শিক্ষক ও মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
তথ্য ও ছবি সূত্র:
উইকিপিডিয়া, ফেসবুক
বাংলা ট্রিবিউন, জুন ০৯, ২০১৯
প্রথম আলো, ২৯-১২-২০১০
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১৯ রাত ২:২৫