ট্রাভেলার টিংকু ভাইয়ের ওয়ালে একটা ঝরনার ছবি দেখে ক্লিক করে উনার ওয়ালে গিয়ে আরও কিছু ছবি দেখলাম সবগুলো ছবির পাশে HamHam লেখা ।সাথে সাথে এক বন্ধুকে ফেইসবুকে নক ছবির লিংকগুলো দিয়ে বললাম ওই চল হামহাম ঝরনাতে যামু । বন্ধুও ছবিগুলো দেখে বললো তুই শুধু ক কবে যাইবি আমি আট দশ পা নিয়া খাড়া । নানা টালবাহানার পর হাম হাম দেখতে দুই দিনের ভিতরেই আমরা আটজন রওয়ানা দিলাম ........
বৃহস্পতিবার তিনটার মধ্যে শ্রীমঙ্গল পৌছে গেলাম,ভাবলাম বিকেলটা আর নষ্ট করে কি লাভ চা বাগান থেকে ঘুরে আসি । ফিনলে চা বাগানের কাছে গিয়ে বাগানে এদিক সেদিক ঘুরলাম তারপর নীলকন্ঠে গ্রিন টি আর হোয়াইট টি বেশ মজা করে খেলাম । হোয়াইট টি আসলেই বেশ মজার চা, হালকা আদার ঘ্রাণ আসে বেশ মজা লাগে । আবার খাইতাম মুন চায়
বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে রুমে ফিরে রাতের দিকে দিলাম ঘুম........
সকালে আমাদের হামহামের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেবার কথা ছিলো ভোর ছয়টায় কিন্তু গাড়ির ঝামেলায় ছয়টার জায়গায় রওয়ানা দিলাম সকাল নয়টায় দুভার্গ্য মনে হয় আমাদের পিছনে লেগেছে এমনিতেই লেইট হয় গেছে তারউপরে রাস্তায় দেখি ব্রিজের উপরে ট্রাক আটকে গেছে রাস্তা বন্ধ ড্রাইভার তাড়াতাড়ি অন্য রাস্তায় রওয়ানা দিলো কিন্তু ............. ওই রাস্তায় পাহাড় ভেঙ্গে রাস্তাতে গাড়ি চলাচল করতে পারছেনা সবাই গাড়ি থেকে নেমে অনেক কষ্টে ভাঙ্গা অংশটা পার হয়ে হামহামের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম ।
পিকআপের ভিতরে আমরা
সাড়ে দশটার ভিতরেই গাড়ি আমাদেরকে কলাবন নামিয়ে দিলো এখান থেকে হামহাম যাবার জন্য গাইড নিতে হবে আর এখান থেকে রাজবাড়ী ফরেস্ট এর শুরু মানে পায়ে হাটার রাস্তা শুরু হলো আমাদের.....
হালকা কিছু খাবার নিয়ে আল্লাহর নামে হাটা শুরু করলাম ,দুই মিনিট হাটতে না হাটতেই বৃষ্টি নামলো সবগুলো মোবাইল আর ক্যামেরা পলিথিনে প্যাক করে ব্যাগ কাধে ঝুলিয়ে বৃষ্টির ভিতরেই হাটা ধরলাম হামহামের উদ্দেশ্য ।
প্রায় পুরোটা রাস্তা এমন পানিতে হাটতে হয়েছে
আসলেই অসাধারণ লাগছিলো তখন,আমার সবাই হাটছি মনে মনে জোকের ভয় আবার বৃষ্টিও পড়ছে । মাটির উ্পরে বেশিদুর হাটতে হলোনা শুরু হয়ে গেলো ঝিরিপথ দিয়া হাটা । আমার যখন ছিলাম তখন ঝিরিপথে স্বাভাবিকের চেয়ে পানি অনেক বেশি ছিলো কোথাও কোমর সমান কোথাও আবার বুক সমান পানি ।
মাঝে মাঝে এমন পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়েছি
আমাদের গাইড রামুজি সবাইকে একটা একটা করে বাশের লাঠি হাতে ধরিয়ে দিলো আমারাও সবাই বেশ উৎসাহ নিয়ে বাশের লাঠি নিয়ে হাটা ধরলাম ঝিরি পথে ,পানির স্রোত স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হওয়াতে সবারই একটু কষ্ট হচ্ছিলো হাটতে তারপরও হামহাম দেখার লোভে সবাই হাটছে..........
রাস্তাতেও ভালো ঝুকি আছে
ঝিরিপথ আমার সবসময়ই অসাধারণ লাগে ,বান্দরবনে ঝিরিপথের ভিতর দিয়ে হাটার সময় যে অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তা কোনদিন ভুলবোনা । হামহাম যাবার পথের ঝিরিপথটাতেও তাই কোন ক্লান্তি নাই চারদিকে উচু উচু পাহাড় গাছ গাছালি আর আমরা হাটছি এর মাঝে, ঝিরিপথে আসলেই অসাধারণ নিজেকে তখন ভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো যে আমি এমন একটা জায়গাতে আসতে পেরেছি
দুই দিকে উচু পাহাড় মাঝ খান দিয়ে হাটছি আমরা
হামহাম যাবার পথে মাকাম নামে একটা পাহাড় টপকাতে হয় পাহাড়ে উঠার রাস্তাটা একদই খাড়া আবার তখন বৃষ্টিও হচ্ছিলো তাই রাস্তাটাও বেশ পিচ্ছিল ছিলো । আমার সাথে দড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম ,আমি আর আমার এক ফ্রেন্ড পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে দড়িটা বাশের সাথে বেধে দেওয়ার পর বাকীরা তর তর করে উঠে যায় । এই পাহাড়টা একেতো খাড়া তারউপরে এই পাহাড়ে রাজ্যের সমস্ত জোকের বাসা।
মাকাম পাহাড় থেকে নামার পর সবাই শরীরে জোক আছে কিনা তা চেক করছে
পাহাড়ে উ্ঠার সাথে সাথে জোকের আক্রমণ শুরু হলো আর আমরাও সাথে লবন নিয়ে গিয়েছিলাম কেউ কেউ ও মাগো জোক গো বলে চিল্লানি শুরু করে দিলো । জোক আসলে তেমন ভয়ংকর কিছুনা জোক রক্ত খেয়ে নিজে নিজে পড়ে যায় । আমার কাজ ছিলো লবন দিয়ে সবার জোকগুলো দুর করা কাজটা বেশ ইন্টারেস্টিং আর মজার ছিলো, জোকের উপরে লবন মারতাম আর টান দিয়ে জোক ফেলে দিতাম । আমার শরীরে যতগুলো উঠেছে সব রক্ত খেয়ে নিজে নিজে পড়ে গেছে আমিও হাতেম তাই এর মতো এদেরকে রক্ত দিয়েছি । খা বাবা খা যত পারস রক্ত খা ।
নানা চড়াই উতরাই আর পানির সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে কানে ঝরনার আওয়াজ শুনতে পেলাম ,মনে আশার আলো জ্বলে উঠলো যাক ঝরনাতে পৌছতে পারলাম তাহলে । দুর থেকে গাছের আড়াল দিয়ে যা দেখলাম তাতে শুধু একটা কথাই মুখ দিয়ে বের হয়েছে ""সুবহানাল্লাহ আল্লাহু আকবার "
হামহাম /সিতাপ ঝরনা
বৃষ্টির কারণে ঝরনার পানি কয়েকগুন বেশি ছিলো । গগণবেদি আওয়াজ ঝরনার চারপাশে,ঝরনার আশেপাশের গাছের পাতাগুলো ভিজে একাকার আর চারদিকে বাতাশ আর পানির কণা । অবাক মুগ্ধ হয়ে শুধু তাকিয়েই রইলাম ।
অসাধারণ হামহাম
ছবিতে দেখে সে রুপ আপনারা অনুভব করতে পারবেন না । শুধু সরাসরি যারা দেখবে তারাই শুধু বুঝতে পারবে আসলে কত সুন্দর ছিলো সে ভয়ংকর রুপ ।
বেশিক্ষণ থাকা গেলোনা সেখানে কারণ গাইড তাড়া দিচ্ছিলো যে পানি বাড়তেছে পরে ঝিরিপথে হাটতেই পারবেন না,চলেন রওয়ানা দেই । বৃষ্টির ভিতরেই ক্যামেরা বের করে তাড়াতাড়ি কিছু ছবি তুলে নিলাম
ঝিরিপথে আবার ফিরতি রাস্তা ধরলাম সেই পাহাড় বেয়ে,....স্রোতের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে মিলিয়ে চলতে লাগলাম । মাকাম পাহাড়ে আবার সেই বিপদজনক রাস্তা তারপরও কারো কোন দুর্ঘটনা ছাড়াই নিচে নেমে ঝিরিপথের পানিতে গা এলিয়ে দিলাম আহ শান্তি.........অনেকগুলো জোক বের করলাম সবার শরীর থেকে
গুরু আর পারছিনা একটু বিশ্রাম চাই
আস্তে আস্তে ফিরে আসলাম কলাবনে.........রিজার্ভ গাড়ী দিয়ে শ্রীমঙ্গল ফিরে আসলাম
হামহাম ঝরনা দেখার ভ্রমণটা আসলেই অসাধারন ছিলো যারা গিয়েছি শুধু তারাই বুজতে পারবে কতটা ইন্টারেস্টিং ভ্রমণ ।
আমাদের সময় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি পানি বেশি ছিলো তাই কষ্ট যেমন বেশি হয়েছে [আসার তিনদিন পযর্ন্ত হাত পা ব্যাথা ছিলো] মজাও বেশি পেয়েছি বিশেষ করে ঝরনার রুপ কোনদিন ভুলবোনা ।
যারা হাম হাম যেতে চান জন্য দিকনির্দেশনা
**হামহাম ঝরনাটা মৌলভীবাজার জেলার কমলগন্জ উপজেলার রাজবাড়ী ফরেস্টের গভীরে অবস্হিত
**আসতে এবং যেতে প্রায় ৬/৭ ঘন্টা হাটতে হয় বনের ভিতরে আর ঝিরি পথে হাটতে হবে
**শ্রীমংগলে চলে আসুন আগের রাতে এসে যেকোন একজন পিকআপ অথবা রাস্তা ভালো আছে কিনা খবর নিয়ে সিএনজিও নিতে পারেন কলাবন যাবার জন্য
**পিকআপ ২০০০-২৫০০ রির্জাভ [আসা যাওয়া] ভাড়া নিতে পারে আর সিএনজি ১২০০-১৫০০ টাকার মতো নিতে পারে
**কলাবন গিয়ে রামুজি নামে একজন গাইড পাবেন উনাকে সাথে নিয়ে নিবেন ।প্রয়োজন লাগলে রামুজির সাথে আরও ১/২ জন গাইড নিতে পারেন ব্যাগ /খাবার বহনের জন্য । গাইডদেরকে প্রতিজনে ১৫০-২০০ টাকা দিলেই হবে ।
**রামুজিকে না পেলে অন্য কারো সাথে কথা বলে চালাক চতুর দেখে কাউকে নিয়ে নিবেন ।
**জোক নিয়ে নো টেনশন ..সাথে সরিষার তেল আর লবণ নিয়ে নিবেন । জোকে ধরলে লবন দিয়ে দিবেন আর কোন কিছু দিয়ে ফেলে দিবেন যদিও আমি নিজে হাত দিয়ে টেনে টেনে ফেলে দিচি
**দুপুরে খাবার জণ্য হালকা শুকনা খাবার নিয়ে যাবেন
**প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ডেটল ,নাপা ,তুলা এগুলো নিয়ে নিতে পারেন
**থ্রিকোয়াটার্র টাইপের প্যান্ট আর টিশার্ট পরে যাবেন জুতা হিসেবে কেডসের তুলনায় প্লাস্টিকের স্যান্ডেল বেশ কাজে দেয় । বাটা স্যান্ডাক প্লাস্টিকের স্যান্ডেল কিনে নিতে পারেন ভালো গ্রিপ দেখে দাম ১০০-১৫০ টাকা নিবে
**মেয়ে মানুষ সাথে নিবেন কিনা আপনার সিদ্ধান্ত নাজুক টাইপের মেয়েদের এই রাস্তাতে না নেওয়াই ভালো । আমাদের টিমের সাথেই আরেকটা টিম একটা মেয়ে দুইটা ছেলে রওয়ানা হয়েছিলো মেয়েটার প্রাণশক্তিতে বেশ অবাক হয়েছিলাম কিন্তু দৃভার্গ্য অর্ধেক রাস্তাতে গিয়ে মেয়েটার পা কেটে যাওযাতে আর সামনে যাওয়া সম্ভব হয়নি
**এখন বর্ষাকাল তাই পানি পাবেন বেশি রাস্তায় কষ্টও হবে অনেক বেশি ,শীতকালে তেমন পানি থাকেনা রাস্তায় তবে বর্ষাতে যে রুপ পাবেন ঝরনার, শীতে সেটা না পাবার আশংকাই বেশি ।কারন শীতে অধিকাংশ ঝরনাতেই একদম সামান্য পানি থাকে
**বষার্তে সাথে পলিথিন নিয়ে যাবেন যাতে বৃষ্টি আসলে মোবাই্ল ক্যামেরা এগুলো সেইফ করে রাখা যায় ।
**এখানে সবই প্রায় লিখে দিছি তারপরও যদি ভয় পান যে কই পামু গাইড,কই পামু গাড়ি তাইলে
শ্রীমঙ্গলের টুরিস্ট গা্ইড লিটনকে কল করুন ০১৭১০৯৯৪০৯৯ তাইলেই হবে সে সব ঠিক করে রাখবে তাকে চার্জ হিসেবে ৮০০/১০০০ টাকা দিতে হবে ।আমি আগে কিছুই জানতাম না তাই গাইড হিসেবে লিটনকে নিয়েছিলাম এখন সবইতো জানি তাই লিটনকে নেবার প্রয়োজন নেই আমার ।
**খরচের ব্যাপারটা আপনার আরাম আয়েশের উপরে নির্ভর করে ,তবে ২০০০-২৫০০ এর ভিতরে আরাম করে হয়ে যাবার কথা ।
কোন ব্যাপারে আর কিছু জানার থাকলে মন্তব্য করুন
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১১ রাত ১০:৪৫