লিখতে বসে মনে হচ্ছে, যারা অকপটে নিজের কথাটা বইয়ের পাতায়, ইন্টারনেটের পেইজে জানিয়ে দেয় তারাই কলম-কীবোর্ডের লেখক। যা পড়ে আর দশজন নিজেকে খুঁজে পায়, হয়তো পায় না। অফিস শেষে গতকাল রাতে কলিগের রুমে বসে আড্ডা দিতে-দিতে টিভি'র পর্দায় চোখ পড়লো - 'কেয়া কাহা তুমনে? - ফিরসে কাহো। কাহতে রাহো.. বার বার কাহতে রাহো..' তারপরই বেজে উঠলো সেই গানটা - কাহো না পেয়ার হে .. আজ সকালে অফিসে বসে ডাউনলোড করলাম 'কাহো না পেয়ার হে'মুভিটা। বাসায় এসেও বার-বার শুনছি গানটা। শুনলেই শান্তি - 'একবার কেহ দো, কাহো কি মুজচে পেয়ার হে। কাহো..'
আমি রাজ নই, তাই সোনিয়া হয়ে কেউ 'ভালোবাসি' এমন শব্দটাও ব্যয় করলো না। সেই ফটোগ্রাফ, একটা ফটো - যা দেখতে-দেখতে প্রেমে পড়লাম। তখন ক্লাস টেনে পড়ি। মাঝে-মাঝে আমাদের ক্লাসে ছিপছিপে সুন্দর, দীঘল চুলের একজন আপু ক্লাস করতে আসতেন। সে সময়ে ক্লাস টেনে পড়ুয়া একটা ছেলের একেবারে চোখে লেগে থাকার মতো বলতে যা বুঝায় - সালমা আপু ঠিক তাই ছিলেন। হয়তো বয়সে বড় হওয়ার জন্যই উনাকে এতো ভালো লাগতো। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম - উনার বাসা আমাদের পাশের গ্রাম 'সিঙ্গাচো'। সে গ্রামে ইব্রাহীম নামে আমার এক বন্ধুও আছে (নিছের ক্লাসে পড়লেও বয়সে যে আমাদের সমান ছিল)। ইব্রাহীমের মাধ্যমে একদিন সালমা আপু'র মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করলাম। দুঃখের বিষয় হল - তখনও পর্যন্ত আমার হাতে কোন মোবাইল ফোন ছিলো না।
আমাদের ক্লাসের জাহিদ খুব স্মার্ট, আউটলোক কিংবা লাইফ-স্টাইল সব জায়গায়। ও চুরি করে হোস্টেলে মোবাইল ব্যাবহার করতো। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর, ও মেয়েদের নাম্বার ডায়াল করে কথা বলতো।একদিন জাহিদকে বলে-কয়ে রাজী করালাম যে - ওর নাম্বার দিয়ে রোজ না হউক অন্তত সপ্তাহে দু'-একবার সালমা আপুর নাম্বারে ডায়াল করবো। ঠিক কি কারণে জানি না, মাঝে-মাঝে রাতে যখন সাল্মা আপু'র নাম্বারে ডায়াল করতাম তখন এপ্রান্ত থেকে কিছুই বলতাম না। উনি কিছুক্ষণ 'হ্যালো.. হ্যালো' করে লাইন কেটে দিতেন। গভীর রাতে উনাকে যে কয়বার ইথারে স্মরণ করেছিলাম, তার প্রায় বেশীরভাগ সময়ই উনার বাসার টেপ-রেকর্ডারে মৃদু স্বরে বাজতে শুনেছি - কাহো না পেয়ার হে, কাহো না পেয়ার হে ...একদিন ইব্রাহীমের সাথে করে সালমা আপু'র বাসা থেকেও ঘুরে এলাম। পাটি-শাপটা পিঠা আর পেয়ারা খেতে দিয়েছিল আমাদের। আফসোস উনি তখনও জানতেন না, একটা আনাড়ি ফটো থেকে চৌদ্দ-পনের বৎসরের একজন কিশোর কতটা গভীর প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে পারে।
'সালমা'- কে কেন আপু বলছি? পাঠক আপনাদের জানিয়ে দেই- উনি আমাদের সাথে এস.এস.সি পরীক্ষা দিতে বসবেন, এমন বসা উনি তার আগেও তিন-তিন বার বসেছিলেন। বয়সের ব্যাবধানের জন্যই উনাকে আপু সম্বোধন করতাম মনে-মনে। যদিও উনাকে বেশ কয়েকবার সামনা-সামনি দেখলেও মুখে কিছুই বলা হয় নাই, একটা শব্দও না। ধীরে-ধীরে ইব্রাহীমের কাছ থেকে শুনলাম - দুবাই প্রবাসী একজনের সাথে সালমা আপু'র গভীর প্রনয় চলছে। দেহ-মন সবই নাকি খোয়া গেছে। একরাতে গ্রামের কোথাও মাইকে - 'কাহো না পেয়ার হে' বাজতে শুনে অস্থির হয়ে স্কুলের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছিলাম। জাহিদ এসে বললো - 'নে দোস্ত, ফোন দে..', দিবো ? .. হ্যাঁ, দে। 'আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, অনুগ্রহপূর্বক আবার ডায়াল করুন।' আবার ডায়াল করলাম, আবার, তারপর আবার !
সালমা আপু'র আজ ঘর-সংসার হয়েছে, বাচ্চাও। তবে যার জন্য দেহ-মন উজার করে দিয়েছিল তার সাথে নয়, অন্য কারো সাথে। আজও কোথাও-কোথাও বাজতে শুনি- কাহো না পেয়ার হে------- বুকের ব্যাথাটা বেড়ে উঠে, এই জন্মে এই গান, এই মুখ ভুলবার নয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৩:২১