somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যেভাবে আমেরিকা হোয়াইটওয়াশ করতে চেয়েছে মে দিবসকে...

০১ লা মে, ২০১৬ দুপুর ২:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার যখন ১১ বছর বয়স আমি তখন শিকাগোতে। মে মাসের স্কুল এসেম্বলি উপলক্ষ্যে কিছু করার দায়িত্ব পড়ে আমাদের ক্লাস ফাইভের উপর। আমাদের টিচার যখন মে মাসে কোনো ছুটির দিন আছে কিনা এই ভেবে দিশেহারা, তখন আমি কোন কিছু না ভেবেই ‘মে দিবস’এর কথা বলি। “না, পল”, তিনি খুব কঠোরভাবে নিষেধ করেন। “মে দিবস শুধুইমাত্র কম্যুনিস্ট দেশগুলোতে উদযাপিত হয়। আমরা কম্যুনিস্ট হলিডে নিয়ে কোন নাটক মঞ্চায়ন করতে পারিনা।”

মিস বার্থ অবশ্যই ভুল ছিলেন। শুধুমাত্র আমেরিকা ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মে দিবস উদযাপন করা হয়- যদিও এই দিনটি ১৮৮৬ সালের হেমার্কেট রায়টের স্মরণে উদযাপিত; যা ঘটেছিল খোদ শিকাগোতেই। কিন্তু আমেরিকা বছরের পর বছর ধরে আমাদের চেতনা ও সংস্কৃতি থেকে “মে দিবসকে” উদ্দেশ্যমূলকভাবেই নিশ্চিহ্ন করে গেছে।

এমনকি শিকাগোতেও আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র সেই হেমার্কেট স্কয়ার জায়গাটিকে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব- কারন এর কোন অস্তিত্বই এখন আর নেই। আজ যদি আমেরিকায় বিক্ষোভকারীরা সমগ্র দেশব্যাপী বৃহদাকারে মে দিবসের সমাবেশ করতে চায় তারা একটি ভালো সমস্যায় পড়বে। তা হলো, বামপন্থী অ্যাক্টিভিস্টদের বৃত্তের বাইরে খুব নগণ্য সংখ্যক আমেরিকানই আছে যারা মে দিবস সম্পর্কে জানে। ওয়াল স্ট্রীট সমস্যা কিংবা নিজেদের অর্থনৈতিক দুর্দশার প্রতিবাদে আমেরিকার জনগণ পথে নামতে পারে; কিন্তু মে দিবসের মতো কিছুর জন্য তাদের টেনে আনা যাবেনা যার কথা তারা কখনো শুনেনি- এমনকি স্কুল পর্যায়েও নয়।

স্কুল নাটকের জন্য ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া আমি যখন মে দিবসের কথা আমার শিক্ষককে বলেছিলাম, তখন আমি কোন রাজনৈতিক ঘরানার ইঁচড়ে পাকা শিশু ছিলাম না। আমি খুব অস্পষ্টভাবেই মে দিবস সম্পর্কে শুনেছিলাম। আমি জানতাম এটি নবান্ন উৎসবের মতই একটা দিন যেখানে তুমি ঝুড়িভর্তি ফুল নিয়ে বসন্ত উদযাপন করতে পারো। শ্রমজীবিদের অধিকার নিয়ে বামপন্থীদের আন্দোলনই যে মে দিবস- এটা ছিল আমার ধারনার বাইরে। কিন্তু আমাদের কি উচিৎ ছিলনা স্কুলেই এটা সম্পর্কে জানা, কারন হেমার্কেট বিপ্লব ঘটেইছিল এই শিকাগোতেই?

৪ঠা মে, ১৮৮৬ তে শ্রমিক ইউনিয়নের উদ্যোগে আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবীতে কর্মীগন শিকাগো হেমার্কেট স্কয়ারে একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে। রাত সাড়ে দশটার দিকে সেই সমাবেশে একটা বোমা বিস্ফোরণ হয় যাতে সাতজন পুলিশ অফিসার এবং চারজন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। কেউই জানেনা বোমা কে মেরেছে, কিন্তু পুলিশ সন্দেহের উপর ভিত্তি করে আটজন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করে। সেই আটজনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এক ভুয়া বিচারে। এবং তাদের চারজনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল (একজন জেলেই আত্মহত্যা করেছিল)।

হেমার্কেট দাঙ্গা এবং তার ফলাফল সারা বিশ্বের শ্রমিক সম্প্রদায় ও তাদের সমর্থকদের ক্রুদ্ধ করে তোলে। তারা শহীদদের স্মরণে এবং শ্রমজীবিদের জীবনসংগ্রামকে শ্রদ্ধা জানিয়ে মে দিবস পালন করা শুরু করে।

আজ বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে মে দিবস পালিত হয়। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং প্রাচ্যের সাম্যবাদী রাষ্ট্রগুলোতেই নয়, যুক্তরাজ্য ও স্পেনের মতন দেশেও এই মে দিবসকে ছুটির দিন হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানেও মে দিবসকে ছুটির দিন বলে ঘোষনা করা হয়। এই দেশগুলোতে কর্মজীবিরা সাধারনত ছুটি পায় এবং ন্যায্য মজুরি ও আট ঘণ্টা কর্মদিবসের জন্য যে অমর সংগ্রাম হয়েছিল তা উদযাপন করে।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে কখনওই মে দিবসের মর্যাদা পায়নি। ১৮৯৪ সালে Pullman Strike (এটিও শিকাগোতেই হয়েছিল) সংঘটিত হওয়ার পর, প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবারকে শ্রমদিবসের মর্যাদা দিয়ে জাতীয় ছুটির দিন ঘোষণা করেন। আমেরিকায় ইচ্ছাকৃতভাবেই এই শ্রমদিবসটিকে নির্বাচিত করা হয় মে দিবসের বদলে; কারন তাদের ভয় ছিল- হেমার্কেট রায়টকে স্মরণীয় করা রাখলে তা সাম্যবাদকে প্রশ্রয় দেয়ার সমতুল্য হবে। ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট ড্যুইট ঈজেনহোভার মে দিবসকে আরো একটু অপসারিত করে দেয় ১লা মে-কে ‘বিশ্বস্ততা দিবস’ বা Loyalty Day ঘোষণা করে। এবং ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট রোন্যাল্ড রিগ্যান ১লা মে-কে অভিহিত করেন ‘আইন দিবস’ বা Law Day হিসেবে।

আমেরিকায় যদি তুমি বামপন্থী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান না হও, তাহলে তুমি কোনভাবেই মে দিবস সম্পর্কে জানতে পারবেনা। আমাদের ঐদিন স্কুল বন্ধ থাকেনি, এবং অবশ্যই ক্লাস ফাইভে আমরা মে দিবস উপলক্ষ্যে কোন নাটক মঞ্চস্থ করিনি। আর হেমার্কেট স্কয়ার? আমি ১৮ বছর শিকাগোতে বসবাস করেছি। কিন্তু সত্যি বলছি, সে এলাকায় মে দিবস কেন্দ্রিক আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

আমি মাঝে মাঝে নিজেকে মিস বার্থ-এর স্থানে কল্পনা করি। ফিফথ গ্রেডের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি অবশ্যই আমার শিক্ষার্থীদের মে দিবসের মাহাত্ম্য নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করতে উদ্বুদ্ধ করতাম। যেখানে তারা হেমার্কেট বিপ্লবকে নতুন করে রুপদান করতো, সেই আটজন বিপ্লবীকে আবারো মূর্ত করে তুলতো। বাচ্চারা জানতে পারতো শিকাগোর মর্যাদাপূর্ণ শ্রমের ইতিহাস আর জানতে পারতো এই মহান বিপ্লবের ফলশ্রুতিতেই আজ আমরা লাভ করেছি শ্রম অধিকার।

নাটকটি মঞ্চস্থ হবার পর সেই ক্ষুদে শিল্পীরা দর্শকদের দিকে ঘুরে দাঁড়াতো এবং গাইতো “Solidarity Forever”। এবং তাদের পরিবেশনা শেষ করার পূর্বমুহূর্তে সকলের উদ্দেশ্যে উদাত্ত আহ্বান জানাতো- “দুনিয়ার মজুর এক হও! শোষণ এবং বঞ্চনার শেকল ছাড়া তোমাদের আর হারানোর কিছুই নেই!”





মূল লেখক Paul Hogarth-এর লেখা থেকে ভাবানুবাদকৃত এবং কিছুটা সংক্ষেপিত।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৬ রাত ১২:১৩
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×