আন্দামান সাগরে চীনা সাবমেরিনের আনাগোনায় প্রবল ক্ষুব্ধ ভারত। চীনকে ধাক্কা দিতে তাই এ বার নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে নয়াদিল্লি। আমেরিকার সঙ্গে সামরিক জোট গড়ার ব্যাপারে আলোচনা শুরু করে দিয়েছে ভারত। দেশের বিভিন্ন নৌঘাঁটির দরজা খুলে দেওয়া হতে পারে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ এবং সাবমেরিনের জন্য। বিনিময়ে ভারত মহাসাগরে নয়াদিল্লির স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে সর্বক্ষণ ভারতীয় নৌসেনার সঙ্গী হবে মার্কিন বাহিনী।
চীন একাধিক বার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। কখনও বলেছে, আমেরিকার সঙ্গে ভারত কোনও সামরিক জোটে গেলে ফল ভাল হবে না। কখনও বলেছে, চীনকে নিজেদের ঘোষিত শত্রু বানিয়ে ফেলার ভুল ভারত নিশ্চয়ই করবে না। ভারত সে সব কথায় গুরুত্ব না দিয়ে মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে ঠিকই। কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে কোনও ঘোষিত সামরিক জোট তৈরি করেনি। ওয়াশিংটন বহু বার নয়াদিল্লিকে জোটে সামিল হওয়ার ডাক দিয়েছে। ভারত মহাসাগরে চিনা আগ্রাসন রুখতে ভারত ও আমেরিকার নৌসেনার এক সঙ্গে কাজ করা খুব জরুরি, এ কথা বার বার ভারতকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন ওবামারা। কিন্তু লাভ হয়নি। আমেরিকার সঙ্গে সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ালেও ভারত জোটে সামিল হয়নি।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন। চীনের হুঁশিয়ারিতে ভারত জোটে যায়নি তা নয়। ভারতের প্রতিরক্ষা নীতি এবং বিদেশ নীতিই অনেকটা সে রকম। আমেরিকা বা রাশিয়া, কারও জোটেই প্রত্যক্ষ ভাবে সামিল হওয়ার বিপক্ষে ভারত। তা ছাড়া, আমেরিকার জোটে সামিল হলে রাশিয়ার সঙ্গে সুদীর্ঘ সুসম্পর্কের পরম্পরাও ধাক্কা খাবে।
এমন নানা কারণে ভারত নিজস্ব নৌঘাঁটিতে মার্কিন নৌবহরকে আশ্রয় দেওয়ার পথে কখনওই হাঁটেনি। কিন্তু পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে চীন যে ভাবে মাঝেমধ্যেই ডুবোজাহাজ পাঠিয়ে দিচ্ছে ভারতীয় জলসীমায়, তাতে নীতি বদলানোর পথে এগোতে শুরু করেছে নয়াদিল্লি।
দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালীর সঙ্কীর্ণ সমুদ্র পথ হয়ে বারত মহাসাগরে ঢোকে চীনা যুদ্ধজাহাজ। ভারতের নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ মালাক্কা প্রণালীর মুখের কাছে অবস্থিত। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, চিন মনে করছে, মালাক্কা প্রণালীর মুখে অবস্থিত নিকোবর ভারতের দখলে থাকায়, চিনের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারত মহাসাগরে চীনের যাতায়াতের পথে ভারত বাধাবিঘ্ন তৈরি করতে পারে। তাই আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জেই আগ্রাসন দেখানোর নীতি নিয়েছে চীন। নৌসেনা সূত্রের খবর, প্রতি তিন মাসে অন্তত চার বার সমুদ্রের গভীরে লুকিয়ে চীনা সাবমেরিন হানা দিচ্ছে ভারতীয় এলাকার আশেপাশে। বেশ কয়েকবার ঢুকে পড়েছে ভারতের একান্ত নিজস্ব জলসীমা আন্দামান সাগরেও। ভারতীয় নৌসেনার গতিবিধির খবর নেওয়া, গুপ্তচরবৃত্তি চালানো এবং ভারতীয় জলসীমার বিভিন্ন এলাকা নিজেদের নৌসেনাকে চিনিয়ে রাখতেই চীনের এই কৌশল, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশারদরা।
ভারত পাল্টা জবাব দিতে চাইছে। দক্ষিণ চীন সাগরের আশেপাশে বিভিন্ন দেশে ভারত ইতিমধ্যেই নৌঘাঁটি তৈরি করে ফেলেছে। আন্দামানেও দ্রুত বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে সামরিক পরিকাঠামো। এ বার আরও জোর ধাক্কা দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে সরাসরি সামরিক জোট গড়তে দু’দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে বলে নৌসেনা সূত্রের খবর। ভারতীয় নৌসেনার কোনও আধিকারিক এ নিয়ে এখন মুখ খুলতে নারাজ। কিন্তু জানা গিয়েছে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের তৈরি কৃত্রিম দ্বীপের নাকের ডগায় এ বার যৌথ সামরিক মহড়া দিতে চলেছে ভারত-আমেরিকা। সাবমেরিন বিধ্বংসী যুদ্ধের কলাকৌশল আদানপ্রদান নিয়ে আয়োজিত সেই মহড়াটি হবে উত্তর ফিলিপিন্স সাগরে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রের খবর, ভারতের বিভিন্ন নৌঘাঁটিতে, বিশেষ করে আন্দামানে, মার্কিন নৌবহরকে এ বার আশ্রয় দেবে ভারত। তাতে মালাক্কা প্রণালীকে আরও অরক্ষিত বলে মনে করতে শুরু করবে চীন। তার সঙ্গে ভারতের সাবমেরিন বা যুদ্ধজাহাজ ভারত মহাসাগরের যে অঞ্চলেই টহল দেবে, সেখানেই তার সঙ্গী হিসেবে থাকবে মার্কিন নৌসেনার রণতরীও। একই ভাবে জাপান ইতিমধ্যেই হাত মিলিয়েছে আমেরিকার সঙ্গে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনা সাবমেরিনের গতিবিধির উপর জাপ-মার্কিন যৌথ বাহিনী সর্বক্ষণ নজর রাখছে। এ বার ভারত মহাসাগরেও ভারত-মার্কিন যৌথ বাহিনীর কড়া নজরদারির মুখে পড়তে হতে পারে চিনকে। সাবমেরিন বিধ্বংসী যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল এবং নানা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ভারতকে সরবরাহ করবে আমেরিকা।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতির বিশেষজ্ঞ তথা সাবমেরিন বিশারদ কলিন কোহ্ বলছেন, গোটা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম বড় সাবমেরিন শক্তি এখন ভারত। আমেরিকা ভারতকে সঙ্গে নিয়ে চীনের উপর নজরদারি শুরু করলে, বেজিং-এর পক্ষে পরিস্থিতি অনেকটাই কঠিন হয়ে উঠবে।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
০২-০৫-২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৬ রাত ৮:৩২