বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস এর অসীম সাহসিকতার প্রতি সম্মান জানিয়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাকেই প্রথম মরণোত্তর 'বীরশ্রেষ্ঠ' খেতাব ঘোষণা করেন। ১৯৭২ সালে তাকে পুনরায় বীরবিক্রম খেতাব প্রদান করা হয় তাকে। কিন্তু ঘোষণা দিয়েও কেন জগৎজ্যোতিকে মরণোত্তর সর্বোচ্চ খেতাব 'বীরশ্রেষ্ঠ'র সম্মানে ভূষিত করা হলো না_ সে প্রশ্ন আজো রয়ে গেছে।
জগৎজ্যোতি অর্থাৎ পৃথিবীর আলো। আলো হয়ে ঠিকই জ্বলেছিলেন হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জের জলসুখা গ্রামের জগৎজ্যোতি দাস। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার নেতৃত্বে দাসপার্টি মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায় পাক হানাদারদের কাছে। জগৎজ্যোতির মুখোমুখি হওয়া মানে হানাদারদের একটি পরাজয়ের গল্প। উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তি সেনাদের কাছে প্রেরণার রসদ হয়ে উঠেন তিনি। মৃত্যুর সময়ও তিনি রেখে যান সেই প্রেরণার উৎস।
জন্ম এবং শিক্ষাজীবন
হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামের জীতেন্দ্র দাসের কনিষ্ঠ পুত্র জগৎজ্যোতি। শৈশব থেকে জ্যোতি শান্ত স্বভাবে হলেও ছিলেন প্রতিবাদী, জেদি, মেধাবী ও সাহসী । স্কুল জীবনেই জ্যোতি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর সুনামগঞ্জ কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন এবং তেজোদীপ্ত, বিপ্লবী ও স্পষ্টভাষী ছাত্র নেতা হিসেবে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন । ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে বিশেষ দায়িত্ব পালনে ভারতের গৌহাটির নওপং কলেজে ভর্তি হন। সেখানে অবস্থানকালে অনেকগুলো অঞ্চলের ভাষা আয়ত্ব করেন এবং ধীরে ধীরে নকশাল পন্থীদের সঙ্গে জড়িত হন। এখানে অস্ত্র গোলাবারুদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে আবার দেশে ফিরে আসেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান
১৯৭১ সাল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলা ও হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে রূখে দাড়ানোর জন্য সিদ্ধান্ত নেন জগৎজ্যোতি। যোগ দেন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ইকো-১ ট্রেনিং ক্যাম্পে। বাংলার ভাটি অঞ্চলের সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনা এবং হবিগঞ্জের হাওরাঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের ৭ নং সেক্টর। এ সেক্টরের কমান্ডারের দায়্ত্বি পান তৎকালীন মেজর শওকত আলী। ৭ নং সেক্টরকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের দায়্ত্বি প্রাপ্ত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অধীনে প্রথমত জগৎজ্যোতি বিভিন্ন আক্রমণে অংশগ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে প্রশিক্ষিত চৌকস যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত হয় গেরিলা দল, যার নাম দেওয়া হয় ফায়ারিং স্কোয়াড ‘দাস পার্টি’।
কয়েকটি সফল অপারেশন
জগৎজ্যোতি ইংরেজি, হিন্দি, গৌহাটির আঞ্চলিক ভাষায় পারদর্শী হওয়ার সুবাদে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সঙ্গে তার যোগাযোগ সহজতর হয় । এর ফলে দাস পার্টির জন্য ভারতীয় মিত্র বাহিনীর জগৎজ্যোতি আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহে সমর্থ হন । দাস পার্টির উল্লেখযোগ্য একটি অপারেশন ছিল পাকবাহিনীর বার্জ আক্রমণ । ’৭১-এর ১৬ই অক্টোবর পাকবাহিনীর সেই বার্জটিতে আক্রমণ চালিয়ে বার্জটি নিমজ্জিত করে। দাস বাহিনীর গেরিলা অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানী শত্রু ঘাঁটি ধ্বংস শুরু করে। পরবর্তীতে পাহাড়পুর অপারেশন, বানিয়াচংয়ে কার্গো বিধ্বস্ত করা, বানিয়াচং থানা অপারেশনসহ বেশ ক’টি ছোট বড় অপারেশন দাস পার্টির যোদ্ধারা সফল ভাবে সম্পন্ন করে।
বদলপুর অপারেশন
বদলপুর অপারেশন ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি একটি বিশাল সাফল্য । জগৎজ্যোতির সঙ্গে ছিল বানিয়াচংয়ের মোহাম্মদ আলী মমিন, আমির হোসেন, খালেক মাস্টার, হায়দারুজ্জামান খান ধন মিয়া, আজমিরীগঞ্জের রাশিদুল হাসান চৌধুরী কাজল, মতিউর রহমান, নিত্যানন্দ দাস, ইলিয়াছ চৌধুরী, আঃ রশীদ, নিপেন্দ্র দাশ, ছাতকের আয়ুব আলী, আঃ মজিদ ও দিরাই উপজেলার আহবাব হোসেন এবং নীলু। জগৎজ্যোতির দল আজিমিরীগঞ্জ, মারকুলি, গুঙ্গিয়ারগাঁও প্রভৃতি অঞ্চলে শত্রু ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। বদলপুরে শত্রুসেনারা দাস পার্টির প্রতিরোধের মুখে পাকসেনারা শক্তি বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়। গুলি ছোড়ার জন্য হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হয় । রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জগৎজ্যোতি র পাশে ছিল ইলিয়াস নামে আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা।
সম্মুখযুদ্ধ এবং মৃত্যুবরণ
পাক ক্যাম্প থেকে মাত্র ২০০ গজ দুরে রাজাকার/পাক সেনাদের আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে দাস পার্টি। রণাঙ্গণে পরিস্হিতির ভয়াবহ চিন্তা করে এক পর্যায়ে জ্যোতি তার দলকে ফিরে যাবার নির্দেশ দিয়ে একটি মাত্র এলএমজি নিয়ে নিজে একাই যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন । এজন্য জ্যোতি সহযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী মমিনকে নির্দেশ দেন যাতে অন্যরা তাদের জীবন বাঁচিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যায় । এরপর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন মাত্র দুইজন, জ্যোতি ও ইলিয়াছ। সুস্থির এবং দৃঢ় মনোবলের সঙ্গে তারা যুদ্ধ করতে থাকে একটানা কিন্তু হঠাৎ ইলিছাস পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হন। জ্যোতি পিছু না হটে তার মাথার লাল পাগড়ি খুলে শক্ত করে ইলিয়াসের বুকে এবং পিঠে বেঁধে দেয়, যাতে তার রক্তক্ষরণ থেকে যায়। ইলিয়াছ সেই অবস্থায় মেশিনগান নিয়ে ক্রমাগত গুলি ছুড়তে থাকে পাক হানাদারদের ওপর।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে ম্যাগজিন লোড করে শত্রুর অবস্থান দেখতে মাথা উঁচু করতে মুহুর্তে ১টি গুলি জগৎজ্যোতির চোখে বিদ্ধ করে। মেশিনগান হাতে উপুড় হয়ে পাশের বিলের পানিতে নিশ্চল হয়ে ঢলে পড়েন জ্যোতি ।
জগৎজ্যোতির মৃত্যু সংবাদ ওই সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়।
পাকবাহিনীর সহযোগী রাজাকারেরা রাতে জ্যোতির লাশ খুজে পেয়ে পাকবাহিনীকে খবর দেয় এবং জ্যোতির মৃতদেহটি আজমিরীগঞ্জ বাজারে নিয়ে যায়। রাজাকাররা জ্যোতি হত্যার ঘটনা ছড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য জ্যোতির অর্ধমৃত দেহ কে আজমিরীগঞ্জ গরুর হাটে একটি খুঁটির সঙ্গে ঝুলিয়ে পেরেক মেরে জনসমক্ষে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরা জ্যোতির নিথর দেহটি কোন সৎকার ছাড়া ঝুলে থাকে । এক সময় জ্যোতির দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয় কুশিয়ারা নদীতে। জগৎজ্যোতির বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের কাহিনী হবিগঞ্জের সেই অঞ্চলের মানুষের কাছে এখনে মুখে মুখে ফেরে।
তার অসীম সাহসিকতার প্রতি সম্মান জানিয়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাকেই প্রথম মরণোত্তর 'বীরশ্রেষ্ঠ' খেতাব ঘোষণা করেন। ১৯৭২ সালে তাকে পুনরায় বীরবিক্রম খেতাব প্রদান করা হয় তাকে। কিন্তু ঘোষণা দিয়েও কেন জগৎজ্যোতিকে মরণোত্তর সর্বোচ্চ খেতাব 'বীরশ্রেষ্ঠ'র সম্মানে ভূষিত করা হলো না_ সে প্রশ্ন আজো রয়ে গেছে।
কিন্তু আজ তাকে প্রাপ্যসম্মান দেওয়া হল না
লেখাটি একেই সাথে আমার সাইটে প্রকাশিত হয়েছে
Click This Link
"http://www.mainuddinbd.com/2010/12/blog-post_04.html"
তথ্যসূত্র:
উইকিমিডিয়া, হবিগঞ্জ জেলা তথ্য বাতায়ন, ভাটি অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ এবং দাস পার্টি,অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি,
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:০০