ভারতীয় হিন্দি সিরিয়াল বর্তমানে বাংলাদেশে একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। হিন্দি সিরিয়ালের শিক্ষনীয় কোন বিষয় না থাকলেও এর দর্শক দিন দিন বেড়েই চলেছে। রাবারের মতো টেনে-হিঁচড়ে এসব সিরিয়াল এমনভাবে লম্বা করা হয় যে, এর শেষ পর্ব কবে প্রচারিত হবে তা কেউ যেমন জানে না তেমনি আন্দাজও করতে পারে না।
শুরুর কথাঃ গণমাধ্যম হিসেবে আমাদের দেশে টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৪ সালে। তখন বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল। শুরু থেকে অদ্যাবধি এ চ্যানেলটি এককভাবে সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। বিধায় এই চ্যানেলটি জনগণকে পরিপূর্ণ বিনোদন দিতে পারেনি। আর তাই জনগণও বিনোদনের অন্য বিকল্প উপায় না পেয়ে হিন্দি সিরিয়ালের দিকে ঝুঁকতে থাকে। ১৯৯৬ সালের দিকে বাংলাদেশে হিন্দি চ্যানেল বলতে শুধু সনি আর জিটিভি কে বুঝাতো। বর্তমানে ত্রিশোর্ধ ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা চ্যানেল এবং ভারত কর্তৃক সম্প্রচার সত্বাধিকারপ্রাপ্ত কিছু ক্রীড়া, প্রাণীজগৎ, সৌরজগৎ ও ধর্ম বিষয়ক চ্যানেল সহ প্রায় শতাধিক চ্যানেলে অনুষ্ঠান সার্বক্ষণিক সম্প্রচারিত হচ্ছে।
আমাদের দেশে হিন্দি সিরিয়ালের যাত্রা শুরু হয় মূলত স্টার প্লাসে সম্প্রচারিত ‘সাসভি কাভি বাহু থি’ সিরিয়ালের মাধ্যমে। সিরিয়ালটি অল্পদিনেই জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর ‘কাহানী ঘার ঘার কি’, ‘কাসেটি জিন্দেগী কি’, ‘শশুড়াল গেন্দা ফুল’, ‘রিসতা ক্যা কেহরাহে’, ‘সাথ নিভানা সাথিয়া’, ‘কুম কুম’ ইত্যাদি সিরিয়ালগুলো দেশের বিশেষ করে মহিলাদের নিকট অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মহিলাদের নিকট এসব হিন্দি সিরিয়াল জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণ হলো, গৃহবধূদের সময় কাটানোর একটি চমৎকার উপায়। সন্ধ্যা সাতটা থেকে শুরু হয়ে একটানা রাত বারটা পযর্ন্ত সম্প্রচার করা হয়। আবার পরের দিনেই সারাদিন ব্যাপি তার পুনঃপ্রচার করা হয়। ফলে মহিলাদের সময়গুলো খুব স্বচ্ছন্দেই কেটে যায়। কিন্তু নির্মম সত্যি হলো এসব হিন্দি সিরিয়াল মানুষের স্বাভাবিক জীবনে প্রচুর প্রভাব ফেলছে। ইতিবাচক দিকটির চেয়ে নেতিবাচক দিকটি ফুটে উঠছে সবচেয়ে বেশি।
হিন্দি সিরিয়ালের খারাপ দিকগুলোঃ হিন্দি সিরিয়ালের মধ্যে যে সব ম্যাসেজ বা বার্তা থাকে তা একটি পরিবার তথা সমাজ কে ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট। হিন্দি সিরিয়াল দেখার ফলে সমাজ থেকে যেমন সামাজিক মূল্যবোধ উঠে যাচ্ছে তেমনি সামাজিক, মানসিক সবক্ষেত্রেই দেখা দিচ্ছে অস্থিরতা। অনৈতিক ও ঘৃণ্য অশ্লীলতা ছাড়া শিক্ষণীয় তেমন কিছুই পাওয়া যায় না বলেই এমনটি হচ্ছে। ভারতীয় হিন্দি সিরিয়ালে যে সব দৃশ্য সচরাচর দেখতে পাওয়া তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-অসম প্রেম, স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়া, পারিবারিক ভাঙ্গন, বহু বিবাহ, বউ-শ্বাশুড়ীর ঝগড়া, সম্পত্তির কারণে ভাই-ভাই ঝগড়া, স্ত্রীর কূটনৈতিক চাল, ভুল বোঝাবুঝি, হিংসা, সন্দেহ, অশ্লীলতা, আত্মীয়দের ছোট করা, অন্যকে বিপদে ফেলা, চুরি শিক্ষা, অপরাধ শিক্ষা এসব বিষয়ই হিন্দি সিরিয়ালের মূল বিষয়বস্তু।
ছেলে-মেয়েদের ওপর হিন্দি সিরিয়ালের প্রভাবঃ কোন কোন পরিবারে দেখা যায় মা-বাবার সাথে পরিবারের ছোট শিশুটিও হিন্দি সিরিয়াল দেখতে টিভির সামনে বসে গেছে। এর ফলে বাবা-মারা জানতেই পারে না যে শিশুটির মানসিক বিকৃতি ঘটছে। মাঝে মধ্যে এমনও দেখা যায় যে, এসব পরিবারের কর্তারা ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের পড়ানোর পর্যাপ্ত সময় না পেলেও তাদের কে নিয়েই হিন্দি সিরিয়াল দেখতে বসে যান। ফলে ছোটবেলা থেকেই এসব শিশু পরিচিত হচ্ছে অপসংষ্কৃতির সাথে। অনেক শিক্ষার্থী নিজেদের পড়ার খবরটি ঠিক মতো না জানলেও হিন্দি সিরিয়ালের চরিত্র ও সময়সূচী ঠিকই জানে। এভাবে মা-বাবারাই মূলত তাদের অজান্তেই আদরের বাচ্চাদের মানসিক বিকাশের পথে বড় বাঁধা তৈরি করে চলেছেন দিনের পর দিন। শিশুর অকালে নষ্ট হওয়ার জন্য এসমস্ত রুচিহীন ও নির্বোধ বাবা-মায়েরাই দায়ী হবেন।
সমাজ ও নিজস্ব সংষ্কৃতির উপর প্রভাবঃ বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেলের সম্প্রচারিত হওয়া অনুষ্ঠানমালার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে বিভিন্ন নামে প্রচার হওয়া টিভি সিরিয়ালগুলো। এসব সিরিয়ালের দাপটে বাংলার নিজস্ব সংষ্কৃতি ও ঐতিহ্য আজ হুমকীর সম্মুখীন। একটা সময় ছিল যখন সন্ধ্যা নামলেই পরিবার-পরিজন সবাই একত্রে বসে গল্প-গুজব করে সময় কাটাতো। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। সন্ধ্যার পরেই হিন্দি সিরিয়াল দেখে মানুষ শিখছে কিভাবে শাশুড়ী তার বউকে কিংবা বউ তার শাশুড়ী শায়েস্তা করতে পারে, কেমন করে অন্য পরিবারের ক্ষতি করা যায় তার ফন্দি আঁটে। এমনকি সমাজে পরকীয়ার মতো ঘটনাও বেড়ে চলছে রুচিহীন এই হিন্দি সিরিয়ালের কারণে। হিন্দি সিরিয়ালগুলোতে দেখানো হয় জৌলুসপূর্ণা পরিবেশ, চাকচিক্যময় জীবন ব্যবস্থা, দামী গাড়ী, বাড়ী, শাড়ী গয়না যা আমাদের দেশের তরুণদেরকে খুব সহজেই আকৃষ্ট করে। আমাদের ধর্ম, মূল্যবোধ, পরিবার, সমাজ এসব সর্মাথন না করলেও আমরা তা দেখছি। আমরা আমাদের নিজস্ব সংষ্কৃতি পায়ে দলিত করে ভারতীয় সংষ্কৃতির ওপর আজ দাঁড়িয়ে আছি। হিন্দি সিরিয়ালের ভয়াল থাবায় আমাদের সমাজ-সংষ্কৃতি আজ ক্ষত-বিক্ষত। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরাও এর প্রভাবে আজকাল হিন্দিতে কথা বলছে। ঈদ-বা পূজার অনুষ্ঠানগুলোতে আমরা তাদের ওপর ধীরে ধীরে যেন নির্ভশীল হয়ে পড়তেছি। কেননা এখন ঈদ বা পূজা এলেই বাজারে বিভিন্ন হিন্দি সিরিয়ালের নামানুসারে কিংবা নায়িক/মডেলের নামানুসারে কাপড় কিনতে পাওয়া যায়। মাসাক্কালি, ঝিলিক, আশকারা, খুশি নামের পোশাকগুলো ঈদের সময় হলেই বাজার দখল করে নেয়। আকাশ ছোঁয়া এসব দামী পোশাকগুলো কিনতে বসন্ধুরা সিটিসহ গুলশান, বারিধারা, উত্তরার মতো অভিজাত পাড়ার দোকানগুলোয় ভীড় লেগে থাকে। আবার কিছু কিছু দোকানও ইদানিং হিন্দি সিরিয়ালের নামে নামকরণ করা হয়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
অথর্নৈতিক ক্ষতিঃ হিন্দি সিরিয়ালের প্রভাবে আমরা সাংষ্কৃতিক ভাবে যেমন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি তেমনি অর্থনৈতিক ভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। আমাদের দেশে ভারতের যে সব চ্যানেল সম্প্রচারিত হয় আমাদের কে সেগুলো পয়সা দিয়ে কিনে দেখতে হয়। এজন্য প্রতি বছর দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ভারতকে দিতে হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আমাদের দেশীয় কোন চ্যানেল চালুর অনুমতি দিচ্ছে না ভারত। বিপুল দর্শক চাহিদা থাকা সত্বেও পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠী আমাদের দেশ হতে সম্প্রচারিত টেলিভিশনের অনুষ্ঠানসমূহ দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আমরা তাদের হিন্দি সিরিয়াল দেখার পাশাপাশি তাদের পণ্যের সাথে পরিচিত হচ্ছি। এর ফলে তাদের পন্যের যেমন প্রচার ও প্রসার হচ্ছে আমাদের দেশের সেটা হচ্ছে না। নিজ দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি করে কেন তাহলে আমরা হিন্দি চ্যানেল দেখতে যাব।
দায় এড়াতে পারে না দেশের মিডিয়াঃ হিন্দি সিরিয়ালের দর্শক প্রধানত আমাদের দেশের নিম্নবিত্ত বস্তিবাসী ও শ্রমিকশ্রেণী, পোশাক শ্রমিক, উগ্র মানসিকতা সম্পন্ন যুবসমাজ এবং একই মানসিকতার কিছু উচ্চবিত্ত। তাদের নিকট এসব সিরিয়াল ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে মূলত মিডিয়ার প্রচার। মিডিয়ার দায়িত্ব হচ্ছে নিজ দেশের সংষ্কৃতি-সভ্যতা, কৃষ্টি ও নিজস্ব মূল্যবোধ প্রচারের মাধ্যমে তাদের দায়িত্বশীলতা জনতার সামনে ফুটিয়ে তোলা। কিন্তু সেই সৎ সাহস আজও আমাদের দেশের পত্রিকা অর্জন করতে পারেনি বলেই মনে হয়। প্রতিটা পত্রিকায় ‘বিনোদন’ বা ‘লাইফ স্টাইল’ নামে একটা আলাদা পাতা থাকে। যেখানে দেশের শিল্প ও সংষ্কৃতির সংবাদ পাওয়া যায়। কিন্তু এসব পত্রিকার বিনোদন পাতায় চোখ রাখলেই দেখা যাবে আধুনিকতার নামে মেয়েদের টপস্ আর জিন্স প্যান্ট, স্লিভলেস ড্রেস পরার ছবি, ছেলেদের চুল থেকে পা পর্যন্ত উদ্ভট সাজ। যা আমাদের সমাজ-সংষ্কৃতির সাথে যায় না। এসব পত্রিকার সম্পাদকেরা একবারও দেশের সংষ্কৃতির কথা ভাবেন না। ভাবেন শুধু নিজ পত্রিকার কাটতির কথা। কিছুদিন আগেই দেশের নামকরা একটা জাতীয় দৈনিকের বিনোদন পাতায় দেখলাম ভারতীয় হিন্দি সিরিয়ালের সংবাদ। কখন, কোন চ্যানেলে প্রচারিত তার ছবি সহ সময়সূচী দেয়া হয়েছে। অথচ এই পত্রিকাগুলোকেই বলা হয় সমাজের দর্পণ। তারা যেভাবে সমাজকে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরবে সেভাবে জনতা সেটা মনেপ্রাণে গেঁথে নিবে, বিশ্বাস করবে। তাই পত্রিকাগুলোর কাছে বিশেষ দাবী আপনারা হিন্দি সিরিয়ালের সংবাদ প্রচার না করে নিজ দেশের সংষ্কৃতি-সভ্যতা, কৃষ্টি ও নিজস্ব মূল্যবোধের সংবাদ বেশি করে প্রচার করুন।
হিন্দি সিরিয়াল বন্ধে আমাদের করণীয়ঃ আমাদের জীবন-যাপনের সাথে হিন্দি সিরিয়ালগুলোর মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। হিন্দি সিরিয়াল এমনই একটি বিনোদন মাধ্যম যেখান থেকে আপনি নতুন কিছু শিখতে পারবেন না। এই সিরিয়ালগুলো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মূল্যবোধ পাল্টে দিচ্ছে, রুচির বিকৃতি ঘটাচ্ছে মানুষের। আজ আমরা আমাদের বাঙ্গালীয়ানা ভুলে গিয়ে লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করছি তাদের দেখে। ‘শাড়িতে বাংলার নারী’ এই কথা ভুলে গিয়ে শাড়ি পরার নতুন ধরন শিখছি তাদের দেখাদেখি। কোন কোন ক্ষেত্রে আবার শাড়ী তো দূরে থাক টপস্ আর প্যান্ট পরেই রাস্তায় চলাচল করছে মেয়েরা। আমরা কেন পোশাক পরি তার সংজ্ঞাই হয়তো পরিবর্তন করে দিচ্ছে এই হিন্দি সিরিয়ালগুলো।
বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা ঘরের ভিতর যেমন বন্দি হয়ে থাকতে চাই না তেমনি চাই না অপসংস্কৃতির দুর্গন্ধ আমাদের সমাজে ছড়িয়ে পড়ুক। ভারতীয় চ্যানেল, সিনেমার অবাধ বিচরণ আমাদের দেশে। আর তাই ইচ্ছে করলেও এই অবাধ বিচরণ থামাতে পারবো না। আমাদের সবকিছু্র সানিদ্ধ্যে আসতে হয়। কিন্তু এখান থেকেই আমাদের বুদ্ধি-বিবেক আর শক্তি দিয়ে খারাপ সংষ্কতি বর্জন করতে হবে। আমরা বাঙ্গালী। আর বাঙ্গালীদের রয়েছে গর্ব করার মতো হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সংষ্কতি। আমাদের সাহিত্য-সংষ্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ। তাই এ সমৃদ্ধ সংষ্কৃতির চর্চা করলে, বাংলা নাটক, সিনেমা, যাত্রাপালা দেখলে নিঃসন্দেহে কমে আসবে হিন্দি সিরিয়াল দেখার প্রবণতা। হিন্দি সিরিয়ালের এই অপসংষ্কৃতি রোধ করতে সরকারকে এগিয়ে আসার পাশাপাশি তরুণদেরকেও এই সংষ্কৃতির ওপর কুঠারাঘাত করতে হবে।
[কার্টেসিঃ মোকসেদুল ইসলাম]