স্বপ্ন দেখতে আমরা কে না ভালবাসি?! আপনার মত পৃথিবীর সব মানুষই স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। একজন সুস্থ সাধারণ মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখবেন এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কথা হচ্ছে স্বপ্নের ব্যাপারে আমরা কতটুকু জানি?! ব্যক্তিগত ভাবে এই ব্লগটি লেখার আগ পর্যন্ত স্বপ্নের ব্যাপারে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত ছিল। কিন্তু শেষ কিছুদিন স্বপ্নের ব্যাপারে ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে অনেক কিছুই জানতে পেরেছি এবং সেটা আপনাদের সাথে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছি না, তাই আপনাদের জন্য আমার এই ব্লগপোস্ট...
০১) স্বপ্নের ৯০ শতাংশই আমরা ভুলে যাই
আমরা প্রায় প্রতিদিনই ঘুমে স্বপ্ন দেখি। কিন্তু ঘুম থেকে উঠার পর আমাদের আর মনে থাকে না কি দেখেছি স্বপ্নে, আর যদি মনে থাকেও তবে তা হয় স্বপ্নের খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশ। ঘুম থেকে জেগে উঠার ৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা আমাদের স্বপ্নের অর্ধেকটাই ভুলে যাই, আর ১০ মিনিটের মধ্যেই ৯০ শতাংশই gone এবং এটাই স্বাভাবিক।
০২) অন্ধ মানুষেরাও স্বপ্ন দেখে
জন্মান্ধ এবং যেসব মানুষ জন্মের পর অন্ধ হয়ে যান তারা উভয়েই স্বপ্ন দেখেন। তবে এই দুই ধরনের মানুষের স্বপ্ন দেখার মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেসব মানুষ জন্মের পর অন্ধ হয় তারাও অন্যান্য স্বাভাবিক মানুষের মত স্বপ্নে ছবি দেখেন। কিন্তু যারা জন্মান্ধ তারা স্বপ্নে কোন ছবি দেখেন না, তার পরিবর্তে তাদের স্বপ্ন হয় শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ এবং অনুভুতির সংমিশ্রণে। যদিও আমাদের অনেকের মধ্যেই একটা ভুল ধারনা ছিল যে জন্মান্ধরা অন্যান্য স্বাভাবিক মানুষের মতই স্বপ্নে ছবি দেখেন।
০৩) সব মানুষই স্বপ্ন দেখে
সব মানুষই স্বপ্ন দেখে, সে যেখানেই থাকুক। যদি একজন মানুষের মারাত্মক কোন মানসিক সমস্যা না থাকে, তাহলে তারা জন্য স্বপ্ন দেখা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। যদি কোন কারনে আপনার মনে হয় আপনি স্বপ্ন দেখেন না, এর মানে হল আপনি আপনার দেখা স্বপ্নগুলো ভুলে যাচ্ছেন। তবে এটা নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, স্বপ্ন ভুলে যাওয়া খুব একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
০৪) স্বপ্নে আমরা শুধুমাত্র পরিচিত মুখগুলোই দেখি
পৃথিবীতে এমন মানুষ পাওয়া সত্যিই দুষ্কর হবে যে স্বপ্নে নতুন কোন সুন্দর মুখ দেখে একবারের জন্যও ভাবেনি “ইস! এমন কেউ যদি সত্যিই থাকত...”। সত্যি বলতে কি, আপনার স্বপ্নে দেখা সে মানুষটি কিন্তু আসলেই আছে। কি, অবাক হচ্ছেন?! আসলে আমরা স্বপ্নে শুধুমাত্র সেই মুখগুলোই দেখি যেগুলো আমরা আমাদের জীবনে অন্তত একবারের জন্য হলেও দেখেছি। আপনি রাস্তায় প্রতিদিন হাঁটতে হাঁটতে কত মানুষের মুখই তো দেখেন, সেগুলো মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করেন না। আপনি প্রয়োজন বোধ না করলেও আপনার অবচেতন মন কিন্তু সেগুলোকে ঠিকই স্মৃতিভাণ্ডারে জমা করে রাখে। আর স্বপ্নে আপনি সেই মুখগুলোকেই দেখেন আর ভাবেন আপনার মস্তিষ্ক হয়ত সেই মুখগুলো বানিয়ে দেখাচ্ছে। যদি তাই ভেবে থাকেন, তাহলে আপনি ভুল।
০৫) সবাই রঙিন স্বপ্ন দেখেন না
স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন মানুষের মধ্যে ১২ শতাংশ মানুষ সাদা-কালো স্বপ্ন দেখেন, বাকি সবাই জীবনে কোন না কোন সময়ে রঙিন স্বপ্ন দেখেছেন বা দেখেন। ১৯১৫ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চলা বিভিন্ন রিসার্চের সবগুলোতেই দেখা গিয়েছে সিংহভাগ মানুষই সাদা-কালো স্বপ্ন দেখেন, খুব অল্প সংখ্যক মানুষই রঙিন স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু ১৯৬০ সালের পর থেকে রিসার্চের এই ফলাফলে পরিবর্তন আসতে শুরু করে এবং এখন শুধুমাত্র ৪.৪ শতাংশ মানুষ (যাদের বয়স ২৫ বছরের কম) সাদা-কালো রঙের স্বপ্ন দেখেন। তাহলে ১৯৬০-এর পর এমন মানুষের মধ্যে এমন কি পরিবর্তন হয়েছে যে হঠাৎ করে তারা রঙিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করল? সাম্প্রতিক সময়ের এক রিসার্চের পর ধারনা করা হচ্ছে সাদা-কালো টিভি থেকে রঙিন টিভি ব্যাবহারের আধিক্যের সাথে সাথে মানুষের রঙিন স্বপ্ন দেখার আধিক্যর সূচনা হতে পারে।
০৬) স্বপ্ন হল প্রতীকী
আমরা স্বপ্নে যাই দেখি না কেন তা খুব কম সময়েই সরাসরি সেটার সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়; অর্থাৎ স্বপ্ন বেশিরভাগ সময়েই প্রতীকী হয়। স্বপ্ন অনেক নিগুড় প্রতীকী ভাষায় কথা বলে আমরা সেটা বুঝতে পারি না। তাই আপনার স্বপ্ন আপনাকে দেখানোর জন্য যে প্রতীকই ব্যাবহার করুক না কেন, সেটা বেশিরভাগ সময়ই সে প্রতীকের বিষয়ে নয়।
০৭) অনুভূতির প্রকাশ
কখনও যদি স্বপ্ন দেখে ভয়ে বা উৎকণ্ঠায় জেগে আপনি উঠেন, তাহলে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারন পৃথিবীর বেশির মানুষই স্বপ্নে উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠার অনুভূতি এক্সপেরিয়েন্স করেন। আর আপনি যদি খুব চিন্তায় থাকেন এ নিয়ে যে আপনি স্বপ্নে নেতিবাচক জিনিস বেশি দেখছেন, তাহলে আপনি একা নন। কারন পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই আপনার মত নেতিবাচক ঘটনাই স্বপ্নে বেশি দেখেন, ইতিবাচক ঘটনা আমাদের স্বপ্নে খুব কমই আসে।
০৮) এক রাতের ঘুমে আপনি ৪টি থেকে ৭টি স্বপ্ন দেখেন
প্রতিরাতে ঘুমাবার পর জেগে উঠা পর্যন্ত আমরা ৪টি থেকে শুরু করে ৭টি পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে ফেলি। যদিও আমরা ভাবি সারারাতে আমরা একটি মাত্র স্বপ্ন দেখেছি, কিন্তু আসলে তা নয়। আমরা একাধিক স্বপ্ন দেখি এবং সে কারনেই আমাদের মাঝে মাঝে মনে স্বপ্ন হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে গেছে।
০৯) প্রাণীরাও স্বপ্নে দেখে
মানুষ স্বপ্ন দেখে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পশুরা কি স্বপ্ন দেখে? আপনার মনে কি কখনও এ প্রশ্নের উদয় হয়েছিল? বিভিন্ন প্রাণীর উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পর ধারনা করা হচ্ছে প্রাণীরাও স্বপ্ন দেখে। এ ধারনার পেছনে রয়েছে একই রকম দেখতে কিছু ব্রেইন ওয়েভ যা মানুষের ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্ন দেখার সময় তৈরি হয়। তবে আপনি যদি পরীক্ষা করে দেখতে চান তাহলে ব্রেইন ওয়েভ নিয়ে ঘাটাঘাটি করার পরিবর্তে আপনার পোষা প্রাণীটিকে ঘুমন্ত অবস্থায় খেয়াল করুন, দেখবেন সেটি ঘুমন্ত অবস্থায় থাবা নাড়ায়, মুখে শব্দ করে বা এমন কোন ভঙ্গি করে যা দেখে মনে হতে পারে সে কারও সাথে পাল্লা দিচ্ছে।
১০) স্বপ্ন দেখা অবস্থায় শারীরিক অসাড়তা
ঘুমন্ত অবস্থায় চোখের মনি নড়াচড়া করা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, যাকে বলা হয় র্যাপিড আই মুভমেন্ট (আরইএম)। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের তার ঘুমের পুরো সময়ের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ ভাগ (৯০ থেকে ১২০ মিনিট) সময়ে এই র্যাপিড আই মুভমেন্ট হয়ে থাকে। ঘুমের যে সময়টায় আপনার র্যাপিড আই মুভমেন্ট চলে অর্থাৎ স্বপ্ন দেখেন তখন আপনার মস্তিষ্কের একটি অংশ শরীরকে কিছুটা অসাড় করে দেয় যাতে স্বপ্নে আপনার নড়াচড়াগুলো প্রকৃত শরীরের উপর কোন প্রভাব না ফেলে। অর্থাৎ স্বপ্নে আপনি এক জায়গা থেকে হেঁটে আরেক জায়গায় চলে যাচ্ছেন খুব সহজেই কিন্তু আপনার দেহ বিছানায় যেভাবে শুয়ে ছিল সেভাবেই আছে, এটা সম্ভব হচ্ছে কেবল মস্তিষ্কের সে অংশের মাধ্যমে যা আপনার দেহকে অসাড় করে রাখে কিন্তু এটা ততক্ষন পর্যন্তই চলে যতক্ষণ আপনার মস্তিষ্কের সে অংশটি জেগে থাকে। আর যখন সে অংশটিও আপনার সাথে ঘুমিয়ে পড়ে তখনই আপনি স্বপ্ন দেখতে দেখতে বিছানা থেকে পড়ে যান।
১১) কিছু জিনিসের সমন্বয় হল স্বপ্ন
আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো যে বিষয় নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকে সেগুলোকেই আমাদের মন ব্যাখ্যা করে স্বপ্ন হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে আমাদের মনের ভেতরে সচরাচর যেসব চিন্তা ভাবনা চলতে থাকে সেসব ঘটনাই আমরা ঘুমের মাঝে স্বপ্ন হিসেবে দেখতে পাই। এর অর্থ হল, আপনি হয়ত ঘুমন্ত অবস্থাতে বাস্তবের চলতে থাকা কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছেন (যেহেতু আপনার ইন্দ্রিয়গুলো সব সময়ই সজাগ) এবং সেই শব্দকে আপনার মস্তিষ্ক একটু অন্যভাবে স্বপ্নে উপস্থাপন করছে। অর্থাৎ, আপনার মা হয়ত আপনাকে ঘুম থেকে জাগাতে আপনার নাম ধরে ডাকছে কিন্তু আপনি স্বপ্নে দেখছেন আপনার প্রেমিকা আপনার নাম ধরে ডাকছে। ব্যাপারটা নির্ভর করছে আপনি বেশিরভাগ সময় কি নিয়ে ভাবছেন তার উপর। অথবা আপনার ভাই হয়ত রুমে গিটার বাঁচাচ্ছে কিন্তু আপনি স্বপ্নে নিজেকে দেখছেন আপনার পছন্দের কোন ব্যান্ড অথবা শিল্পীর কনসার্টে।
১২) পুরুষ এবং নারীর স্বপ্ন আলাদা
আমরা অনেকেই হয়ত, ভাবি নারী-পুরুষ উভয়েই একই রকম স্বপ্ন দেখে। আবার এমনটাও অনেকে মনে করেন যে পুরুষরা হয়ত স্বপ্নে সুন্দরী মেয়েদেরই বেশি দেখে, বা নারীরা হয়ত স্বপ্নে স্মার্ট ছেলেদেরই বেশি দেখে। যদি এমনটা আপনিও ভেবে থাকেন তবে দুটি ধারনাই ভুল। পুরুষ এবং নারী উভয়ের স্বপ্ন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে পুরুষদের স্বপ্নের ৭০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে অন্য পুরুষ চরিত্র। অন্যদিকে, নারীদের স্বপ্নে নারী এবং পুরুষ উভয় চরিত্রের উপস্থিতি সমান। আবার পুরুষদের স্বপ্নে অনুভুতির প্রকাশ নারীদের স্বপ্নের চেয়ে অনেক বেশি কড়া হয়।
১৩) স্বপ্ন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারনা দেয়
স্বপ্নে ভবিষ্যৎ জানা যায় বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায় এমনটা আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি। যদি আপনিও এমনটা ভেবে থাকেন তাহলে আপনার সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে, কারন পৃথিবীর বেশ কিছু স্থানে বিভিন্ন মানুষের উপর চালানো জরিপের ফলাফল এমনটাই দেখায়। সেসব জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, যাদের নিয়ে জরিপ করা হয়েছে তাদের মধ্যে ১৮ থেকে ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত মানুষ দাবি করেছেন যে তারা জীবনে অন্তত একবার হলেও স্বপ্নে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারনা পেয়েছেন এবং জরিপে অংশগ্রহণ করা মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশেরই দেখা স্বপ্ন পরে বাস্তবের সাথে মিলে গেছে যা তাদের জন্য অপ্রত্যাশিত ছিল। সে জরিপগুলোতে অংশগ্রহণকারীদের কাছে আরেকটি প্রশ্ন ছিল তাদের মধ্যে কয়জন “স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখা বা জানা যায়” এই কথায় বিশ্বাস করেন; ফলাফলে দেখা যায় জরিপভেদে ৬৩ থেকে ৯৮ শতাংশ মানুষ এই কথায় বিশ্বাস করেন।
১৪) নাক ডাকা অবস্থায় স্বপ্ন দেখা যায় না
ইন্টারনেটের একটা বিশাল অংশজুড়ে আছে আপনি ঘুমন্ত অবস্থায় যদি নাক ডাকেন তাহলে আপনি সে সময়টায় স্বপ্ন দেখতে অপারগ। এ ধারনাটি যদিও অনেকেই চিরন্তন সত্য হিসেবে ধরে নিয়েছে তবে এ তথ্যের সত্য-মিথ্যা নিয়ে আমার কিছুটা সন্দেহ আছে কারন ইন্টারনেটের কোথাও এ ব্যাপারে কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
লিখেছেনঃ লিসান