somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভিনদেশে বৃদ্ধাশ্রমেঃ ছবিসহ

১৪ ই মার্চ, ২০১৪ বিকাল ৪:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সারি সারি দামি গাড়ি, অনেক কিছুই বোঝায়!

বয়সের ভারে মুখগুলো হয়ে পড়েছে বৈশাখী জমির মতন রুক্ষ। দৃষ্টির সীমানা অত্যন্ত সীমিত, ভুল না হয়ে থাকলে চার দেয়ালে বন্দী। হাত-পা খুব একটা নড়ে না। শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে থাকা। কিছুক্ষণ বাদে বাদে দু’একটে বুলি আওড়ানো! প্রায় সবাই সত্তর ঊর্ধ্ব! কেউ কেউ আশি কোটায়। তাদের মাঝে মিলের চেয়ে অমিলই ঢের বেশি। কিন্তু তারপরেও জীবনের কঠিন বাস্তবতা আজ তাদের এক করে রেখেছে। তারা আজ সবাই একই রকম। তাদের জীবনও বলতে গেলে একই।



এমনিতে আমার সবচে’ বেশি ঘৃণার জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম। এ শব্দটি শুনলেই আমার গায়ে ক্যান জানি কাঁটা দিয়ে উঠে। এর জন্য অবশ্য নচিকেতা দায়ী। যখন বৃদ্ধাশ্রম জিনিসটা কী বুঝতাম না, বোঝার বয়সে পড়ি নি, তখন তার ঐ গানটি শুনে আমার অনুভূতি অসাড় হবার মত ছিল। আমি ঐ বয়সে ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারতাম না যে, পৃথিবী এত নিষ্ঠুর হতে পারে। যৌথ পরিবারে জন্ম নিয়েছিলাম বলেই হয়তো, হয়তো আমাদের সমাজে বৃদ্ধদের প্রতি আলাদা যত্নআত্তি আর খাতিরদারির কারণে।



শীত এখনো সেই অর্থে বিদায় নেয় নি। তাই এই ঠাণ্ডার মধ্যে সাতসকালে উঠা বিরক্তিকর। তার উপর সাপ্তাহিক ছুটির দিন হলে কথাই নেই। কম্বলের পরশই তখন পৃথিবীর সবচে আরামপ্রদ বস্তু। তারপরেও কোনোদিন যায় নি বলে উঠা। আঁটটার দিকে রওনা দিলাম। শুরুতে একটা বাসে করে সামান্য, তারপর বাস বদলে গন্তব্যে। অনেকটা নাগরিক আর প্রকৃতির মিশেলে গড়ে উঠা, নদীর কূল ধরে এগিয়ে চলা। পাহার-রাস্তা-নদী এ তিনটে যখন একসাথে থাকে তখন যাত্রা হয়ে উঠে মুগ্ধকর। তখন ক্লান্তি বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। ভেবেছিলাম গ্রামের দিকেই যাচ্ছি কিন্তু একটি শহর পেরিয়ে তখন আরেকটি শহরে আমরা। গন্তব্যে পৌঁছলাম ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই।



শুরুতেই গেইটে অনেক বড় একটা ছবি লাগানো। কিছু বৃদ্ধের হাসিমাখা ছবি। দুটা আলাদা আলাদা দুতলা বিল্ডিং। সামনে বাস্কেটবল কোর্ট আর ঘাসের মাঠ। হয়তো মালিক রসিকতাচ্ছলেই বাস্কেটবল কোর্টটি বানিয়েছে। না হয় যে বয়সীরা এখানে আছে তাদের বাস্কেটবল খেলা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যই হবে। ঘাসের মাঠে ব্যায়ামের কিছু সরঞ্জামাদি। কিছু ছোট ছোট বসার জায়গা। এখানে তারা রোদ পোহায়। তবে বছরের অধিকাংশ সময় জায়গাগুলো অলসই পড়ে থাকে। ঠাণ্ডার মধ্যে এদের বের হবার কোনও অর্থই নেই। শুরুতে দেখি কয়েকজন রোদ পোহাচ্ছে, কয়েকজন সিগারেটে ধোঁয়ায় নিজের দুঃখগুলোকেই হয়তো জ্বালিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে হয়তো।



আমরা কুড়ি জনের দল দুভাগ হয়ে দুদিকে গেলাম। আমার দল শুরুতে যে বিল্ডিঙে যায় তা বলতে গেলে খুব সুন্দর। রুম গুলো একদম ঘুচানো, পরিপাটি। বেল্কনি সাথে এটাস্ট বাথ। টিভি দেখলাম, কিছু পত্রিকা আর বইও। কয়েকটা রুমে ঢুকতে চেয়ে অনুমতি মেলেনি। তাঁরা নির্জন আর একাকী থাকতে থাকতে হয়তো মানুষজন দেখলে কেমন কেমন লাগে, ভয় হয়। তাদের তো নিজের ছায়াকেও অসহ্য লাগার কথা। তারপর একটি রুমে প্রবেশের অনুমতি মেলে। তাঁর বয়স ৭৯, তিন বছর হল এখানের বাসিন্দা। কিছু খুনসুটি করা হল, ছবি তুলতে চাইলে শুরুতে না করেন- কিন্তু একটি মিনতি করে বলতেই সহাস্যে ছবি তুলতে দিলেন। তখন পূর্ব দিকের বেল্কনি দিয়ে বসন্তের নির্মল আলো ঠিকরে পড়ে এক্কেবারে তাঁর হাসির সাথে মিশে গেছে। হয়তোবা তিনি অনেকদিন এমন মন খুলে, হৃদয় উজাড় করে দিয়ে হাসেন নি বলে। এখানে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই হাসি উবে যায়, তারপরেও অনেক কষ্ট করে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করেন, মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেন। মাঝে মাঝে কিছু হ্যাঁ না-র চেয়েও অনেক বেশি না বোধক। আসার আগে তাঁকে একটি গান শোনাই, কোরাসে। তারপর তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি। আরেকটি রুমে ঢুকতে চাইলে তিনি দরোজা আটকিয়ে দেন। ঐ বিল্ডিঙে আর কারো সাথে তেমন কথা হয় নি। এরপর বাইরে বেরিয়ে আসি। এই বিল্ডিঙটা অনেকটা বেশি গরিব গরিব। পুরনো হয়ে গেছে অনেক বেশি, এখানকার বাসিন্দাদের মতই। যাদের সন্তানেরা একটু গরিব কিংবা কৃপণ স্বভাবের তাদের আশ্রয় এখানেই। এখানে একজনের সাথে সাথে কথা বলতে গেলে তিনি শুধু হা করে তাকিয়ে থাকেন। খানিক বাদেই বইয়ে তাঁর দৃষ্টি নিবন্ধ, হয়তো তিনি শোনেন না বলে আমাকে জবাব দেয়ার ইচ্ছা থাকলেও দিতে পারছেন না। ঘুরে ঘুরে আরও কয়েকজনের সাথে কথা হল। একজন দেখলাম অনেকগুলো সিগারেট খাচ্ছেন। কেন খাচ্ছেন জিজ্ঞেস করতেই বলে উঠেন, এসব ছাড়া চলে না। হয়তো এই সিগারেটই তাঁর নিঃসঙ্গতায় সঙ্গী। শরীরের জন্য ক্ষতিকর বলতেই হেসে দেন। আমার আর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে নি। বেলা মধ্যগগণ তখন, আমরা কিছু জীবনের সায়াহ্ন বেলার মানুষকে বিদায় দিয়ে আসছি। জীবন থেকে ছুটি নিতেও তো তাদের খুব বেশি দেরি নেয়।



ঐখানে যাদের সাথে দেখা হয়েছিল সবার কাছ থেকেই একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছিল বারংবার। তাঁরা কেন এখানে। তাদের তো ছেলেমেয়ে আর নাতিপুতিদের সাথে খুনসুটি করে সময় কাটানোর কথা। যে ছেলেমেয়ের জন্য তাঁরা তাঁদের যৌবন কাটিয়ে দিয়েছেন, নিজের জীবনের সবকিছু ব্যয় করেছেন। কিন্তু ঐ প্রশ্ন করে তাঁদের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়ার সাহস আমার হয় নি।



যেতে যেতে একটি ছোট্ট গল্প। বৃদ্ধ বাবা, দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে যেতে বসেছে। সামনে কয়েকটা কাক বসে আছে। ছেলের থেকে জিজ্ঞেস করছেন, ঐগুলো কী বসে আছে। ছেলে উত্তর দেয়, কাক। বাবা কানেও খুব একটা শোনেন না। তাই আবারো একই প্রশ্ন করলো। ছেলে এবার একটু উত্তেজিত হয়ে উত্তর দেয়, কাক! বাবা আবারো একই প্রশ্ন করে। এবার ছেলে রেগেমেগে একাকার। কয়বার বলতে হয়, শুনতে পাচ্ছো না? তখন বাবা তাঁর দুচোখের অশ্রু গড়িয়ে বলতে থাকেন- তুই তখন একাবারে ছোট। একটু একটু এটা ওটা চিনতে শিখেছিস। আমার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করছিলি, বাবা- ওটা কী। আমি বলেছিলাম, কাক। তারপর তুই আবারো জিজ্ঞেস করলি। আমি আবারো বললাম কাক। এভাবে তুই যতবার জিজ্ঞেস করেছিলি আমি তত খুশি হয়েই তোর প্রশ্নের উত্তর করেছিলাম।





আমাদের সমাজের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ভালো থাকুন। সবার মা-বাবা ভালো থাকুন। আমাদের মূল্যবোধগুলো জেগে থাকুক, বেঁচে থাকুক। তাঁরা যেন কখনো আমাদের কাছে বোঝা হয়ে না যান!


১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×