ভারতের সিনেমা সরাসরি তাদের শাসকবর্গের গ্রান্ড ন্যারাটিভ প্রচারে মনপ্রাণ উজাড় করে নেমেছে। এক ও অখন্ড ভারতের প্রতাপশালী শাসকগণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করতে সদা প্রচেষ্ট, তাদের সিনেমাতেও আমরা বারবার এই প্রচেষ্টার প্রতিফলণ দেখি। গুন্ডে সিনেমাতে সরাসরি সেই প্রচেষ্টা দেখতে পাই। এই সিনেমায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে অভিহিত করায় শাহবাগে কর্মসূচি পালন করেছি, মিছিল করেছি। সদ্য মুক্তি পাওয়া বাস্টার্ড চাইল্ড ওরফে চিল্ড্রেন অব ওয়ার মানে যুদ্ধশিশু সিনেমাতেও নির্লজ্জভাবে ভারত রাজাদের মনোভাব প্রকটভাবে উৎকটিত হয়েছে। তবে গুন্ডে সিনেমার মতো সরাসরি কোন কথা না বলায় অনেকেই চুপচাপ আছেন, কেউবা প্রশংসাও করছেন। এই সিনেমার ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যায় এই সিনেমার উদ্দেশ্যে হল বীরাঙ্গণাদের অবস্থা মানুষের সামনে তুলে ধরা। আদতে এই সিনেমার কোথাও কোন দৃশ্যে বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদের প্রকৃত অবস্থার ধারকাছ দিয়েও যাওয়া হয়নি। বরং তাদেরকে অপমানই করা হয়েছে। রাইমা সেন মানে ফিদাকে পাকিস্তানি সৈন্য কতৃক ধর্ষন দৃশ্য সম্পূর্ণ কমার্শিয়াল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এই সিনেমার পোস্টার অত্যন্ত আপত্তিকর, দেখলে মনে হবে পর্দার আড়ালে কেউ রতিক্রিয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে ( একটা ক্যাম্পের দৃশ্য মিন করা হয়েছে)। বাংলাদেশে ৭১ সালে নির্যাতিত ৪ লক্ষ নারী যে ভয়ানক মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন তার কোন ইঙ্গিত এ সিনেমায় দেখা যায় না, বরং যে অংশটুকু বাজার চলতি , কমার্শিয়াল তাকেই বিরাট করে দেখানো হয়েছে। যুদ্ধের পর স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান যে এই যুদ্ধশিশুদের বাংলাদেশের মাটি গ্রহণ করবে না বলে মত দিয়েছিলেন তার প্রমান আছে, এর ফলশ্রুতিতে সে সময়ের সমাজ বাস্তবতায় এই নির্যাতিত আমাদের মুক্তিযোদ্ধাগন যে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়েছিলেন তা ভাবতে গেলেই গা শিউরে উঠবে। এরকম অসংখ্য ঘটনা আমরা জানি সেগুলো তুললাম না। নীলিমা ইব্রাহীমের "আমি বীরাঙ্গনা বলছি" বইয়ে এর রেফারেন্স রয়েছে। বিপরীতে আমরা দেখি একটা স্টাবিলিটির সুর বাজে যা শাসকদলের পক্ষে যায় । শাহবাগে সেই বীরাঙ্গনার নাতি আন্দোলন করছে সে দৃশ্যের মাধ্যমে। মানে ফিদা( যুদ্ধে চিত্রিত নির্যাতিত নারী) আর কোন সমস্যায় নিপতিত হননি, সে সুখে শান্তিতে বসবাস করেছেন তার ঘর হয়েছে সংসার হয়েছে কোন সমস্যা ছিলনা। অথচ নির্মম বাস্তবতা হলো অসংখ্য যুদ্ধশিশু মানবেতর জীবন যাপন করছেন, বিদেশে অনেক যুদ্ধশিশু দত্তক নেয়া বাবা কতৃক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, অনেক পরিবার তো বটেই অনেক স্বয়ং মা ও এই শিশুদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছেন এমন নজিরও আছে। অসংখ্য হৃদয়বিদারক সহ্য করা অসম্ভব এমন ঘটনা ঘটেছে যুদ্ধশিশুদের ঘিরে। এ বিষয়ক কোন গবেষণা এদেশে হয়না আর এমনিতেও এ বিষয়ে নির্যাতিত নারী মুক্তিযোদ্ধাগণ কথা বলতে চাননা তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাটাও কঠিন হয়ে যায়।
সিনেমার দৃশ্যায়ন গুলো বাংলাদেশের প্রকৃতির সাথে খাপ খায়নি, পাকিস্তানীদের ক্যাম্পগুলা কনেসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এর মত দেখতে লেগেছে অথচ বাংলাদেশে পাকিস্তানী ক্যাম্পগুলো ছিলো বেশীরভাগই স্কুলঘরগুলোতে। যাই হোক এরকম অসংখ্য বৈসাদৃশ্য দেখা যাবে, গেরিলা কে গরিলা লেখার মত ভুল নাকি স্বেচ্ছাকৃত বিষয় সেটাও দেখা যাবে এই সিনেমাতে। বস্তুত এই সিনেমাটি শিল্পগুণে উত্তীর্ণ হয়নি, এবং আলোচ্য বস্তুর ধারকাছ দিয়ে যায়নি। এবং নির্মাতাগণ বারবার শাসকগোষ্ঠীর ন্যারাটিভ এসটাবলিশ করতে চেয়েছে। যেমন এক দৃশ্যে বলা হচ্ছে "আমরা প্রথমে বাংলাদেশী তারপরে বাঙ্গালী হেরপর মুসলমান"। যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশী কনসেপ্টটাই ছিলনা। জয়বাংলা স্লোগান মানে নিজেকে বাঙালী ভাবাটা গোটা বাংলাভাষী মানুষকে একত্র করে ফেলবার যে সম্ভাবনা তৈরী করে সে বিষয়ে ভারতশাসকগণ ভীত। সেহেতু এই সিনেমাতে আমাদের বাঙ্গালী পরিচয়কে গৌন করে দেখাবার একটা প্রচেষ্টা আছে।
বাংলাদেশের নারীরা ৭১ সালে যে ভয়াবহ নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং পরবর্তীতে সেই শিশুরা যে অবর্ণনীয় দুর্দশার শিকার হয়েছেন সেসব দিকে না গিয়ে সিনেমাটা আমাদের ত্যাগ তিতিক্ষাকে খাটো করে পর্দায় উপস্থাপন করেছেন।
ইতোমধ্যে খোদ বাংলাদেশে এই ভারতীয় সিনেমা ১৪ টি সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে.........
এই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানাই।