somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন রফিকুল ও একটি পাঠাগার ও আমাদের করণীয়

১৩ ই অক্টোবর, ২০১২ সকাল ১১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘শুধু নিজে বই পড়লে চলবে না। বই পড়ার আন্দোলন গ্রামের সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।’
কৃষক হাবিবের মুখে এ কথা শুনে অবাক হলেন রফিকুল ইসলাম। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে। কথাটি দিনের পর দিন ঘুরপাক খেতে থাকে রফিকুলের মাথায়। ঠিক করলেন, একটি পাঠাগার গড়ে তুলতেই হবে।
এভাবেই শুরু। রংপুরের পায়রাবন্দ ইউনিয়নের খোর্দ মুরাদপুর গ্রামের রফিকুল ইসলাম পাঠাগার গড়েছেন। নাম দিয়েছেন ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগার’। দুই দশকের বেশি সময় ধরে রফিকুলের অক্লান্ত পরিশ্রম আর উদ্যোগে এ পাঠাগারের নিবন্ধিত পাঠক এখন তিন হাজারের বেশি।
পাঠাগার গড়ে রফিকুল ছড়িয়ে দিয়েছেন বই পড়ার আন্দোলন। তাঁর পাঠাগার ঘুরে দেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দেশ-বিদেশের কবি-সাহিত্যিক লেখক-গবেষকসহ কত না সুধীজন।
শুরুর কথা: রফিকুল ইসলামের বয়স এখন ৪৮। ছোটবেলা থেকে বই পড়তে ভালোবাসেন। পড়তে পড়তে নিজের কাছে জমে যায় অনেক বই।
১৯৮৫ সালে গ্রামের কৃষক হাবিবের সেই কথার পর পরিকল্পনা করতে থাকেন পাঠাগার গড়ার। নিজের আড়াই শ বই নিয়ে বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করেন সবার জন্য উন্মুক্ত পাঠাগার। শুরুতে নিবন্ধিত পাঠক ছিল মাত্র ১১ জন। নতুন পাঠক সৃষ্টির জন্য প্রথম দিকে ভ্যানে করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হতো বই। ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষের বই পড়ার আগ্রহ বাড়তে থাকে। এখন আর বই বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া লাগে না। সকাল ১০টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত পাঠাগার খোলা থাকে। দৈনিক গড়ে ৬০ থেকে ৮০ জন পাঠক পাঠাগারে এসে বই পড়ে।
এসএসসি পাসের পর দৃষ্টিশক্তির সমস্যায় আর প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা করতে পারেননি রফিকুল। পারিবারিক কিছু কৃষিজমি আছে, তার ফসলেই চলে সংসার। স্ত্রী সেগুলো দেখাশোনা করেন। তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। আর ছোট ছেলে উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। মেয়েটির বিয়ে দিয়েছেন।
সরেজমিনে এক দিন: বাঙালি নারীশিক্ষার অগ্রপথিক মহীয়সী বেগম রোকেয়ার বসতভিটা পায়রাবন্দের খোর্দ মুরাদপুর গ্রামে। বসতভিটার শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে ঘেরা দিয়ে রাখা হয়েছে। ঠিক এর পাশেই রফিকুলের রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগার। ৩০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০ ফুট প্রস্থের একটি দোচালা ঘর। মাঝখানে একটি টেবিল। চারদিকে বইয়ের তাক। টেবিলে একসঙ্গে বসতে পারে ২৫ জনের বেশি পাঠক।
পাঠাগারে একান্ত মনোনিবেশ করে বই পড়ছিল অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী কাকলি বেগম। সে বলে, ‘বই পড়লে অনেক অজানা কথা জানা যায়। তাই পাঠাগারে এসে ভালোই লাগে।’
স্নাতকের শিক্ষার্থী নিপা আক্তার বলেন, ‘এখানে নিয়মিত বই পড়ায় আমার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনাতেও অনেক উপকার হয়েছে।’
গ্রামবাসীর কথা: মুক্তিযোদ্ধা বেলায়েত হোসেন কৃষিকাজ করেও পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক। তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি কোলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী বইটি পড়ছেন।
মোফাজ্জল হোসেনও কৃষিকাজ করেন। তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে গ্রামের পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক। মেয়ে আক্তারী বেগম ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে শিক্ষকতা করছেন একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আক্তারী বললেন, ‘পাঠাগারে বই পড়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি। গ্রামের মধ্যে এমন একটি পাঠাগার থাকায় দেশ-বিদেশের অনেক ভালো বই বিনা পয়সায় পড়ার সুযোগ পেয়েছি।’
মাটি কাটার শ্রমিকের কাজ করেও লাইলি বেগম বই পড়তে ভোলেন না। পাঠাগার থেকে নিয়মিত বই নিয়ে পড়েন। জানালেন, জাফর ইকবাল, হুমায়ূন আহমেদ ও আনিসুল হকের বই পড়তে তাঁর ভালো লাগে।
পায়রাবন্দ ছালেকিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন নূরুল ইসলাম (৫০)। তিনি বললেন, ‘এই পাঠাগারে আমি বই পড়েছি। এখন আমার দুই ছেলেমেয়েও নিয়মিত বই নিয়ে এসে পড়ে।’
কত না বিশিষ্টজন: ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন বেগম রোকেয়া স্মৃতি কমপ্লেক্স উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই দিন তিনি রফিকুলের রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগার পরিদর্শন করেন। এ ছাড়া অনেক বিশিষ্টজন এসেছেন এই পাঠাগারে। তাঁদের মধ্যে আছেন: ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আবদুল মতিন, মতিয়া চৌধুরী, মনসুর মুসা, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, সৈয়দ শামসুল হক, মুনতাসীর মামুন, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, সেলিনা হোসেন, সৈয়দ আবুল মকসুদ, মামুনুর রশীদ, কবরী সারোয়ার, কামাল লোহানী প্রমুখ।
মন্তব্যের ডায়েরি থেকে: পাঠাগার পরিদর্শনে আসা সুধীজনেরা লিখে গেছেন তাঁদের অনুভূতির কথা। মন্তব্য বইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘বেগম রোকেয়ার স্মৃতি ধরে রাখার যে প্রয়াস নেওয়া হয়েছে, তার জন্য উদ্যোক্তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ।’ নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস লিখেছেন, ‘বেগম রোকেয়া যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।’
মতিয়া চৌধুরী লিখেছেন, ‘আলো দিয়ে আলো জ্বালানোর যে ব্রত বেগম রোকেয়া করেছিলেন, আজও তা অম্লান।’ সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন, ‘রোকেয়ার আদর্শকেন্দ্রিক এই পাঠাগারটি দ্রুত আরও বিকশিত হোক।’
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কথা: প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাঠাগারটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন যথাক্রমে রাজু আহমেদ ও রফিকুল ইসলাম।
রাজু আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রফিকুল পাঠাগারটি গড়ে তুলতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। বর্তমানে পরিচালনা করতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৮০ জন পাঠক বই পড়ছে। রেখা বেগম নামের এক নারী পাঠাগারটি সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করেন। তাঁকে দেওয়া হয় মাত্র ৬০০ টাকা।’
রফিকুল বলেন, ‘একসময় মানুষ বই পড়তে চাইত না। এ জন্য ভ্যানে করে বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসা হতো। এখন পাঠকেরা পাঠাগারে এসে বই পড়ছেন। এটাই আমাদের সাফল্য।’ তিনি জানান, অর্থের অভাবে পাঠাগারটি চালাতে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। দৈনিক পত্রিকা রাখাও সম্ভব হয়ে উঠছে না।
জনপ্রতিনিধির কথা: পায়রাবন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘সেই কবে থেকে দেখে আসছি, মানুষকে বই পড়ে উৎসাহিত করতে রফিকুল অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। কত বাধা-বিপত্তি এসেছে। কিন্তু তিনি পিছুটান দেননি।’
আসুন আমরা সবাই রফিকুলের মত জাতিকে আলোকিত করার শপখ নেই। একজন রফিকুল ও একটি পাঠাগার
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১২ দুপুর ১২:২০
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×