সারা বিশ্বে আজ নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর সমঅধিকার, কর্মক্ষেত্রে অধিকার, ভোটাধিকার আর লৈঙ্গিক বৈষম্য রোধের এই আন্দোলন যা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে তা আজ শতবর্ষ পূর্ণ করলো। নারী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য-
“Equality for women is progress for all.”
নারী দিবস নিয়ে আলোচনার আগে চলুন ঘুরে আসি “বেগম রোকেয়া” এর “অবরোধবাসিনী” হতে। আমাদের বঙ্গদেশীও নারীদের অবস্থা কি রকম ছিল তার এক মর্মান্তিক দলিল এই বইটি।
“আমার দূর সম্পরকিয়া এক মামী শাশুড়ি ভাগলপুর হইতে পাটনা যাইতেছিলেন; সঙ্গে মাত্র একজন পরিচালিকা। কিউল ষ্টেশনে ট্রেন বদল করিতে হয়। মামানী সাহেবা অপর ট্রেনে উঠিবার সময় তাহার প্রকাণ্ড বোরকায় জড়াইয়া ট্রেন ও প্লাটফর্ম এর মাঝখানে পড়িয়া গেলেন। ষ্টেশনে সে সময় মামানীর চাকরানি ছাড়া অপর কোন স্ত্রীলোক ছিল না। কুলিরা তাড়াতাড়ি তাহাকে ধরিয়া তুলিতে অগ্রসর হওয়ায় চাকরানী দোহাই দিয়া নিষেধ করিল- “ খবরদার কেহ বিবি সাহেবার গায়ে হাত দিও না”। সে একা অনেক টানাটানি করিয়া কিছুতেই তাঁহাকে তুলিতে পারিল না। ট্রেন ছাড়িয়া দিল।
ট্রেনের সংঘর্ষে মামানী সাহেবা ছিন্নভিন্ন হইয়া গেলেন,- কোথায় তাহার বোরকা আর কোথায় তিনি। ষ্টেশন ভরা লোক সবিস্ময়ে দাঁড়াইয়া এই লোমহর্ষক ব্যাপার দেখিল- কেহ তাঁহার সাহায্য করিতে অনুমতি পাইল না। পরে তাঁহার চূর্ণপ্রায় দেহ একটা গুদামে রাখা হইলো; তাঁহার চাকরানী প্রাণপণে বিনাইয়া কাঁদিল আর তাঁহাকে বাতাস করিতে থাকিল। এই অবস্থায় ১১ ঘণ্টা অতিবাহিত হইবার পর তিনি দেহত্যাগ করিলেন। কি ভীষণ মৃত্যু।“
এখন সেই পুরনো সময় আর নেই, সময় বদলেছে। নারী এখন আর অবরোধবাসিনী নেই বরং তারা এগিয়ে চলছে মুক্তির পথে। কি শিক্ষায়, কি চাকরিতে, কি ব্যাবসা-বাণিজ্য অথবা উদ্যোক্তা হিসেবে- সকল ক্ষেত্রেই আমাদের দেশের নারীরা আজ মেলছে সাফল্যর ডানা।
১৯১০ সালে জার্মান ডেমোক্র্যাটিক দল এর নেত্রী “ক্লারা জেটকিন” কর্মজীবী নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সভায় যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন – নারীর সমঅধিকার, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য রোধ এবং ভোটাধিকার এর তা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। ক্লারা জেটকিনই সর্বপ্রথম সেই সভাতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব করেন। তখন ১৭ টি দেশের প্রায় ১০০ জন নারী সেই প্রস্তাব কে স্বাগত জানান এবং সেই বছরই ১৯ শে মার্চ পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ১৯১৪ সালে প্রথম ৮ ই মার্চ সারাবিশ্বে একযোগে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের বহু দেশে দাপ্তরিকভাবে নারী দিবস স্বীকৃতি লাভ করে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, বেলারুশ, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া, ইউক্রেন, ভিয়েতনাম সহ অনেক দেশে এ দিন সরকারী ছুটি।
বহু প্রতিকূলতা শর্তেও আমাদের বাংলাদেশের নারীরা আজ এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে। আমাদের দেশের নারীই আজ এভারেস্ট জয় করছে, নিয়ে আসছে অস্কার, সফলতা পাচ্ছে বিভিন্ন দেশিও এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়। দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী থেকে শুরু করে সরকারের সকল ক্ষেত্রেই আজ নারীরা সফলতার সঙ্গে কাজ করছে। সকল ক্ষেত্রেই আজ নারীর সফলতার জয়জয়কার।
কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই এই আমাদের সমাজেরই কিছু নারী এখনও সেই “মানসিক দাসত্ব” তে ভোগে। তারা ধরেই নিয়েছে তারা যেহেতু নারী সেহেতু তাদের বঞ্চনা সয়েই যেতে হবে। নারীরা দয়া করে আপনারা এই শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে আসুন। আপনাদের মনে রাখতে হবে “To be taken as granted.” বলে কিছু নেই এবং আপনাকেই এই শৃঙ্খল ভাঙতে হবে। এদেশের অনেক নারীরই মনোজগতে যে “Princess Syndrome” কাজ করে তা ভেঙ্গে যোদ্ধা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে। সমাজের সকল প্রতিকূলতা, সকল বাধা পেরিয়ে আপনাকে যোদ্ধা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে অধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে।
“Remember, you are a warrior against all the social barriers for women empowerment…Go and get it.”
জয়তু নারী,
সকল নারীকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুভেচ্ছা।