গাজার মানুষের মাথাপিছু আয় ৮৭৬ ডলার, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১০৪৪ ডলার। সর্বনিম্ন মাথাপিছু আয়ের ৫০ দেশের তালিকা করলে আমরা বাংলাদেশীরা এবং গাজাবাসীরা অনায়াসে সেখানে স্থান করে নিতে পারব। তবু আমরা দেশ বলি, নিজের জাতির মানুষ সবচে ভালবাসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে গাজার একজন ছাত্র আছে, নাম সালিম কানিতা। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই যে এত দারিদ্র আর সংঘাত গাজায় তোমার তো নিশ্চয়ই বাংলাদেশে বেশী ভাল লাগার কথা। সে বলল, "দেয়ার ইজ নাথিং লাইক হোম হোয়ারেভার ইউ গো"। কথাটা মনে গেথে গেছিল। ওদের সমুদ্র ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রনে, মিশরের সীমান্ত বন্ধ, আর ইসরায়েলে সীমান্তে কথা নাই বল্লাম। মিশর সীমান্ত দিয়ে শুধু শিক্ষা ও চিকিৎসার জরুরী প্রয়োজনে ওরা বর্ডার ক্রস করতে পারে।একবার কেউ বের আবার গাজায় ফেরা অত্যন্ত দুরুহ কাজ। ওসব চেকপয়েন্টের কিছু ভিডিও ইউটিউবে আছে দেখতে পারেন। ওদের পাসপোর্টে দেশের নাম নাই, ওদের পরিচয় রিফিউজি।
ইউএনএইচসিআর ফিলিস্তিনের বাইরে আসা সবাইকে এই রিফিউজি কার্ড দেয়, ওটাই ওদের পরিচয়। স্বাভাবিক সময়েই দিনে ৮ ঘন্টা থেকে ১২ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকে না, আর এখন বোমা হামলার সময় কি অবস্থা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের শহরে সকাল বিকাল বোমা হামলা না হলে বিদ্যুতের অবস্থা তথৈবচ, নিজেদের বিদ্যুৎ প্লান্ট বন্ধ কইরা অনেক বেশী দামের বিদ্যুৎ গলাধকরন করছি এবং পকেট ঝাইড়া ঝুইড়া টাকা পরিশোধ করছি। বিদেশী সাহায্যই ওদের প্রধান আয়ের ক্ষেত্রে পরিনত হয়েছে। ২০০৮, ২০১০,২০১২, সালের হামলায় গাজার অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে । আমাদের বাংলাদেশে কল-কারখানা হওয়ার আগেই টিফা/টিকফা কইরা বিশ্বব্যাংক আইএম এফের শর্ত মেনে শিল্পায়ন হওয়ার সম্ভাবনাও নাই করে দিচ্ছি।
গাজার অর্থনীতি বিদেশী খয়রাতের উপরে নির্ভর, যে সব দেশে শিল্পায়ন ঘটে না তাদের এ দশাই হয় যেমন আমাদের দেশ বাংলাদেশ। অামরাও গাজার মত সরাসরি না হলেও প্রকারান্তরে খয়রাত গ্রহন করছি। আমাদের আয়ের একটা বড় অংশ রেমিট্যান্স, যার কোন বিশ্বাস নাই। কখন কোন দেশ বলবে ভাগো, অামাদের ভাগতে হবে। ওখানে ন্যায্য মজুরির আলাপ বাদই দিলাম।
গাজার লাগোয়া প্রতিবেশী একটি দেশ অর্থনৈতিক ভাবে বিপুল সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছে, ইসরায়েল। ইসরায়েলের মাথাপিছু আয় ধারনা করতে পারেন... প্রায় ৩৫০০০ মার্কিন ডলার। মানে গাজাবাসী প্রায় ৪০ জন মানুষের আয়ের সমান একজন ইসরায়েইলির আয়। অথচ দেশদুটো দুরত্ব হাতছোয়া। আরো সহজে বললে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ তথা বর্ডারে জাপান থাকলে ব্যাপারটা বাংলাদেশীদের কাছে যেমন ঠেকবে ঠিক একই রকম অনুভুতি হয় অকুপাইড গাজার নিগৃহিত মানুষের। এমন মহাকাশ থেকে জমিন পার্থক্য গাজা আর ইসরাইলি অর্থনীতির।
গাজা,(মাত্র ৩৬০ বর্গকিলোমিটার জায়গায় প্রায় ১৮ লক্ষ লোক) যা পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ন এলাকা প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৫০০০ মানুষ বসবাস করেন। তুলনায় যদিও সমগ্র বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব (প্রায় ১১০০ প্রতি বর্গ কি.মি.)কম তবে ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব গাজার মতই।আমরা ঢাকায় যেমন গলি ঘুপচির মধ্যে বসবাস করি গাজার অবস্থাও তাই। আমাদের ঢাকার সবচে বড় বস্তিগুলা ট্রেনলাইনের পাশে আর গাজার সবচে বড় বস্তি ভূমধ্যসাগরের ধারে, সমূদ্র সৈকতে। যদিও ওদের বস্তির অবস্থা আমাদের চেয়ে ভাল। তবে যুদ্ধকালীন শরণার্থীদের শিবিরের অবস্থা অবর্ণনীয়।
১৯৪৮,১৯৬৫ সহ অসংখ্য আক্রমন হত্যা আরব-ইসরাইল সম্পর্কে গভীর ক্ষত তৈরী করেছে, একটা তথ্য জেনে অবাক হবেন ইসরায়েল জনসংখ্যার ১৮ ভাগ আরব মুসলিম। আবার গাজার জনসংখ্যার একটা ছোট অংশ খ্রিস্টান। আইডিএফ( ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স ) এ শুধু ইহুদীরা নন ড্রুজ ও বেদুইনরাও আছেন।
এই যুদ্ধ কোন প্রকারেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদীদের যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধ দখলের, আরো আরো সম্পদের। যার ভাগ কখনো ইসরায়েলের শান্তিকামী ইহুদী লোকটি পায়না, চলে যায় নেতানিয়াহুদের পকেটে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রত্যক্ষ মদদে ঘটছে এই সংঘাত। আবার ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে ধর্মীয় কট্টরপন্থী শক্তির উদ্ভব এ সমস্যাকে আরো উৎকট করে তুলেছে, যদি একই ভাবে ইসরাইলেও কট্টর ডানপন্থী লিকুদ পার্টি ক্ষমতায় থেকে সংঘাতকে আরো নৃশংস ও ধ্বংসাত্বক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।গত এক যুগের সংঘাত গাজাতে হামাসের চেয়েও কট্টর ডানপন্থী ইসলামিক জিহাদের জন্ম দিয়েছে। সংঘাত ইসরায়েলেও কট্টর ইহুদী ডানপন্থীদের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি করছে।
তবে ইসরায়েলের প্রগতিশীল মানুষ এই গণহত্যার প্রতিবাদে মুখর আছেন, গত জুলাই ১৭ তারিখে ইসরায়েলের কমিউনিস্ট পার্টির মিছিলে কট্টর ডানপন্থীরা হামলা করেছে, ফ্রান্সে ইংল্যন্ডেও চলছে বিক্ষোভ। এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের সকল মানুষের ঐক্য আজ একান্ত জরুরী যা নতুন রাজনৈতিক চিন্তার জন্ম দেবে, আজকের বাস্তবতায় সম্ভবত ইসরায়েলকে অস্বীকার করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র এগোতে পারবে না। ডানপন্থী ধর্মীয় কট্টরপন্থা আরব মুসলিমদের গত একশতাব্দী ধরে পিছনেই ঠেলে দিয়েছে, মধ্যযুগে মুসলিম মানসে জ্ঞান বিজ্ঞানের যে অপরীসীম আগ্রহ জন্মেছিল তাই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল মুসলমানদের। এপথেই তাই হাটতে হবে আরবদের।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ এমন সরাসরি আক্রমনের শিকার না হলেও ভয়াবহ সাম্রাজ্যবাদী শোষনের মধ্যে রয়েছে ফলত মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটেনি, প্রতিবেশী ভারত গত দশ বছরে আমাদের হাজারের ও বেশী মানুষকে হত্যা করেছে। পানি আটকিয়ে আমাদের প্রধান অর্থের উৎস কৃষিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদ করতে গিয়ে ধর্মীয় বিভাজনের স্লোগান তুলে হিন্দু মুসলিম বলে কিংবা মুসলিম-ইহুদী বলে আমাদের জাতিসমুহের শক্তিকে আরো ক্ষুদ্র করে তুলব আমরা। হিন্দু ধর্মের মানুষ কিংবা ইহুদী ধর্মের মানুষ মুসলমানের শত্রু হতে পারে না, শত্রু তারা যারা ক্ষমতার জন্য পুজির, কেন্দ্রকে খুশি করার জন্য মানুষের উপরে দমন পীড়ন চালায় ।
গাজা আর ঢাকার সংগ্রামের অনেক মিল, পার্থক্য শুধু প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ আঘাতের।