কেনিয়ার কোণে কোণে (শেষ কিস্তি)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
সূর্যাস্তকে পেছনে ফেলে আমরা রিসোর্টে ফিরলাম। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করার সময় জানতে পারলাম যে রিসোর্ট এর বার থেকে প্রতি রাতে মাংস ছুঁড়ে দেওয়া হয় বাইরে আর তা খেতে বেশ কিছু বন্যপ্রাণী চলে আসে রিসোর্টের কাছে - যদিও তাদের মধ্যে হায়েনাই বেশী তবে মাঝে মাঝে বড় বিড়ালদেরও দেখা যায়। তখনও জানতাম না কি চমক অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। যারা ভাবছেন হয়ত রাতের অন্ধকারে বেশ কিছু প্রাণী দেখে ফেলেছি সেটাই চমক তাদের বলি বেশ কিছু হায়েনা ওই স্বল্প-সময়ে চোখে পড়েছে বটে তবে সেটা আসলে চমক নয়, চমক হচ্ছে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা তা দেখলাম একদিন সেখানে দাঁড়িয়ে কিলিমাঞ্জারো দেখতেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে।
রিসোর্টের বারটা এখন যেখানে, সেখানে ছিল হেমিংওয়ের কেনিয়া বাস-কালীন কেবিন। পরবর্তীতে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ জায়গা কিনে নিলেও হেমিংওয়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কেবিনটাকেই বারে রূপান্তর করে কিন্তু নাম রেখে দেয় হেমিংওয়ের নামেই। "স্নোজ অব কিলিমাঞ্জারো" হেমিংওয়ে নাকি এখানে বসেই লিখেছেন- আর লেখার প্রেরণা কিভাবে পেলেন তাতো নিজের চোখেই দেখে এলাম - এই রিসোর্টটা থেকে চমৎকার কিলিমাঞ্জারোর ভিউ পাওয়া যায় যে।
পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া হল আম্বোসেলী পার্কের দিকে। ধূলি ধূসরিত রাস্তায় প্রত্যেকটা গাড়িই চাচ্ছে আগের গাড়িকে টপকে সামনে চলে যেতে নাহলে প্রচুর ধুলো খেতে হবে পিছনে পড়ে থাকলে। পুরো কেনিয়া ভ্রমণে অসংখ্য বার ক্যামেরার লেন্স পরিবর্তন করার কারণে অলরেডী ভাল পরিমাণে ধুলো সেন্সরের উপর পড়ে গেছে যা নষ্ট করেছে অসংখ্য ছবি। এই ধুলোর রাজ্যে তাই লেন্স পরিবর্তন করার সাহসই করলাম না - মিস হয়ে গেল আরও বেশ কিছু মুহুুর্ত। যাই হোক যে লেন্স লাগানো আছে তাতে যা ছবি তোলা যায় তাই সই।
প্রচুর পরিমাণে ধুলোয় মাখামাখি হয়ে ঢুকলাম পার্কের ভিতর। সবার প্রথমে পেলাম গ্র্যান্ট'স গ্যাজেলের দেখা।
যাঁরা প্রথম পর্ব পড়েছেন তাঁরা তো থমসন'স গ্যাজেল ইতিপূর্বে দেখেছেন। দুই গ্যাজেলকে আলাদা করে সহজে চেনা যায় পেছনের সাদা দাগ দেখে। গ্র্যান্ট'স এর ক্ষেত্রে যেখানে পেছনের দাগ লেজ ছাড়িয়ে ও কিছুটা উপরে উঠে গেছে থমসন'স এর ক্ষেত্রে সেটা লেজ শুরু হওয়ার আগেই শেষ। আকৃতিগত পার্থক্যও কিছু আছে তবে সেটা দুই প্রজাতি পাশাপাশি না থাকলে সহজে বোঝা যায় না।
ঝোপের মধ্যে কোন মাংসাশী প্রাণীর উপস্থিতি টের পেতেই ঝেড়ে দৌড় দিল দলটি
আবারও আমরা চোখের সামনে জলজ্যান্ত শিকার দেখার সুযোগ পেয়েও বঞ্চিত হলাম।
যাই হোক কিছুটা এগিয়ে যেতে চোখে পড়ল Kittlitz's plover (Charadrius pecuarius)
পাখীটার নামকরণ হয়েছে জার্মান পরিবেশ-বিদ হাইনরিখ ভন কিটলিটয এর নামে। যে ৪ প্রজাতির পাখীর নামের সাথে ভদ্রলোকের নাম জড়িয়ে আছে তার মধ্যে উপরেরটি একটি। যদিও ৪টির মধ্যে ২ টি প্রজাতি অলরেডী বিলুপ্ত, এই পাখীটিকে নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিটলিট'য প্লোভার এর কনজারভেশন স্ট্যাটাস এখনও “Least Concern”। ল্যাপউয়িং গোত্রের ২ পাখীর সাথেও দেখা হয়ে গেল । প্রথমে দেখা দিলেন Crowned Lapwing (Vanellus coronatus)
তার পরপরই দেখা পাওয়া গেল Blacksmith Lapwing(Vanellus armatus) এর
এদের বিচরণ সাধারণতঃ আফ্রিকার আরও দক্ষিণে। আমরা ভাগ্যগুণে দেখা পেয়ে গেলাম আর কি।
সময় প্রায় দুপুর, গোসলের সময়। একপাল হাতি তাই ধুলো উড়াতে উড়াতে চলে যাচ্ছে জলাভূমির দিকে
ধুলাময় রাস্তা ছেড়ে আমরাও চলে এসেছি জলাভূমির কাছাকাছি। সামনে পড়ে গেল একপাল জলহস্তী
চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে আমাদের উপস্থিতি তাদের খুব একটা পছন্দ হচ্ছে না। একটাও যদি দৌড়ে এসে আমাদের গাড়ীতে বাড়ি দেয় তাহলেই আর দেখতে হবে না। আমরাও এজন্য মানে মানে সে জায়গা ছেড়ে সরে পড়লাম।
জলাভূমিতে আধেক শরীর ডুবিয়ে রেখে মা হাতি যখন মনের সুখে খেলছে বাচ্চার সাথে
তখনই চোখে পড়ল তাকে। মাছের যম আফ্রিকান মেছো ঈগল (Haliaeetus vocifer) রাজকীয় ভঙ্গিমায় বসে আছেন জলাভূমির কাছে।
আগের পর্বে আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম একজনের সাথে যিনি ২টি দেশের জাতীয় পাখীর খেতাব একাই বাগিয়ে নিয়েছেন। ইনি এক না দু কাঠি উপরে, এনার দখলে আছে ৪ টি দেশের জাতীয় পাখী হওয়ার খেতাব। জ্বী জনাব, পাখীটি একাধারে ৪টি আফ্রিকান দেশ জিম্বাবুয়ে, জাম্বিয়া, নামিবিয়া আর সদ্য স্বাধীন হওয়া দক্ষিণ সুদানের জাতীয় পাখী। একই রেকর্ডের অধিকারী আরেকটা পাখী আছে যার বসবাস দক্ষিণ আমেরিকায় - আন্দেজের শকুন। কোনদিন দক্ষিণ আমেরিকায় যাওয়ার সুযোগ হলে তাদের গল্প হবে ক্ষণ। যাঁরা ভাবছেন এই ২ পাখীই হয়তো সবচেয়ে বেশী দেশের জাতীয় পাখীর রেকর্ডধারী তাদের জানিয়ে রাখি সোনালী ঈগল ৫ টি দেশের জাতীয় পাখীর খেতাবধারী, তবে বেশীরভাগ দেশেই বেচারা অফিশিয়ালি এই খেতাব না পাওয়ায় আপাতত বলা যায় আফ্রিকান মেছো ঈগল আর আন্দেজের শকুনই সবচেয়ে বেশী দেশের জাতীয় পাখীর অফিশিয়াল রেকর্ডধারী।
মধ্যাকাশ থেকে সূর্য বেশ কিছুটা পশ্চিম দিকে হেলে যাওয়ায় আমাদের পার্ক থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়ে গেল। পার্ক থেকে বেরিয়ে আসার আগে চোখে পড়ল একপাল ওয়াইল্ডাবীস্ট।
এরা মাইগ্রেটরি দলের অংশ নয়, এরা স্থায়ীভাবে এখানকার বাসিন্দা হয়ে গেছে ।
আম্বোসেলী পার্ক থেকে বেরিয়ে আমরা চললাম মাসাই গ্রামের দিকে। গ্রামবাসী সাদরে স্বাগত জানাল তাদের গ্রামে। মাসাই নাচের মাধ্যমে শুরু হল মাসাইদের জানার পর্ব। মাসাই নাচের প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে উপরের দিকে লাফানো আর নাচের অনুষ্ঠানে যে তরুণ সবচেয়ে উঁচুতে লাফাতে পারে সেই জয় করে তরুণীদের হৃদয়।
মাসাইদের স্বয়ম্বর-সভাতেও যে সবচেয়ে বেশী উঁচুতে লাফাতে পারে সেই পায় বরমাল্য। নাচের অনুষ্ঠানের পর গ্রাম পরিভ্রমণ। নিচের ছবির মত খুবই ছোট ছোট কুঁড়েঘরে থাকে মাসাইরা।
গড়ে ৬ফুট বা তারও বেশী লম্বা মাসাইদের কুঁড়েঘর কেন এত নিচু তার উত্তর জিজ্ঞেস করেও পাইনি। আর ঘরের আয়তনও খুব ছোট। বেশীরভাগ বাসা সাধারণতঃ একটা শোবার ঘর আর একটা রান্নাঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর পুরো গ্রাম ঘেরা থাকে কাঁটাওয়ালা গাছের শুকনো ডাল দিয়ে যা রক্ষা করে তাদেরকে মাংসাশী প্রাণীর আক্রমণ থেকে।
কিভাবে এখনও পুরনো পদ্ধতিতে মাসাইরা আগুন জ্বালায় তাও দেখা হল
শোনা হল কিভাবে মাসাইরা সিংহ শিকার করে। আইনতঃ বর্তমানে সিংহ শিকার নিষেধ তবুও এখনও কিছু কিছু মাসাই পূর্বপুরুষদের রীতি ধরে রেখেছে, শুধুমাত্র একটা ঢাল আর বল্লম নিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ে সিংহ শিকারে। নিয়ম অনুযায়ী মৃত সিংহের লেজ বরাদ্দ দলের সবচেয়ে সাহসী শিকারীর জন্য আর সাহসী শিকারীর তকমা তার ভাগ্যে জুটবে যে সবার আগে আক্রমণ করেছে সিংহকে। কারণ সিংহ প্রতিআক্রমণ করবে তাকেই যে সবার আগে আক্রমণ চালিয়েছে। এই যে দেখুন সেই পুরষ্কার সিংহের লেজ ধরে আছি আর পাশের মাসাইয়ের হাতে রয়েছে গরুর লেজ
জীবন বাজি রেখে পাওয়া এই সিংহের লেজ দিয়ে কি করে জিজ্ঞেস করায় মাসাই হেসে বলল - কেন? মাছি তাড়াই।
যদিও জানি এই লেজ এরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম রেখে দিবে আর বংশানুক্রমে চলবে বংশের প্রাক্তন সদস্য কোন এক সাহসী সিংহ শিকারীর গল্প।
রং বেরং এর পুতির মালা খুবই পছন্দ মাসাই মেয়েদের।
পুতি দিয়ে মালা গেঁথে তা গলায় পরে সেজে-গুজে বিকেল কাটানো ওদের প্রিয় একটা কাজ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসল, মাসাইদের বিদায় জানিয়ে আমরাও ধীরে ধীরে ফিরে চললাম রিসোর্ট এর দিকে।
পরের দিন কেনিয়ায় আমাদের শেষ দিন। আম্বোসেলী থেকে সোজা চলে যাব নাইরোবীর জোমো কেনিয়াত্তা বিমানবন্দরে। তাই সকাল বেলায় বেশ খানিকটা সময় কাটালাম শুধু কিলিমাঞ্জারো কে দেখে
সময় বাধ্য করে কোন না কোন সময়ে বিদায় জানাতে। কিলিমাঞ্জারো কেও একসময় বলতে হল বিদায় ! ! ফিসফিস করে সেও কি বলল "আবার এসো"?
ছবি কৃতিত্ব: ৩/৪ টা বাদে বাকী সকল ছবি তোলার কৃতিত্ব আমার স্ত্রীর। কোন্ গুলি আমার তোলা সেটা নিয়ে দাম্পত্য বিবাদ ২০১১ সাল থেকে এখন অবধি চলছে।
বি:দ্র: যে প্রাণী/পাখী দের বাংলা নাম জানা নেই তাদের ইংরেজী নামের সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক নামও জুড়ে দিলাম-জীবজগত নিয়ে জানতে আগ্রহীদের হয়ত সুবিধে হতে পারে ভেবে।
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
১৮টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন