একটা সময় ছিল যখন তোমার হাত ধরে আমি চলতাম। যখন আমার সবচেয়ে বড় বন্ধুটি ছিলে তুমি। যাকে ছাড়া আমার একটি দিনও কাটতে চাইত না। গুটি গুটি পায়ে দৌড়ে গিয়ে আমি যখন তোমার কোলের উপর ঝাপটে পড়তাম তখন তুমি বলতে আস্তে দাদু ভাই, আস্তে। পড়ে যাবি ত! আমি কি আর তোমার কথা শুনতাম! তুমি যখন বাজারে যেতে, আমি তোমার সাথে যেতে চাইলে মা তোমাকে বাধা দিত, এই ভয়ে তুমি মায়ের সামনে আমাকে বাজারে যাওয়ার কথা বলতে পারতে না। আমার আজও খুব হাসি পায় তুমি তখন কিভাবে ঘরের আড়াল থেকে আমাকে ইশারায় ডাকতে। কিন্তু মায়ের চোখ ফাঁকি দেয়া সহজ ছিল না, মা ঠিকই বুঝতে পারতেন, বলতেন বাবা, নাতিটাকে এভাবে বাঁদড় বানাবেন নাকি? তুমি মাকে মিষ্টি গলায় বলতে বউমা, এই বয়সটাতেই তুমি ছেলেটাকে এমন শাসনে বেঁধে রেখ না। ওকে এই পৃথিবীর সৌন্দর্যটা দেখতে দাও, বিশেষ করে আমি যতদিন আছি। মা আজ ভাল ভাবে বুঝতে পারে দাদু, তোমার সাথে বনে-বাঁদাড়ে, মাঠে-ঘাটে, পুজা-পার্বনে, বা যাত্রাপালায় এমনকি সার্কাস খেলা দেখতে যাওয়া আমার জন্য কতটা ফলদায়ক হয়েছে। আমি হয়ত একটু বাঁদড় হয়েছি বটে, কিন্তু জীবনটাকে খুবই অল্প বয়সে দেখেছি নানা আঙ্গিকে।
দাদু, মায়ের আচল ধরে বড় হয়েছি বটে, কিন্তু তোমার কোল আর কাঁধের ঋণও কিন্তু কম নয়। তোমার কোলে আর কাঁধে চড়ে আমি দেখেছি সুজলা, সুফলা, শষ্য-শ্যামলা কিন্তু নিষ্ঠুর এই পৃথিবীটাকে। নদীতে যখন তুমি গোসল করতে যেতে আমাকেও তুমি সঙ্গী করতে, কিন্তু, সেই এক সমস্যা, মা কিছুতেই রাজী হত না। তুমি বলতে বৌমা, স্রোতের এমন কি সাধ্য আছে যে দাদু ভাইকে আমার বুক থেকে আলাদা করে নিয়ে যাবে। তুমি ছিলে আমার সেই ছোট্ট জীবনের সবচেয়ে বড় ভরসা। পৃথিবীতে মানুষের অনুপ্রেরণা আসে মানুষেরই কাছ থেকে। প্রত্যেক মানুষেরই একজন আদর্শ থাকে যাকে আকড়ে ধরে সে এগিয়ে চলতে চায়। তুমি আমার কাছে আমার আদর্শ, দাদু। তুমি শিক্ষিত ছিলে না কিন্তু, তোমার মাঝে আমি যে সততা, সৃজনশীলতা, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর মানুষকে কাছে টেনে নেওয়ার সাহসিকতা দেখেছি তা কোন প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না। তোমার এ সকল অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান যাকে বলে স্বশিক্ষা তার মাধ্যমে যেমন তুমি নিজেকে চালিয়েছ সুন্দরভাবে এই পৃথিবীতে তেমনি আমাকে শিখিয়েছ সেসব কিছু।
দাদু, একটা সময় ছিল যখন তুমি আমাকে বলতে তোর ফুপুর বাসায় যাবি? আমি লাফিয়ে উঠতাম আর আমাকে তুমি নিয়ে যেতে। জানো দাদু, আজও আমি ভাবি কি মজাই হত সে সময়গুলোতে। গ্রামের মেলায় যেতাম তোমার কাঁধে চড়ে, আর তুমি আমাকে কাঁধ থেকে নামাতেই চাইতেনা হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে। আমি বলতাম দাদু, আমাকে নামাও না, আমি হেটে মেলা দেখব, কিন্তু, তাতে কোন লাভ হত না। তবুও বলতাম দাদু, মেলায় এসে বুঝি এভাবে কাঁধে চড়ে মেলা দেখার মজা আছে। একবার মেলায় গিয়ে আমাকে পুতা (বড় আকারের) মিষ্টি কিনে দিলে আর আমি দোকানের টেবিলের উপর পা ছড়িয়ে খেতে লাগলাম। মিষ্টি আর ফুরায় না। তুমি বললে দাদু ভাই, তাড়াতাড়ি খা। আর খেতে হবে না চল্, কিন্তু আমার কোন তাড়ায় কাজ নেই। আমি মনের আনন্দে পা ছড়িয়ে খাচ্ছি তো খাচ্ছিই। মিষ্টিও শেষ হয় না আর আমার উঠারও নাম নেই। তুমি রেগে গিয়ে বলেছিলে তুই থাক আমি বাড়ি গেলাম। আমি বলে ছিলাম আচ্ছা। দোকানে উপস্থিত সবাই হা হা করে হেসে উঠল। আমি তখন না বুঝলেও আজ মনে পড়লে খুব হাসি পায়। সেদিন আরো একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল, টেবিলে রাখা একটা বদনা থেকে আমি পানি খেয়ে তোমাকে বললাম দাদু, এই পানি এত মিষ্টি কেন! একথা শুনে পাশে বসে থাকা এক দাদু হেসে বলল দাদু ভাই, তুমি আমার বদনার সব দুধ খেয়ে ফেললে! আমার স্কুলে যাওয়াতেও তোমার ভয় ছিল তাই, তুমি নিজে আমাকে নিয়ে যেতে সাথে করে। সে সব কথা কি তোমার মনে পরে, দাদু?এমন হাজার রকমের স্মৃতি জরিয়ে আছে তোমার সাথে আমার কৌশোর পর্যন্ত।
কিন্তু জীবন নামের যে চাকাটা কোন দিনও স্থির হল না, সে চাকার ঘূর্ণনে তুমিও একদিন বার্ধক্যের টান সামলাতে না পেড়ে বৃদ্ধ হয়ে গেলে। তখন আমি হয়ে গেলাম তোমার দাদু আর তুমি আমার নাতি। সময়ের পরিক্রমায় যখন আমি বড় হয়ে উঠলাম এবং নটর ডেম নামক এক কলেজে পড়ালেখার সুযোগ পেলাম, তখন মায়ের সে ভয়টা তোমাকে পেয়ে বসল। তুমি কিছুতেই আমাকে ঢাকায় একা থাকতে দিবে না বলে স্থির করলে তখন, তোমার কথাই তোমাকে মা বলেছিল, বাবা, আপনি না ওকে অনেক বড় বানাতে চেয়েছিলেন। তুমি আর কি করবে, উপায় তো আর ছিল না, দাদু। আমাকে যে তুমি অনেক বেশি ভালবাসতে। আমি জীবনে অনেক বড় হব এটা তোমার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু, যখন সে সুযোগ আসল তুমি যখন তাতে বাধা দিচ্ছিলে তখন তোমার নিজের কাছে নিজেকে বড় অপরাধী বলে তনে হয়েছিল। দাদু, আমি জানি আমাকে ছেড়ে থাকতে তোমার অনেক কষ্ট হয়েছিল। তাইত দিনে কতবার যে ফোন দিতে আর বলতে দাদু কবে আসবি বাড়িতে? তোকে নিয়ে এখানে যাব ওখানে যাব, তোর ফুপুর বাসায় যাব, আমার যে অসুখ করেছে তুই বাড়ি আয়, আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবি না? তোর বাবা-কাকা বা ভাইয়েরা কিছুই বুঝে না। আমি বুঝতাম আমার জন্য তোমার বুকটা ফেটে যেত। তুমি অসুস্থ হতে না সাধারণত কিন্তু দূরে একা যেতেও পারতে না। তাই আমি বাড়ি আসা পর্যন্ত তুমি অপেক্ষা করতে।
এমনি করে বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেল ,দাদু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে তোমাকে আরো বেশি মিস করতাম কারণ, এখানে যে শিক্ষাটা আমি পাই তা তোমার দেয়া শিক্ষার সাথে অনেক মিলে যায়। এখানে সবাই সবার সাথে যে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলে সেটা অনেক আগেই আমাকে শিখিয়েছ, দাদু। শেষ সময়টাতে তুমি প্রায় অসুস্থ হয়ে যেতে আর আমাকে ছুটে যেতে হত বাড়িতে কিন্তু, আমি বুঝতাম আমাকে দেখেই তুমি অনেকটা সুস্থ হয়ে যেতে। আজ সেসব কথা মনে হলে কষ্টে আমার বুকটা ভেঙ্গে যায়, দাদু? আমাকে কাছে টেনে নিয়ে তুমি গল্প বলতে চেষ্টা করতে তুমি, আবার নিজেই বলতে তুই ত বড় হয়ে গেছিসরে এ গল্প কি আর তোর ভাল লাগবে। বাল্যকাল থেকে যৌবন অবধি তোমার সাথে আমার সে সব সুখ দুঃখের স্মৃতিগুলো আমাকে খুব কাঁদায় ,দাদু। ভালই ত চলতেছিল দাদু, কিন্তু হঠাৎ করে আমাদের এভাবে কাঁদিয়ে চলে যাবে একথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। আমাকে ছেড়ে কেমন করে চলে গেলে, দাদু? একটি বারও কি আমার মুখটি তোমার মনে পরেনি। আরো কিছু দিন, কিছু মাস, কিছু বছর কি আমাদের নিয়ে থাকতে পারতে না? এমনি করে এতটা কাঁদিয়ে চলে যেতে পারলে!
জানো দাদু, আমি আজও প্রায় স্বপ্নে তোমাকে দেখি তুমি আমাকে কোল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ সেসব বন-বাজারে, বা মেলায়। দাদু, তুমি কেমন আছ? আমি জানি আমাকে তুমি দেখছো ওপার থেকে। আমাকে তুমি আর্শীবাদ করছ। আমার সুখে তুমি সুখ পাচ্ছ, দুঃখ পাচ্ছ আমার কষ্টে। হয়ত ভাবছ ছেলেটাকে এভাবে যদি ফেলে না আসতাম! তাকে এখন দেখার মত কেউ নেই। সত্যিই দাদু, তোমার মত করে দেখার, ভালবাসার আদর করার কেউ নেই। দাদু, আমি জানি পৃথিবীর এ মায়াজাল ছিড়ে একদিন আমাকেও যেতে হবে সেই অজানায়, যেখানে তুমি আছ। দাদু, আমি যদি আসি তবে আমাকে তোমার কাছে রাখবে ত? এ জগতের মত ভালবাসবেত আমায় তুমি সে জগতে? আমার জন্য অপেক্ষা কর হয়তো কোন এক অজানা দিনে দাদু, সৃষ্টিকর্তার আদেশে আমিও আসব তোমার কাছে। ভাল থেক, দাদু। তুমি ভাল থেক।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৬ সকাল ১১:০৯