তিন বন্ধু মিলে সেদিন মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ দেখতে গেলাম। সেখানে গিয়ে আরেক বন্ধুর সাথে দেখা। চারজন মিলে দেখলাম ফারুকীর নতুন সিনেমা যা ইতোমধ্যে সব রকমের মিডিয়াতেই যথেষ্ট আলোচিত হয়েছে।
সিনেমা দেখার পর প্রতিক্রিয়াঃ
আমি- ভালো লাগলো না তো !
বন্ধু১ – ন্যার্যাটিভ ভাল ছিল।
বন্ধু২ – মডার্নিজম, পোস্ট মডানির্জম এসব ব্যাপার আসেনি।
বন্ধু৩ – টাইমিং ~ কতক্ষন ক্যামেরাটা ধরে রাখতে হয় ফারুকী তা জানে।
বন্ধু ৪ – সস্তা। (ওর সাথে দেখা হয়েছে সিনেমা দেখার কয়েকদিন পর)
বন্ধু ৪ এর বন্ধু – এক্সপেরিমেন্টাল।
আমার বারবার মনে হচ্ছিলো ‘টেলিভিশিন’ এর চেয়ে ভাল হয়েছিল। পরিচালক হিসেবে ওটাই ফারুকীর সেরা কাজ। বুসানে ‘টেলিভিশিন’ যতটা সাড়া ফেলেছিল, ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ ততটা পারেনি। ক্লাসে জিজ্ঞেস করলাম মুভিটা কেউ দেখেছে কিনা, দু’জন হাত তুলল – দু’টিই মেয়ে। একটু অবাক হলাম, ছেলেরা কি আজকাল ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস ছাড়া কিছু দেখেনা! ওদেরকে বললাম দশে সিনেমাটাকে কত দেবে? একজন ৬, আরেকজন ৭। দু’জনেই বলল ‘টেলিভিশিন’ ওদের বেশি ভালো লেগেছিলো। তাহলে ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ এত ব্যবসা করছে কেন? প্রচারণা। এই একটি জায়গায় এটা যোজন যোজন এগিয়ে।
সিনেমার কাহিনী আমাদের জীবন থেকে নেয়া ~ কয়েকজনের জীবনের গল্পকে একজনের গল্পে সাজানো হয়েছে। একটু সুড়সুড়ি আছে এবং সেটা বেশ কিছু দর্শক টানার জন্য যথেষ্ট। ডায়লগ প্রথাগত ফারুকী স্টাইল – সত্যজিত, ঋত্বিকের আভিজাত্য সেখানে নেই। তা থাকতেই হবে এমন কোন কথা নেই। কিন্তু স্ক্রীপ্ট এবং ডায়লগ বরাবরের মতো এখনো ফারুকীর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ~ বড় পরিচালক হবার পথে প্রধান অন্তরায়।
সবাই মিঠুর অভিনয় নিয়ে অনেক কথা বলছে। মিঠু কি ভালো অভিনয় করেছে? গল্পটা লেখাই হয়েছে এমনভাবে যাতে মিঠুকে কোন অভিনয় করতে না হয়! প্রশংসা যদি কিছু জুটে, সেটা ফারুকীর প্রাপ্য। এই মানের অভিনয় নিয়ে মিঠু বেশিদূর যেতে পারবেনা। শীনা চৌহান বরঞ্চ ভাল অভিনয় করেছে। যদিও কিছু কিছু দৃশ্যে আরো ভালো হতে পারতো – সে দোষ পরিচালকের ঘাড়ে বর্তায়। ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ –র দর্শকপ্রিয়তার একটা বড় কারণ এই ভারতীয় মডেল ও নায়িকা। শীনার আকর্ষনীয়তাকে ফারুকী বেশ ভালোভাবে ব্যবহার করেছেন। সিনেমার দ্বিতীয়ার্ধে একটা বড় অংশ জুড়ে শীনা পর্দায় ছিলোনা এবং সিনেমাটা তখন প্রথমার্ধের চেয়ে খারাপ লেগেছে। এখানে আরেকটা কথা না বললেই নয়, শীনার কন্ঠ হিসেবে অপি করিম অসাধারণ পারফর্ম করেছে। আমরা আশা করবো অপি আবার নিয়মিত হবে।
ফারুকীর ব্লকিং, শট কম্পোজিশন যথেষ্ট উঁচু মানের, অনেক বিখ্যাত পরিচালকের কথা মনে করিয়ে দেয়। মুখোশ, নারী পুতুল এসব মেটাফর ফারুকী আগেও ব্যবহার করেছে। এই পুনরাবৃত্তি ইচ্ছাকৃত (অনেক পরিচালকই এটা করে থাকেন)। দু'একটা দৃশ্য ছাড়া ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের উপস্থিতি সেভাবে অনুভূত হয়নি। সিনেমার শেষ নিয়ে সবাই কথা বলছে। কোরিয়ান মুভি ওল্ডবয়ের শেষ শটটার কথা মনে আছে? মিল খুঁজে পাচ্ছেন? সিঁড়ির সিকোয়েন্সটা ভালো হয়েছে। কিভাবে করা হয়েছে কৌতূহল সবার। বিদেশী মুভিতে এটা বহুল ব্যবহ্রত টেকনিক। বাংলাদেশে কি এই প্রথম হলো! যারা বলছেন এটা এক্সপেরিমেন্টাল মুভি, তাদের এখনো চোখ ফুটেনি। নাচ-গানওয়ালা বানিজ্যিক সিনেমা ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ নয়, কিন্তু এটা একটা মোটামুটি মানের ‘আর্ট ফিল্ম’ও নয়। এটা একটা কমেডি-ড্রামা। কমেডি হওয়াটা সিনেমার অপরাধ নয়। সমস্যা হলো, এটা চরিত্রের/ঘটনার গভীরে পৌঁছানোর তেমন চেষ্টা করেনি। সব কিছুই সুপারফিশিয়াল। না হয়েছে ভালো কমেডি, না হয়েছে ভালো ড্রামা। মূল দুই চরিত্র ছাড়া বাকীদের কাজের সুযোগই নেই। এই রকমের মুভি বানাতে থাকলে বাংলাদেশের সিনেমা কি খুব বেশি এগুবে?
আরেকটা জিনিস চোখে লাগে - নিজের সিনেমাকে ফারুকীর ব্যাখ্যা (ইন্টারপ্রিট) করা। এটা পরিচালকের কাজ নয়, সমালোচক বা দর্শকের কাজ। পরিচালকের মেসেজ (পিপীলিকার পাখা গজানো ভালো নয়, এসব থেকে দূরে থাকা উচিত ইত্যাদি) যদি দর্শক সিনেমা দেখে না বুঝে তবে পরিচালক ব্যর্থ হয়েছেন। টিভিতে বা পত্রিকায় পরিচালকের মন্তব্য পড়ে যদি মেসেজ বুঝতে হয় তবে সেটা প্যাথেটিক। ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ -র উইকিতে গিয়ে দেখলাম সিনপসিসের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন বড় একটা স্টেটমেন্ট পরিচালক ফারুকীর দেয়া আছে!!
ফারুকীর সবচেয়ে বড় অবদান বোধ হয় এ ধরনের মুভির দর্শক তৈরিতে। কিন্তু এরাই কি আমাদের আকাঙ্খিত দর্শকশ্রেনী? বার্গম্যান বা বুনুয়েলের মত কাউকে গ্রহণ করার জন্য এদেশের দর্শক কি তৈরি? সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে এটাই আমাকে ভাবাচ্ছিল। ভালো ছবির দর্শক এখনো নেই, তৈরি করতে হবে। তেমন প্রযোজক, পরিবেশক আর পরিচালক কই?
ফারুকী auteur (অমিতাভ রেজা যেমনটা বলেছেন) এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু auteur হওয়াটাই বড় কথা নয়। হিচকক, ওয়েলস, হক্স এরাও auteur আবার এড উড বা আমাদের হাল আমলের জাকির হুসেন রাজুও সংজ্ঞামতে auteur। ফারুকী এই স্কেলে কোথায় থাকবে সেটা তাকেই ঠিক করতে হবে এবং সময়ই তা আমাদের জানান দেবে। তবে এবার মনে হয় সে বড় কিছু করতে যাচ্ছে ~ নো ল্যান্ড’স ম্যান – চারটি ভিন্ন মহাদেশে চিত্রায়িত হবে। বাজেটও বেশি। সুতরাং অপেক্ষার পালা, এই আশায় যে ফারুকী এবার বলার মতো ভালো কিছু উপহার দেবে এবং অনুপ্রানিত করবে অনেককে।
*** একজন আমাকে জানাল কোরিয়ান মুভি হ্যান্ডফোন (২০০৯) এর সাথে ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ -র মিল আছে। আমি হ্যান্ডফোন দেখিনি। উইকিতে কাহিনী পড়লাম। ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ -র গল্পের অনেকটার (এক অভিনেত্রীর সেক্স ভিডিও ও ফোন হারিয়ে যাওয়া এবং তা ফিরে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করা) সাথে হ্যান্ডফোনের কাহিনী মিলে যায়। মুভিটা দেখলে বুঝা যেত আসলেই তার প্রভাব কতটা আছে বা আদৌ আছে কিনা।
হ্যান্ডফোন (২০০৯)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:৩৮