পাকিস্তানের আকিব জাভেদ কে চিনেন তো ? ক্যারীবীয়ানের বিশাল দৈত্যকায় ইয়ান বিশপ কে খেলার মাঠে মাইক্রোফোন হাতে প্রায় দেখেন নিশ্চয় । এই বিশপ আর আকিবের মধ্যে একটা দুঃখজনক মিল রয়েছে, জানেন তো ? এমনিতে দুজনার অনেক মিল । দুজনই দুরন্ত গতির ফাষ্ট বোলার । সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত প্রতিভায় ভরপুর ছিলেন দুজনই । নিজ নিজ দলের পেস-আক্রমণ কে শাণিত ও সমৃদ্ধ করেছিলেন, নিজেদের যোগ্যতাবলেই । কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো কি জানেন, দুজনের ক্যারিয়ারেই রয়েছে একরাশ হতাশা ও না-পাওয়ার গভীর হাহাকার !
এই হাহাকার-আক্ষেপের জন্য, নিজের হতভাগ্য কপাল ছাড়া আর কাউকেই দোষ দেয়ার সুযোগ নেই তাদের । কারণ, তাঁরা ভূল সময়ে ভূল দলে জন্ম নিয়েছিলেন । আকিব জন্মেছিলেন, ওয়াসিম-ওয়াকারদের আমলে । আর বিশপ জন্মেছিলেন ওয়ালশ-এমব্রোসদের আমলে । তাই ব্যাটসম্যান ভড়কে দেয়া গতি, চমৎকার লাইন-লেংথ আর ঈর্ষণীয় সুইং থাকার পরও তাদের ক্যারিয়ার ততটা সমৃদ্ধ হয়নি, যতটা হওয়ার কথা ছিল । অবশ্য ইঞ্জুরিও তাদের ক্যারিয়ার কে বাঁধাগ্রস্থ করতে একটা ভূমিকা রেখেছিল ।
সব মিলিয়ে আকিব-বিশপরা তাই ক্রিকেটেরই এক চিরন্তন আক্ষেপের গল্প হয়ে আছেন ।
বাংলাদেশে এই পর্যন্ত তেমন কোন আক্ষেপের গল্প জন্ম নিতে পারেনি । কারণ সেই ধরণের ফাষ্ট বোলারের জন্মই যে হয়নি বাংলাদেশে । এক মাশরাফি তে ভর করেই প্রায় দেড় দশক পাড়ি দিয়েছে এই দেশের ক্রিকেট । সেই মাশরাফিও ইনজুরিতে বিধ্বস্ত হয়ে ফাষ্ট বোলার থেকে হয়ে গেছেন মিডিয়াম পেসার !
মিডিয়াম পেসার অবশ্য বাংলাদেশে ছিল । তবে তাও যে ভুরি ভুরি ছিল ব্যাপারটা তা না । অনেক মিডিয়াম পেসার লেংথ আর সুইংয়ে আশার আলো দেখালেও, জাতীয় দলে থিতু হতে পারেননি । ভরসা দিতে পারেননি । রাসেল, নাজমুল, তারেক, তালহ, বৈশ্য... কত নাম ! কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন তাঁরা, বাংলাদেশ পেস এ্যাটাককে তেমনই দীন-হীন রেখে !
বাংলাদেশ তাই সবসময়ই ভুগেছে পেসার সংকটে । ভালমানের ফাষ্ট বোলারের জন্য হাহাকারটা বহুদিনের, এখানকার ক্রিকেট জনতার !
কিন্তু এখন বোধহয় সময় বদলাচ্ছে দ্রুতই । ‘বাঁহাতি স্পিনারের খনি’ নামে পরিচিতি পাওয়া বাংলাদেশে উঠে আসছে একের পর এক দুর্দান্ত ফাষ্ট বোলার । মুস্তাফিজুর রহমান, আল আমিন হোসাইন, তাসকিন আহমেদ, রুবেল হোসেন, আবু হায়দার রনি, মোহাম্মদ শহীদ । বলের উপর অসাধারণ নিয়ন্ত্রণের সাথে, ন্যাচারাল সুইংয়ে যারা ব্যাটসম্যানদের বিপর্যস্ত করে তুলতে পারেন অনায়াসে ।
একা হাতে ম্যাচ জেতানোর মতো ফাষ্ট বোলার আমাদের ছিল না । একজন ওয়াসিম-ম্যাকগ্রা-ওয়ালশ না হোক, অন্তত জহির খানের মতো মাঝারি মানের বোলারের সার্ভিসও আমরা পাইনি অনেক ম্যাচে । এই পেসার সংকট কতটা যে আমাদের ভুগিয়েছে, তা বোঝাতে চোখ রাখতে পারেন গত দেড় দশকের পরিসংখ্যানে ।
সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে, মূহুর্তেই ম্যাচের রঙ বদলাতে সক্ষম তেমন পেসার মনে হয় আমরা পেয়ে গেছি । বাঁহাতি পেসের নানান বৈচিত্র নিয়ে একজন মুস্তাফিজ এখন আমাদের বোলিং এ্যাটাকে যুক্ত হয়েছেন । গতির সাথে দারুণ লাইন-লেংথ নিয়ে আছেন, তাসকিন । ডেথ-বোলিং বিশেষজ্ঞ আল আমিন দিচ্ছেন স্লগ ওভারের নির্ভরতা । পরিণত রুবেল দিচ্ছেন আরো শাণিত ও ক্ষুরধার বোলিংয়ের নিশ্চয়তা ।
কামরুল ও রনির মতো প্রতিশ্রুতিশীল তরুণেরা আগামী দিনে পেস-শূণ্যতা পূরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ । আর এদের সাথে যোগ করুন ‘ক্যাপ্টেন কিং’ মাশরাফি কে । মাশরাফির সরাসরি তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠা এই তরুণেরা, বাংলাদেশ ক্রিকেটের আগামী দিনটাকে গতি-বাউন্স আর স্লোয়ার-সুইংয়ে ভরিয়ে দেবে না, তা কে বলতে পারে !
হ্যাঁ, মুস্তাফিজ, তাসকিন, রনিদের মতো সদ্য কৈশোর পেরোনো তরুণগুলো স্বপ্ন দেখাচ্ছে দারুণ একটা পেস ইউনিটের । ‘ফ্যান্টাস্টিক ফোর’ কিংবা ‘ত্রাসের ত্রয়ী’ হয়ে ব্যাটসম্যান নাচানোর মতো পেসার যেন মজুদ এখানে । এই তরুণ তুর্কীদের সাথে রুবেল-আল আমিনদের যোগ করুন । চমৎকার একটা বোলিং ইউনিট দাঁড়িয়ে যাচ্ছে না ?
এদের ব্যাক আপ হিসেবে কামরুল ইসলাম, শফিউল ইসলাম, রবিউল হোসাইন, মোহাম্মদ শহীদ, আবুল হাসানদের মতো বোলাররা আছেন, এদের নির্ভার রাখতে । এঁরা নিজেরাও নিজেদের পরীশীলিত করছেন, নিজেদের আরো শাণিত করছেন । এবার বলুন তো, বাংলাদেশের পেস-আক্রমণের সাইড বেঞ্চটাও কেমন দুর্দান্ত হয়ে উঠছে না !
এদের সাথে সুখে-দুখে, সুসময়-দুঃসময়ে মাথার উপর ছাতা হয়ে আছেন ‘ক্যাপ্টেন কিং’ মাশরাফি । যিনি যে কোন পরিস্থিতিতে বড় ভাইয়ের মতো আগলে রাখতে সিদ্ধহস্ত । নির্দেশনা দিতে আছেন তাদের বোলিং গুরু, হিথ স্ট্রীক । কি সৌভাগ্য দেখুন ছোট ছোট ছেলেগুলোর !
বয়স ভিত্তিক দলগুলো থেকে উঠে আসছে আরো কত তরুণ তুর্কী । মুস্তাফিজ-রুবেলে উদ্বুদ্ধ হয়ে, ফাষ্ট বোলিংকেই লক্ষ্য ঠিক করছে কত কিশোর-প্রাণ ! ‘বাঁহাতি স্পিনারের খনি’ বাংলাদেশ তাই ‘অদম্য পেসারের উৎপত্তিস্থল’ হতে পারে, অচিরেই ।
আজ থেকে বছর পনের পরে তাই আকিব-বিশপের মতো কোন বাংলাদেশী পেসারের আক্ষেপের গল্প লিখতে গিয়ে কিছুটা হতাশা গ্রাস করলেও, তাতে যে কিছু পুলক লুকিয়ে থাকবে না, তা কে বলতে পারে !
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:০১