বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত আমার কন্যারত্ন নিজের লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে ; প্রথম ২/৩ মাস ঢিলে ঢালা ভাব । ডিসেম্বর শেষ হয়ে আসতেই তার টনক নড়ে , উপার্জন করা চাই --ফেব্রুয়ারীতে বই মেলা । গতবার থেকে সে তার ভাইয়ার গৃহশিক্ষিকা । বেতন ছিল সেবার ৫০ টাকা প্রতি মাসে । ভাইয়াকে পড়ানো মানে হল দুজনের একসাথে ব্যস্ত থাকা , নালিশের ঝুড়ি ঢাকনা বন্ধ তখন । মাঝখান থেকে আপুর সন্মান রক্ষার্থে ভাইয়া লেখা পড়া ঠিকমত করে ফেলে । গতবার মেয়ের দুমাসের বেতন ১০০ টাকা , অগ্রীম ৫০ টাকা ; মোট ১৫০ হয়েছিল । বইমেলায় গিয়ে বই দেখে আর কষ্ট করে কাঁধের ঝোলানো ব্যাগের তলায় পড়ে থাকা ছোট্ট পার্স বের করে করে পয়সা গোনে । কটা বই কেনার পরে ১০ টাকা অবশিষ্ট । মনটা খারাপ দেখে এক বিক্রেতা নিজেই মন খারাপ করে ফেলে ; তাকে আস্বস্থ করি যে বই আমি দেব কিনে , তবে পরে , চোখের ক্ষুধা মিটে গেলে । শেষ পর্যন্ত মেয়ে আমার ৬৯০ টাকার বই কেনে , বহনের কষ্টে বন্ধ করে কেনা । আমার নিজের কেনা বইয়ের ভার বহনে কষ্ট হতে থাকলে ( বিশেষ করে সবশেষে পাওয়া বুখারী শরীফের ১০ খন্ড একসাথে ) বাড়ির পথ ধরি । এর মধ্যে খুচরো টাকার প্রয়োজন পড়লে ওর ১০ টাকা নিয়েছিলাম । ফেরার পথে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল , আম্মু , তোমার কাছে আমি ১০ টাকা পাই , মনে করে দেবে কিন্তু ফিরিয়ে ; ভাবুন একবার , ৬৯০-১৫০= ৫৪০ টাকা দিয়েও ১০ টাকার দেনা শোধ হয় না ।
এবারে বেতন বাড়িয়ে ১০০ টাকা করা হয়েছিল । ২ মাসের বেতন নিয়ে তৈরী ছিল । আমার সময় হচ্ছিল না , পরে ২৫শে ফেব্রুয়ারী ওদের ছুটি ছিল স্কুল তাই সেদিন যাবার কথা বই মেলায় । ছেলেকে আমি কিনে দেব বই , তেমন কথা ছিল ।
তারপরে সব লন্ড ভন্ড করে দিল শ্বাপদেরা । ভুলে গেলাম বইমেলার কথা ! আমার এক বান্ধবী আগেই তার ছেলেদের নিয়ে ঘুরে এসেছে মেলা । তার পিতৃকূল -শ্বশুর কূলে মেয়ে বাচ্চা নেই , আমার মেয়ে আদরের খুব ।সে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল যেন ২৭ বা ২৮শে ফেব্রুয়ারী নিয়ে যাই মেলায় । পরে না পেরে মনে করিয়ে দিলাম যে আমার মেয়ের সহপাঠির বাবা নিহত হয়েছেন , ফোনে এটা শুনে সে চুপ করে গেল ।তারপরেও মেয়েকে বলেছিলাম --সে যেতে চাইলে নিয়ে যেতে পারবো ,তবে ওর সহপাঠি ছেলেটার কথা যেন মনে রাখে । আমার মেয়ে যেতে রাজী হল না বইমেলায় । বলল , আম্মু ,কিনে দিও দোকান থেকে বই ।
আজ মেয়ের সাথে কথা হল , বললাম তোমার উপার্জনে বই কেনা হয়নি , আর কতজনের কত ক্ষতি হয়ে গিয়েছে এবার পিলখানাতে ( আমি আর ওদের বাবা ওদের সামনে বীভৎস ঘটনাগুলো সাধারনত আলোচনা করিনা ) , তোমার টাকাগুলো ওদের মধ্যে যারা ভুক্তভোগী তাদের জন্য কাজে লাগানো ভাল । মেয়ে সেটাতে রাজী হলো ; তারপরেও জানতে চেয়েছিলাম সে নিজে থেকে দিলে আমি নেব , নাহলে নয় । বলল , হ্যা আম্মু , এবার আমি বই চাই না , তুমি আমার টাকাটা ওদের জন্য কাজে লাগাও ।
আমার লক্ষী সোনা চাঁদের কনা , আমার রত্ন । জানিনা বড় হতে হতে কেমন হবে , তবে আমি আপাতত: ধন্য এমন সন্তানের মা হতে পেরে ।