১) ছোটবেলায় কম বেশি আমরা সবাই-ই গেমসের দোকানে গিয়ে গেম খেলেছি। সিস্টেমটা তো জানেনই, আপনি নিজের টাকা খরচ করে সেই মেশিনে গেম খেলবেন, মজা নিবেন। এখন মনে করুন, আমিও সেইরকম একটা মেশিন বসালাম যার কাজ হবে যেই সে মেশিনটা টাকা দিয়ে অন করবে তাকে আঘাত করা। এখন পাঠকের কাছে আমার প্রশ্ন হল, ধরুন আপনি স্বেচ্ছায় নিজের টাকা খরচ করে সে মেশিন অন করলেন এবং সেটার দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হলেন; এখানে দোষটা কার? আপনার না মেশিনের?
এখন আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আমি এমন মেশিন কেন বানাব, আমি বলব “আমার নিজস্ব একটা কারন নিশ্চই আছে”। কিন্তু আগে যেটা জানা দরকার সেটা হল, আপনি আঘাতপ্রাপ্ত হবেন জেনেও কেন সে মেশিনে নিজের টাকা ঢাললেন? আর আঘাতপ্রাপ্তই বা কেন হতে গেলেন? আর আঘাত প্রাপ্ত হওয়ার পর আপনার কি করনীয়? লোকজন নিয়ে মেশিন ভাঙতে আসবেন? নাকি সে পথে টাকা নষ্ট বন্ধ করে নিজের কাজে মনোযোগ দিবেন? পাঠকের জবাবের অপেক্ষায় রইলাম।
২) আপনাকে যদি আমি প্রশ্ন করি, “আপনার কোন ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান ভাল?”, আপনি কি জবাব দিবেন? নিশ্চই আপনি যে ধর্মে বিশ্বাসী, সে ধর্মের কথা বলাটাই স্বাভাবিক। অথবা আপনি যদি অনেক পড়ুয়া হন আর নিজের ধর্মগ্রন্থের বাইরে অন্য ধর্মগ্রন্থগুলোতেও আগ্রহ থাকে, তাহলে হয়ত আপনি সেগুলোর কথাও বলবেন; সেটাই স্বাভাবিক, তাই না? তাহলে আপনি যে ধর্মের বা যে ধর্ম নিয়ে আপনি পড়াশুনা করেন, সে ধর্মের ভুলত্রুটিগুলোই তো আপনার চোখে পড়বে। যে ধর্মে আপনার আগ্রহ নাই বা পড়াশুনা করেন না, সেটার ভুলত্রুটি আপনার চোখে পড়ার তো কারন নেই কারন ঐসব ধর্মের ব্যাপারে আপনি জানেন না বা আপনার জ্ঞান সীমিত। আমাদের একটা সাধারণ সমস্যা হল, আমরা যা বিশ্বাস করি তা খুব অন্ধ ভাবেই বিশ্বাস করি, কোন সমস্যা চোখে পরলেও এড়িয়ে যাই বা প্রশ্ন করতে ভয় পাই; কেন? প্রতিটা ধর্মের প্রতিটা নির্দেশের পেছনে কিছু না কিছু কারন থাকে। হয়ত বা হতে পারে আপনি জানেন না কারণটা কি, তবে অন্য কেউ নিশ্চই জানে; তাকে খুঁজে বের করুন, জিজ্ঞেস করুন, জানার চেষ্টা করুন। কিন্তু আমরা সে আগ্রহ দেখাই না কারন আমরা অন্ধভক্ত হয়ে থাকাতেই বেশি নিরাপদ অনুভব করি, কারন আমরা ভয় পাই। আমাদের সাহসের অভাবটা কোথায়? যদি কেউ কিছু বলে! যদি কেউ আমার বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তুলে! সেখানেই ভয়! আরে ভাই, প্রশ্ন তুললে তুলুক না। আপনি যে জিনিস বিশ্বাস করবেন তার ভিত্তিটা কি সেটা জানবেন না কেন? সেটা কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা, কোনটা মিথ আর কোনটা ফ্যাক্ট, সেটা জানার অধিকার তো আপনার আছেই। আর আপনার বিশ্বাস কতটা গাড় বা ঠুনকো সেটা নিশ্চই অন্যরা আপনার বিশ্বাস নিয়ে কি ভাবছে না ভাবছে তার উপর নির্ভর করবে না।
এই প্রশ্ন তোলার সাহসের অভাব যাদের মধ্যে আছে তাদেরকেই আমরা বলি ‘ধর্মান্ধ’, আর যারা খুঁতটা নিয়ে প্রশ্ন করার মত সাহস অর্জন করতে পেরেছে, প্রশ্ন করছে তাদেরকে আমরা বলছি ‘নাস্তিক’।
“নির্বাক বন্ধুর চেয়ে বাঁচাল শত্রুও ভাল” এই কথার সাথে তো আমরা সবাই পরিচিত। আপনার শত্রু যখন আপনার ত্রুটিগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, তখনই তো আপনি আপনার ত্রুটি তার কাছে ব্যাখ্যা করার সুযোগ পেলেন বা সে ত্রুটি সমাধান করে ভাল মানুষ হওয়ার সুযোগ পেলেন, তাই না? নাকি আপনার ত্রুটি কেন চোখে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিল সে কারনে আপনি তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার ফন্দি আঁটবেন? আপনি মিথ্যা বলবেন, অথচ কেউ আপনাকে প্রশ্ন করতে পারবে না আপনি কেন মিথ্যা বলছেন! আপনার মিথ্যাটাকে যদি সত্যি প্রমাণ করার মত সাহস, যুক্তি বা ধৈর্য্য না থাকে, তাহলে তো সেটা আপনারই সমস্যা, প্রশ্নকর্তার না। এটা শুধু মাত্র একটা জিনিসই প্রমাণ করে, আপনি যা বলেছেন সেটা পুরোটাই মিথ্যা। আর প্রশ্ন না করে যা শুনবেন তাই যদি বিশ্বাসে আগ্রহী হন, সেক্ষেত্রে আপনার মাদ্রাসায় পড়া উচিৎ; সেখানে সন্দেহ/প্রশ্নের কোন স্থান নেই।
৩) আমরা যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করি তারা সবাই নিশ্চই নিচের দুটি ঘটনার একটির সাথে হলেও পরিচিতঃ
প্রথম ঘটনাটি আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, “একবার এক বিধর্মী লোক প্রচণ্ড রোদে মরুভূমির মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। এমন সময় সে একটি কুকুর দেখতে পেল যে তৃষ্ণায় এতই কাতর ছিল যে ভেজা মাটি খেয়ে তার তৃষ্ণা মেটানোর চেষ্টা করছে। কুকুরটির এই অবস্থা দেখে লোকটির খুব মায়া হল এবং তিনি একটি কুয়া খুঁজে বের করেন এবং সেখান থেকে তার জুতা খুলে তাতে পানি পুরিয়ে এনে সেই কুকুরের তৃষ্ণা মেটায়। তার এই মহানুভাবতার কারনে আল্লাহ্ তার সারা জীবনের সকল গুনাহ মাফ করে দেন।” [বুখারি এবং মুসলিম]
দ্বিতীয় ঘটনাটি হল “একবার বনি ইসরায়েলের এক পতিতা একবার রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তৃষ্ণায় মৃতপ্রায় এক কুকুর দেখতে পেল। ওই তৃষ্ণার্ত কুকুরের তৃষ্ণা মেটাতে পতিতা নিজের মোজা খুলে একটি কুয়ায় নেমে সেটি পানিতে ভিজিয়ে এনে কুকুরের তৃষ্ণা মেটায়। তার এই কাজের কারনে আল্লাহ্ তার সারা জীবনের গুনাহ মাফ করে দেন এবং তাকে বেহেশত দান করেন” [রিয়াদ-উস-সালেহিনঃ অধ্যায় ১৩]
৪) এবার আসি আসল কথায়। ধর্মের বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখার কারনে আজ ওয়াসিকুর রহমান নামের একজনকে আজ কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। এটা অবশ্যই প্রথম না, এর আগে গত ফেব্রুয়ারি (২০১৫) মাসে লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে, ২০১৩ এর ফেব্রুয়ারিতে রাজিব হায়দারকে, ২০০৪ এর অগাস্টে লেখক হুমায়ূন আজাদকে খুন করা হয় ‘ইসলাম বিরুদ্ধ’ লেখা প্রকাশের কারনে বা ধর্মের খুঁটিনাটি খুঁত নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারনে।
(i) নাস্তিক অপবাদে যাদের খুন করা হচ্ছে তাদের কেউ বই লিখেন, কেউ বা ব্লগে লিখেন তাদের নিজস্ব মতামত। তারা কেউ কিন্তু আপনাকে জোড় করছে না তাদের লেখা পড়ার জন্য। আপনি জানেন তারা ধর্মের ত্রুটি নিয়ে কথা বলেন, এবং সেটা সহ্য করার ক্ষমতা আপনার নেই। এইখানে আমার লেখার প্রথম অংশের উদাহরণটা টানি, আপনার ধর্মানূভূতি আঘাত লাগতে পারে জেনেও কেন আপনি তার লেখা বই নিজের পয়সায় কিনে, বা তার লেখা ব্লগ নিজের পয়সায় কেনা মেগাবাইট খরচ করে পড়তে গেলেন? সে লেখা আপনাকে কেউ জোড় করে পড়তে বলছে না, আপনি চাইলেই সেটাকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারছেন। কিন্তু সেটা না করে স্বেচ্ছায় গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হলে সেখানে লেখকের দোষটা কোথায়? সে তার সন্দেহ প্রকাশ করেছে, আপনি পারলে সে সন্দেহ দূর করুন। সেটা না করে সন্দেহ প্রকাশকারীকেই দূর করে দেয়াটা তো মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলে দেয়ার মত ব্যাপার হয়ে গেল। তাই নয় কি?
(ii) প্রতিটা ক্লাসেই দুই ধরনের শিক্ষার্থী থাকে; একদল কোন প্রশ্ন না করেই শিক্ষক যা পড়ায় তা মুখস্ত করে, আরেকদল প্রতিটা কথার পেছনের কারন খোঁজে এবং এরাই সংখ্যায় নগণ্য। আবার প্রতিটা স্কুলেই দুই ধরনের শিক্ষক থাকেন; একদল প্রতিটা কারন ব্যাখ্যা করাতে চান না (বা কারন জানেন না), আরেকদল ধৈর্য্য ধরে প্রতিটা কারন ব্যাখ্যা করেন, না জানলে আগে জেনে নেন তারপর জানান এবং সংখ্যায় কিন্তু এই ধরনের শিক্ষকদের সংখ্যাই সবচেয়ে নগণ্য।
আমার এই লেখার দ্বিতীয় অংশে বলেছি, সবাই ধর্মে অন্ধবিশ্বাস করে না। বেশিরভাগ মানুষ যেটা কারন না জেনেই বিশ্বাস করছেন, দু‘একজন হয়ত সেটার কারন খোঁজায় ব্যস্ত। হয়ত বা তার প্রশ্নের সদুত্তর না পেলে একসময় সে অবিশ্বাস করতে শুরু করবে। এখন কেউ যদি তার প্রশ্নের সদুত্তর না পেয়ে ধর্মে অবিশ্বাসী হয়ে যায়, তাহলে এখানে দোষটা কার? যে অবিশ্বাসী হয়ে গেছে তার, নাকি আমরা যারা তার জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে পারছি না তারা? কোন ছাত্র যদি কোন প্রশ্ন নিয়ে শিক্ষকের শরণাপন্ন হয়েও উত্তর না পায়, তাহলে সেখানে আসল দোষটা কার? নিজেকে একটু জিজ্ঞেস করুন, উত্তর পেয়ে যাবেন।
(iii) হুমায়ূন আজাদ, রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াসিকুর রহমান... এদের খুন করার একমাত্র কারন হল এরা নাকি নাস্তিক। প্রথমত, উনারা নাস্তিক না কি আস্তিক সেটা আপনি ঠিক করার কে? নাস্তিকতা বা আস্তিকতা হল মনের ব্যাপার, আর ক’টা লেখা পড়েই আপনি বুঝে গেলেন তার মনের অবস্থা?! ধর্মের কিছু খুঁত আপনার চোখের সামনে তুলে ধরায় যদি আপনার ধর্মীয়বোধে আঘাত করে তাহলে বলতে হবে আপনার ধর্মীয় বোধ খুবই ঠুনকো। এতটাই ঠুনকো যে আপনি সে খুঁত ব্যাখ্যা করার তো করছেনই না, বরং আপনার ধর্মে যেটা হারাম (মানুষ খুন করা) সেটা করার করার পরিকল্পনা করছেন, বা সেটায় সায় দিচ্ছেন। এখন তো তাহলে আপনার ঈমান নিয়ে আমার প্রশ্ন জাগছে! আমার এই লেখার তৃতীয় অংশে আমি হাদিসে বর্ণিত দু’টা কাহিনী তুলে ধরেছি। দুটো কাহিনীর দুজনের একজনও কিন্তু মুসলমান বা ইসলাম ধর্মের অনুসারি না। যারা ইসলাম রক্ষার ‘নাস্তিক’ বিনাশে নেমেছেন তাদের মতে এদের একজনও বেহেশত পাওয়া বা গুনাহ মাফের যোগ্য নয়। কিন্তু কিভাবে পেল তা তো নিশ্চই ইতিমধ্যে জেনে গেছেন। নাকি এটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না কারন এটা আপনার চিন্তা-ধারার বিপরীত? আপনি দিনে ৫ ওয়াক্ত (বা তারও বেশি) নামাজ আদায় করে মানুষ খুন (হারাম কাজ) করে ‘বেহেশত’ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু আপনি কতটুকু নিশ্চিত যে আপনি বেহেশত পাচ্ছেন? অথবা এইটাই বা কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে শুধুমাত্র ধর্মের খুঁত তুলে ধরার কারনে একজন মানুষ সৃষ্টিকর্তার অপ্রিয় পাত্রে পরিণত হয়েছেন এবং তাকে খুন করা আপনার জন্য ফরজ হয়ে গিয়েছে?! আপনি যাকে নাস্তিক বলে খুনের পরিকল্পনায় ব্যস্ত সে যে সৃষ্টিকর্তার কাছে আপনার চেয়েও বেশি প্রিয় নয় সেটা আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন? একবার চিন্তা করে দেখুন তো, যে ব্যক্তিকে আপনি নাস্তিক অপবাদে খুন করেছেন তাকে হয়ত সৃষ্টিকর্তা কোন ভাল কাজের জন্য পুরস্কার হিসেবে সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। আপনার পক্ষে সেটা জানা সম্ভব নয়। নাকি এখন আবার দাবি করে বসবেন, সম্ভব?! আল্লাহ্ কখন কাকে কোন কাজের জন্য তার সব গুনাহ মাফ করে দিবেন, সেটা কেউ জানেন না। আর আপনি যদি দাবি করে বসেন আপনি জানেন, তাহলে আপনার ঈমান সম্পর্কে যে কারোরই প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক এবং আপনাকেও বিনাশ করা উচিৎ।
আরেকটা ব্যাপার হল, প্রতিটা মুসলিমের জন্য তার ধর্মের দাওয়াত দেয়াটা ফরজ। এখন আমার প্রশ্ন হল, আপনি যদি সব অবিশ্বাসীকে নাস্তিক অপবাদে খুন করে ফেলেন তাহলে কার কাছে ঈমানের দাওয়াত দিবেন? যে জানে তাকে গিয়ে আবার জানাবেন? যদি এভাবে অবিশ্বাসী নির্মূল করতে থাকেন তাহলে তো একসময় সে পথে আগানো ছাড়া আর কোন উপায় দেখতে পাচ্ছি না।
যা হোক! অনেক প্রশ্নই করেছি, অনেক জ্ঞান বিতরন হয়েছে। জানি না ক’টার উত্তর আমি পাব বা উত্তরের বদলে ক’টা গালি আমার জন্য বরাদ্দ রয়েছে। তবে এইটুকুই বলি, কেউ যদি আপনার একটা খুঁত চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তাহলে তার উপর চড়াও না হয়ে বরং সেটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করুন; না পারলে সেটা মেনে নিন, তার আগে শুধরানর চেষ্টা করুন। প্রশ্ন করাটা বা ত্রুটি নিয়ে কথা বলাটা যদি অবিশ্বাসীর লক্ষণ হয় তাহলে পৃথিবীর প্রতিটা ভাল শিক্ষার্থীই পড়াশুনায় অবিশ্বাসী।
ভাল থাকবেন
© কপিরাইটঃ আমিরুল ইসলাম লিসান
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১১:৩০