জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে এক সন্তানকে গুরুত্ব দেওয়ার অবস্থান থেকে সরে এসেছে সরকার। মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া জনসংখ্যানীতিতে এ সম্পর্কে কোনো কথা নেই। খসড়া নীতিতে এক সন্তানের দম্পতিকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নীতিতে জনসংখ্যাকে উন্নয়নের বিষয় হিসেবে দেখা হয়েছে। জনসংখ্যা কমানোর জন্য সরকার কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চায় না। এক সন্তানকে গুরুত্ব দেওয়ার মধ্যে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভা ‘বাংলাদেশ জনসংখ্যানীতি ২০১২’ অনুমোদন করে। এটাই এখন বাংলাদেশের জনসংখ্যানীতি হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে এবং তা বাস্তবায়ন করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক এ-সংক্রান্ত বিলটি তুলবেন।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে জনসংখ্যানীতি যুগোপযোগী করার কথা বলা হয়েছিল। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালের ২৮ জানুয়ারি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সভাপতি করে ২০০৪ সালের জনসংখ্যানীতি যুগোপযোগী করতে ১৭ সদস্যের কমিটি করে। এরপর সাত সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি একটি খসড়া তৈরি করে। জনসংখ্যানীতি বাস্তবায়নের কৌশল হিসেবে খসড়ায় বলা ছিল, ‘পরিকল্পিত পরিবার গ্রহণের জন্য এক সন্তানের দম্পতিকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদানের ব্যবস্থা করা।’ সূত্র বলছে, চাকরি, পদোন্নতি, বৃত্তি এ রকম আরও অনেক ক্ষেত্রে সুযোগ দিলে মানুষ এক সন্তানের প্রতি বেশি আগ্রহী হবে এই বিবেচনা থেকেই বিষয়টি রাখা হয়েছিল।
খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার কোন পর্যায়ে এসে এক সন্তানের বিষয়টি বাদ পড়েছে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা) রীনা পারভীন বলেন, ২০০৯ সালের পর থেকে খসড়ায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কোন পর্যায়ে এটা বাদ গেছে, তা এখন বলা মুশকিল।
বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম নূর-উন-নবী প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনসংখ্যানীতিতে ওই লাইনটি থাকা উচিত ছিল।’
কেন বাদ পড়ল: খসড়া তৈরির কাজ যখন চলছিল, তখন সরকার জাতীয় জনসংখ্যা পরিষদ পুনর্গঠন করে। এটাই এ বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ পরিষদ। প্রধানমন্ত্রী এই পরিষদের সভাপতি। ২০১০ সালের ২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত পুনর্গঠিত জাতীয় জনসংখ্যা পরিষদের প্রথম সভায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং সম্পদের উত্তরাধিকারের আইনের বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার কথা বলা হয়। সভার কার্যবিবরণীতে তা লেখা আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এক সন্তানের নীতি থেকে সরে আসার মূল কারণ সম্পদের উত্তরাধিকার আইন। একমাত্র সন্তান কন্যা হলে সম্পত্তি অন্যের অধিকারে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করেন অনেকে।
এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ও এনজেন্ডারহেলথের দেশীয় প্রতিনিধি আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, নীতিতে মানুষকে তথ্য দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সন্তানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে মানুষ। সরকার কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চায় না। এই বিবেচনা থেকেই এক সন্তানের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি বাদ পড়েছে।
খসড়া নীতি অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দিয়ে মানুষের মতামত চাওয়া হয়। পাশাপাশি বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগে নীতির ওপর কর্মশালা হয়। এসবের ভিত্তিতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর যাচাইবাছাই করার পর চূড়ান্ত খসড়া মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
উল্লেখযোগ্য দিক: মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হওয়া জনসংখ্যানীতিতে সাতটি অধ্যায়। ভূমিকার পর দ্বিতীয় অধ্যায়ে জনসংখ্যানীতি যুগোপযোগী করার যৌক্তিকতা বর্ণনা করা হয়েছে। পরের অধ্যায়টি একেবারে নতুন, খসড়াতে এটা ছিল না। এটি রূপকল্প। এখানে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সুস্থ, সুখী ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলা।’
জনসংখ্যানীতির উদ্দেশে বলা হয়েছে, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির ব্যবহারের হার ৭২ শতাংশে উন্নীত করে মোট প্রজননহার (টোটাল ফার্টিরিটি রেট-টিএফআর) ২ দশমিক ১-এ কমিয়ে আনা এবং ২০১৫ সালের মধ্যে নিট প্রজননহার ১ (এনএনআর=১) অর্জন করা। নীতিতে বলা হচ্ছে, নির্দিষ্ট সময়ে এই অর্জন সম্ভব হলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২২ কোটিতে দাঁড়াবে এবং ২০৭০ সালে ২৩-২৫ কোটিতে গিয়ে স্থির হবে।
পঞ্চম অধ্যায়ে জনসংখ্যানীতি বাস্তবায়নের জন্য ৭০টির বেশি কৌশলের বর্ণনা করা হয়েছে। এই অংশ থেকে এক সন্তানের দম্পতিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে কৌশল হিসেবে ‘দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’—এ স্লোগান জনপ্রিয় ও প্রতিষ্ঠিত করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতের ভূমিকা এবং শেষ অধ্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বর্ণনা আছে।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য এবং একাধিক আন্তর্জাতিক দলিল ও নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার কথা জনসংখ্যানীতিতে বলা হয়েছে।
২৫ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব: নীতিতে জনসংখ্যা কার্যক্রমে ২৫টি মন্ত্রণালয়ের ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, এতগুলো মন্ত্রণালয় নীতি বাস্তবায়নে কীভাবে ভূমিকা রাখবে, তার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। নীতিতে কাজের সমন্বয় ও সম্পদ বরাদ্দেরও একটা দিকনির্দেশনা থাকা দরকার ছিল। (কপি করা...)